হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক : দ্রুত যা করতে হবে
হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক : দ্রুত যা করতে হবে - ছবি সংগৃহীত
এই ছিল, এই নেই। তীব্র বুকের ব্যথায় নিমেষে সব শেষ। কিন্তু হার্ট অ্যাটাক দুর্ঘটনা নয়। জানিয়েই আসে। হৃদযন্ত্রে হামলা মোকাবিলায় সতর্কতা প্রয়োজন। কীভাবে?
আজই হয়তো মর্নিং ওয়াকে দেখা গিয়েছিল ব্যক্তিটিকে। কিন্তু বাজার সেরে বাড়ি ফেরার পথে হার্ট অ্যাটাক। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু। কোনো গৃহিণীর রাঁধতে রাঁধতে আচমকা বুকে ব্যথা। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই সব শেষ। পুরোপুরি সুস্থ, ছটফটে, খটখটে মানুষের এমন আকস্মিক মৃত্যুর খবরে স্তম্ভিত হয়ে যান সবাই। পরিজনদের মনে প্রশ্ন জাগে, ‘কোনো অসুখ তো ছিল না। তা হলে হঠাৎ ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হলো কী করে? চিকিৎসার কোনো সময় পাওয়া গেল না কেন?’
এমন ঘটনা আকছার ঘটে। হা-হুতাশ ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। তবে এই ধরনের হার্ট অ্যাটাককে অ্যাক্সিডেন্ট বলা যায় না। উল্টা সঠিক সময়ে সতর্ক হয়ে এই পরিস্থিতিকে জীবন থেকে এড়ানো যায়। সাধারণত উপসর্গ ছাড়াই পুরোপুরি সুস্থ মানুষের হার্ট অ্যাটাক বা তার জেরে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয় না।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগীর প্রেশার, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরলের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকলে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়। নিয়মিত চেক না করার কারণে আপাতদৃষ্টিতে তাদের সুস্থ মনে হয়। একইসঙ্গে হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গ সঠিক সময় ধরতে না পারার কারণে এমন ভয়াবহ পরিণতি হয়।
কাদের ঝুঁকি
দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপ, হাই ব্লাড সুগার, ধূমপানের অভ্যাস, কোলেস্টেরল বেশি থাকলে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা থাকে। এগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত ওষুধ না খেলে ঝুঁকি মারাত্মক। এছাড়া যাদের পরিবারে ৫০ বছরের আগে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর ইতিহাস আছে তাদেরও যথেষ্ট রিস্ক আছে। বিশেষ করে মা-বাবা, ভাই-বোন, চাচা-মামার কম বয়সে হার্ট অ্যাটাক হলে পরবর্তী প্রজন্মকে সাবধান থাকতে হবে। বয়স বাড়লেও হার্ট অ্যাটাক হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে।
তাই ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকের কারণ হিসাবে পারিবারিক ইতিহাস আর বয়সকে ধরা হয়। তবে এই দু’টি কারণকে প্রতিহত করতে সাবধান হওয়া ছাড়া বিশেষ উপায় নেই। তীব্র হার্ট অ্যাটাকের কারণে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন এমন বহু রোগীর ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, তিনি হয়তো কয়েক বছর আগে শেষ প্রেশার চেক করিয়েছিলেন। কেউ সুগার, প্রেশার নিয়মিত চেক করালেও কোলেস্টেরল, থাইরয়েড কোনওদিন পরীক্ষা করাননি। কেউ আবার এমনিতে ডিসিপ্লিনড জীবনযাপন করলেও অত্যধিক ধূমপান করেন।
জেনে নিন লক্ষণ :
হার্ট অ্যাটাকের কিছু দিন বা কয়েক মাস আগে থেকেই সাধারণত কিছু লক্ষণ দেখা যায়। যেমন-
* একটুতেই ক্লান্তিভাব, বুকে ব্যথা, বুক ধড়ফড়।
* বসে থাকলে কষ্ট নেই কিন্তু হাঁটলেই অস্বস্তি, বুকে ব্যথা হওয়া।
* হাঁটলেই ঘাম হওয়া। বসলে আর ঘাম না হওয়া।
* বুকে ব্যথার সঙ্গে ঘাম হওয়া।বুকের বাঁ-দিক, ঘাড়-পিঠে ব্যথাই শুধুমাত্র হার্ট অ্যাটাকের সংকেত নয়। নাভি থেকে গলা পর্যন্ত যেকোনো জায়গাতেই ব্যথা হতে পারে (যা বেশিরভাগ রোগী গ্যাসের ব্যথা ভেবে ভুল করেন)।
* অনেক সময় দাঁতেও ব্যথা হতে পারে।
এই সমস্ত লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তার দেখান।
অ্যাটাকের সময় কী করবেন
হার্ট অ্যাটাক হলে তিন ঘণ্টা অর্থাৎ গোল্ডেন আওয়ারের মধ্যে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। এই সময় অনিয়মিত হারে হার্টবিট পড়ে। একে ভেন্ট্রিকিউলার ট্যাকিকার্ডিয়া বলে। এছাড়া ধমনীর মাধ্যমে রক্ত হার্টে পৌঁছতে পারে না। তাই যত দ্রুত চিকিৎসা শুরু হবে রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা তত বেশি হবে। একইসঙ্গে হার্ট কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
হার্ট অ্যাটাকের কারণে কেউ আচমকা পড়ে গেলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি সিপিআর দেয়া যায়। হার্ট অ্যাটাকের রোগীদের কথা ভেবে বিদেশে শক দেওয়ার যন্ত্র রাস্তার ধারে লাগানো থাকে। কিন্তু এ দেশে সেই ব্যবস্থা নেই। তাই হার্ট সচল রাখতে সিপিআর দেয়াই প্রাথমিক উপায়।
রোগীর মুখে অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ দিতে হবে। সরবিট্রেট জাতীয় ওষুধ দেয়া যেতে পারে। তবে এই ওষুধ রক্তচাপ কমিয়ে দেয়। তাই এটি দিলে রোগীকে শুইয়ে রাখতে হবে।
দ্রুত ইসিজি করিয়ে নিশ্চিত হতে হবে, হার্ট অ্যাটাক হয়েছে কি না।
রোগীকে বসিয়ে পিঠে বালিশ দিয়ে হেলান দিয়ে থাকতে বলুন। তবে যে পজিশনে থাকতে রোগীর সুবিধা হচ্ছে, তেমন অবস্থাতেই রাখা ভালো।
এই সময় সিঁড়ি ভাঙা, হাঁটাচলা করানো ঠিক নয়।
চিকিৎসা
রক্ত সংবহন পথে রক্ত জমাট বাঁধার কারণে হার্টে রক্ত পৌঁছতে পারে না। সেই কারণে মূলত হার্ট অ্যাটাক হয়। গোল্ডেন আওয়ারের মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছলে ওষুধের মাধ্যমে জমাট রক্ত তরল করে দেয়া যায়। ৩-১২ ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে গেলে সাধারণত হার্টে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। তখন তা কাটানোর সবচেয়ে ভালো উপায় অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করানো। তবে ১২ ঘণ্টার মধ্যে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করলে যথেষ্ট ভালো ফল পাওয়া যায়। কোনও কারণে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করাতে না পারলে ওষুধের উপরই ভরসা রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে ফল খুব ভালো নাও হতে পারে।
সাবধানতা
সাধারণত, ৫০ বছরের পর হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বাড়ে। কিন্তু উপমহাদেশের লোকজনের জন্য সেই ঝুঁকি ৪০-এর পর থেকেই রয়েছে। একইসঙ্গে এখানকার মানুষের জিনে হার্টের অসুখের প্রবণতা অন্যদের তুলনায় বেশি। এমন নয় যে, এখানকার আবহাওয়া এর জন্য দায়ী। কারণ, বিদেশে বসবাসকারী উপমহাদেশের লোকজনের কম বয়সে হার্টের অসুখ হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। জিন বদলানো সম্ভব নয়, তাই তিরিশের কোঠা থেকেই হার্ট সুস্থ রাখতে সচেতন হওয়া উচিত।
শরীর খারাপ হয়ে যাওয়ার পর থেকে রুটিন হেলথ চেক আপ না করে সুস্থ থাকার সময় থেকেই করুন। তাই ৩৫-৪০ বছর বয়স থেকেই ছ’মাস অন্তর একবার ব্লাড সুগার, ব্লাড প্রেশার, কোলেস্টেরল চেক করতে হবে। বয়স বাড়লে দু’-এক মাস অন্তর নিয়ন্ত্রণে না থাকলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শমতো ওষুধ খান।
মা-বাবার ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাকের ইতিহাস থাকলে ৩০—৩৫ বছরের মধ্যেই টেস্টগুলি নিয়মিত করাতে হবে।
ব্লাড প্রেশারের মতোই নিঃশব্দ ঘাতক ব্লাড সুগার। হার্টের অসুখের পাশাপাশি ডায়াবেটিস হওয়ার জিনও রয়েছে। আবার অনিয়ন্ত্রিত ব্লাড সুগারের জন্য ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
ধূমপান ও যেকোনো তামাকজাত দ্রব্যের নেশা পুরোপুরি ছাড়তে হবে। অফিসে কাজের চাপ, মানসিক চাপ থেকে রিল্যাক্সড হতে অনেকে ধূমপান করেন। এই অভ্যাস অত্যন্ত খারাপ। ধূমপায়ীর মতো তার পাশের ব্যক্তিরও সিগারেটের ধোঁয়া থেকে ক্ষতি হয়।
হার্ট অ্যাটাকের পর জীবনধারা সম্পূর্ণ বদলে ফেলা জরুরি। ডাক্তারের পরামর্শমতো ওষুধ ও খাবার খেতে হবে। রোজ অল্প সময় ধীরে ধীরে হাঁটাহাঁটি করতে হবে। বাইরের খাবার, ধূমপান বাদ।
হার্ট অ্যাটাকের রোগীর পরবর্তীকালে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক ও হার্ট ফেইলইওরের আশঙ্কা থাকে। কারণ প্রথম অ্যাটাকের পর হার্ট যথেষ্ট দুর্বল হয়ে যায়। স্বাভাবিক ৬০-৬৫ শতাংশের পরিবর্তে হার্ট ৩০-৩৫ শতাংশ কাজ করে।
সূত্র : সংবাদ প্রতিদিন