মোগল আইনে বাংলার ভূমি ব্যবস্থাপনায় সাফল্য
সম্রাট আওরঙ্গজেব - ছবি : সংগৃহীত
আমাদের কত ভালোবাসার মাতৃভূমি এই সোনার বাংলা- বাংলাদেশ। এ দেশের স্বপ্নের রূপকল্পটি কেন সোনার সাথে তুলনীয় হলো? কেন আমরা ‘সোনার বাংলা’ বলি? এ জন্যই বলি যে, মাঠভরা সোনালি বর্ণের পাকা ধান তার প্রাণ প্রাচুর্যের পরিচয় দেয়। বাংলাদেশের প্রধান শস্য এ ধান প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই আমাদের সচ্ছলতার মানদণ্ড। তবে শস্য সম্ভারে পূর্ণ বিকশিত হয় এই দেশ তথা এই গাঙ্গেয়-সমতলভূমি তখন থেকেই, যখন থেকে শাসক এবং তার শাসনব্যবস্থার সাথে সমন্বিত হয় এ দেশের ভূমি মালিকানা, প্রজাস্বত্ব, কৃষি উৎপাদন তথা সমগ্র কৃষিব্যবস্থা। এই যে কথাটা, ‘কৃষিই আমাদের সেরা সংস্কৃতি’, কথাটা তো আর একদিনে লোকমুখে আসেনি। ইতিহাসে দেখা যায়, কৃষি নিয়ে যারাই যতটা বেশি ভেবেছে, ভূমি ব্যবস্থাপনা, রাজস্বনীতি, কৃষক-মহাজন সম্পর্ক, ফলন এবং বাজারের মধ্যে রাষ্ট্রের মেলবন্ধন, পরিপূরকতা, কৃষি ও কৃষকের কল্যাণ, বালাই ও আপদ থেকে সুরক্ষা, এগুলো যে শাসকরা যতটা দরদ দিয়ে প্রতিপালন করেছেন, তাদের শাসনকালেই এ দেশের ভাগ্যের চাকা তত জোরে ঘুরেছে। যারা এই দরদে যত ঘাটতি ফেলেছেন, তাদের আমলে দুর্ভিক্ষ-আকাল-মন্বন্তর তত বেশি প্রকট হয়েছে। দেশ শাসনের সাথে কৃষি ফলন, তথা রাজদণ্ডের সাথে কৃষকের ধান-মাপা মানদণ্ড বা নিক্তির সাথে কেন এভাবে তুলনার অন্তঃমিল খোঁজার চেষ্টা করছি, তার একটা কৈফিয়ত দিচ্ছি। সেটা হলো কিছু দিন আগে বাংলার এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় আকাল বা মন্বন্তরের ১৫০ বর্ষপূর্তি হয়ে গেল। খুব নীরবতার মধ্য দিয়েই সেই মহা-মন্বন্তরের দেড় শত বর্ষ পার হয়ে গেল!
ব্রিটিশ দুঃশাসন, লুটপাট এবং শোষণ ও চাটুকার তৈরির ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের’ মতো প্রজাপীড়নের ফলে প্রথমে উড়িষ্যায় ও তারপর বাংলায় ঘটে ছিল মহা-মন্বন্তর। ১৯৪৩ থেকে শুরু হয়ে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত বাংলার দুর্ভিক্ষে ৩৮ থেকে ৪০ লাখ বঙ্গবাসী স্রেফ অনাহারে কঙ্কালসার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। খাদ্যাভাবে জীর্ণ দেহে হানা দেয়া বসন্ত, ওলাওঠা, কলেরা, ম্যালেরিয়া ও কালাজ্বরে আরো কত লাখ মানুষ যে নীরবে মৃত্যু পথযাত্রী হয়েছে, নামেমাত্র একটা ‘ফেমিন কমিশন’ গঠন করা ছাড়া ব্রিটিশরা তার কোনো খোঁজ করেছে বলে ইতিহাসে পাওয়া যায় না। গোরস্তান উপচে পড়ত তখন; শ্মশানের চিতার আগুন নিভতেই পারত না। দাফন-সৎকারের মতো মানুষও পাওয়া যেত না। বেঘোরে মারা যাওয়া মানুষকে মাটি চাপা দিয়েই শেষকৃত্য করতে হতো। মানুষ জমি-ঘর, পুকুর, লাঙ্গল, থালা-বাটি বেচেও এক মুঠো অন্নের সংস্থান করতে পারেনি। বাংলাকে যখন ইংরেজ কোম্পানি দখল করেছিল বাংলা তখনো ছিল সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলার সচ্ছল দেশ আর মহাযুদ্ধের পর যখন এ দেশ থেকে তারা তাঁবু গুটাতে বাধ্য হলো, তখন এটাকে রেখে গেল ‘দুর্ভিক্ষের বধ্যভূমি’ হিসেবে। তবুও ব্রিটিশ পূজারী কলকাতার বাবু সমাজ এই শাসকদের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করেনি। বরং বাংলার উচ্চবর্ণ বাবু সমাজ তখন জাঠ আর মারাঠাদের সাথে জোট বেঁধে, কেবিনেট মিশন প্রস্তাবকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, বড়লাট লর্ড ওয়াভেলকে অপমানজনকভাবে দেশছাড়া করে, তার জায়গায় বার্মা ফ্রন্ট থেকে তরুণ যুবরাজ ও কংগ্রেসের বন্ধু মাউন্টব্যাটেনকে এনে পাঞ্জাব এবং বাংলা প্রদেশকে ভেঙে ভারত-বিভাগের স্বপ্নে বিভোর। দেশে যে এই এতবড় একটা আকাল গজব হিসেবে নেমে আসে সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করার সময়ই ছিল না ব্রিটিশ কালেক্টর ও তাদের পরম মিত্র শ্রেণীর। নেতাজী সুভাষ বসু বা তার সুযোগ্য ভাই শরৎ বসুর মতো বিবেকসম্পন্ন কিছু মানুষের ব্যতিক্রম ছাড়া পূর্ব বাংলার কৃষক প্রজাদের হয়ে আজীবন সংগ্রামী ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, জিন্নাহ-লিয়াকত আলী-ফজলুল হক বা শেরে বাংলা সেদিন বাবু সমাজের তেমন কাউকেই সাথে পেলেন না। অথচ বাংলা বিভাজনের পরিকল্পনা না ছিল জিন্নাহর আর না ছিল মুসলিম লীগের কোনো দলীয় সিদ্ধান্ত। জিন্নাহ ব্রিটিশ কেবিনেট মিশন পরিকল্পনার অনুরূপ বাস্তবতায় সমগ্র অখণ্ড বাংলা ও অখণ্ড পাঞ্জাব দাবি করেছিলেন; আর বলেছিলেন হবু কনফেডারেশনের নিজ নিজ প্রাদেশিক আইনসভার গরিষ্ঠসংখ্যক সদস্য যে ইউনিয়নে যেতে চাইবেন, যেতে পারবেন। কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত পাঞ্জাব ও বাংলাকে ভাগ করে ভারতে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামরিক ভারসাম্য ভেঙে এক মহাশক্তিধর ‘কংগ্রেসী উপমহাদেশ’ বানিয়ে রেখে গেল।
ব্রিটিশরা এ দেশের বন্দরে তাদের লুটের জাহাজ নোঙর করার দিন থেকে শুরু করে এ দেশ ছাড়ার আগ পর্যন্ত সাধারণ কৃষক-প্রজাদের শুধু একের পর এক সর্বনাশই করে গেছে। সর্বশেষ, করল কংগ্রেসী-উপমহাদেশ এবং শস্যহানি ও দুর্ভিক্ষকে করে রেখে গেল স্থায়ী। তারা তো মহামতি মোগলদের মতো কৃষক বা কৃষির মঙ্গলের কথা ভাবেননি, ভেবেছে কর খাজনা কিভাবে বাড়ানো যায় এবং কত কঠিনভাবে তা আদায় করা যায়। ভারতের খেয়ে, ভারতের পরে তারা গেছেন মগের মুল্লুকে (বার্মায়) যুদ্ধ করতে। তিন তিনটি অ্যাংলো-বার্মিজ যুদ্ধ হয়েছে এবং শেষ যুদ্ধের পুরো ধকলটি টানতে হয়েছে বাংলার অসহায় হতভাগ্য গরিব প্রজাদেরকে। শেষ পর্যন্ত না খেয়ে, ব্যারামে ভুগে তাদের লাশ হতে হয়েছে লাখে লাখে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে নিয়মিত, মিলিশিয়া এবং ভাড়াটিয়া সৈন্যদের খাওয়াতে গিয়ে তারা হাজার হাজার টন খাদ্যশস্য জাহাজে তোলে এবং দেশের মধ্যে খাদ্যশস্যের ‘সাপ্লাই-চেইন’ ভেঙে ভেলায় ‘ভ্যালু চেইনের’ উপর তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া অনিবার্য হয়ে ওঠে। ফলে ১ আনা সেরের চাল রাতারাতি ১ টাকা সেরে পৌঁছে যায়। মানুষ তখন বেতনই পেতেন ২০-২৫ টাকা; ব্যবসায়ীদেরও আয় ছিল নগণ্য। ফলে মহাযুদ্ধ-পরবর্তী সরকারি খাদ্য অব্যবস্থাপনা এবং মজুদদার, মুনাফাখোরদের কারসাজিতে খাদ্যশস্যের দাম হয়ে ওঠে আকাশ ছোঁয়া। সেই সাথে খাদ্যশস্যের সরবরাহ বিপর্যয়। ফলে অবধারিত হয়ে পড়ে দুর্ভিক্ষ-আকাল। পূর্ব বাংলার শুধু বিক্রমপুর বা মুন্সীগঞ্জ জেলারই তিন-চতুর্থাংশ মানুষ ওই দুর্ভিক্ষে মারা যান যেমনটি ঘটেছিল এর মাত্র কয়েক বছর আগে উড়িষ্যা রাজ্যে।
সুলতানী আমলে, বিশেষ করে মোগল আমলে বাংলার মতো এই রাজ্যটিও ছিল শস্যপূর্ণ। এই উপমহাদেশকে সুসমন্বিত রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় এনে, কৃষি বিপ্লব তথা ভূমিস্বত্ব, খাজনা ও কৃষিকে সবল করার সুলতানী যুগের যে ধারার আরো কাঠামোগত রূপ মহামতি মোগল বাদশাহীর যুগে দেয়া হয়, তারই ফলে এ দেশে সত্যিকারের স্বনির্ভরতা আসে, সচ্ছলতা ও পরিপূর্ণতায় জনজীবনে সুখের বসত নিশ্চিত হয় এবং সেই ব্যবস্থাপনা ছিল সম্পূর্ণ উদারনৈতিক, ধর্মনিরপেক্ষ এবং শান্তিপূর্ণ। রাশিরা, চীন, মধ্য আমেরিকার লাতিন দেশগুলো এমনকি ইউরোপেও যেখানে ভূমিস্বত্ব নিরূপণ, রাষ্ট্র ও ভূমির সম্পর্ক, বর্গা-ইজারা ব্যবস্থাপনায় রক্তপাত ঘটেছিল, মোগল আমলে সেখানে প্রজারা স্বেচ্ছায় কৃষিতে রাষ্ট্রে সমন্বয়কে মোবারকবাদ জানিয়ে নতুন পত্তনি ব্যবস্থা দ্বারা বংশপরম্পরায় জমির মালিকানা ভোগ করেছেন। মোগলদের তৈরি করা ভূমি ব্যবস্থাপনার সেই উত্তরাধিকার আমরা দলিলের ভাষায় ও রাজস্ব সাহিত্যে আজও ভোগ করছি। তবে উৎপাদনে রাজশক্তির সম্পৃক্তি প্রত্যাহার করা ব্রিটিশ রাজস্ব-সর্বস্ব শোষণের সেই ধারা চলমান রয়েছে। শস্যসম্পূর্ণা উপমহাদেশজুড়ে তাই গত ১০০ বছর ধরেই চলছে নিদান-দুর্ভিক্ষ ও কৃষকের বর্ণনাতীত দুর্ভোগ। অথচ আমাদের দেশের ঔপনিবেশিক আমলের রাজনীতির প্রধান উপলক্ষই ছিল কৃষি ও কৃষকের স্বার্থরক্ষা। পৃথিবীর কোথাও যখন জমিতে প্রজার হক প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তখন এই বাংলাতেই কার্যকর হয়েছে প্রজাস্বত্ব আইন আর মুসলিম লীগ শত বছর ধরে লড়েছে ঋণ সালিসি বন্দোবস্ত নিয়ে। শেরেবাংলা দলের নামই রাখলেন ‘কৃষক প্রজা পার্টি।’
‘কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে।’ সেই দর্শনকেই রূপ দিয়েছিলেন সমরশাসক এরশাদ (৬৪ হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে)। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়া কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে ভূপৃষ্ঠের পানি কাজে লাগাবার সুদূর প্রসারী লক্ষ্যে ‘খাল কাটা আন্দোলন-এর সূচনা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু মুজিব দেশের স্বাধীনতার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা এই কৃষির উপর ভিত্তি করেই। বাংলাদেশের স্বর্ণআঁশ (পাট) তার স্বপ্নের আর্থসামাজিক ভিত্তি গড়ে তুলেছিল। আজও আমরা দেখছি, দেশের যে প্রধান তিনটি চালিকাশক্তি তার অন্যতম প্রধানটিই হলো কৃষি; বাকি দু’টি হচ্ছে পোশাক রফতানি এবং বিদেশ থেকে কষ্টার্জিত উপার্জন (রেমিট্যান্স)।
কৃষিকে সবল করলে কৃষক সফল হবেন এবং কৃষিনির্ভর সামন্ততান্ত্রিক (ক্ষয়িষ্ণু) অর্থনীতিতে কৃষকের শক্তি মানেই জাতীয় অর্থনীতির মজবুত ভিত্তি। এই যে দর্শন, এটা আমাদের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারই বটে। আমাদের দেশে বা সেই অর্থে দক্ষিণ এশিয়ার দুর্ভিক্ষ হওয়ারই কথা নয়; রাষ্ট্র যদি ব্রিটিশদের মতো কৃষিকে উপেক্ষা না করে বা উৎপাদনে উৎসাহ না দিয়ে শুধু বেনিয়ার মতো কর খাজনা আদায় করতেই ব্যস্ত থাকে না। কৃষিকর লাঘব করে ওসমানিয়া সুলতানাতের আমলে তুরস্কে ঘটেছিল ব্যাপক উন্নতি এবং তারই প্রতিফলন ঘটে মোগল ভারতে। পর্যটক বার্নিয়ার এবং এ যুগের উপমহাদেশের গবেষক ড. ইরফান হাবিব দেখিয়েছেন, কিভাবে প্রজাকল্যাণের নীতি দ্বারা মুসলমান শাসকরা ১৪ শ’ শতক থেকে ১৬শ’ শতক পর্যন্ত ধান, গম, ভুট্টা, যব, রাই, সরিষা, তুলা (কার্পাস) ও মৌসুমি রবিশস্য আবাদে বিশ্বের বিস্ময়কর নজির স্থাপন করেছিল।
আবুল ফজল তার ‘আইন-ই-আকবরি’ বইতে লিখে গেছেন, সে যুগে কার্যত বাস্তবেই ছিল ‘লাঙ্গল যার জমি তার’ এই সুনীতি। ব্রিটিশদের নির্যাতনমূলক রাজস্ব নীতি, বিশেষ করে কুখ্যাত ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে’ এ দেশের কৃষক পথে বসে এবং বেনিয়া মুৎসুদ্দিরা নিলামের জমি পানির দামে কিনে নিয়ে নতুন জমিদার সেজে বসেন। তাদের হাতে ছিল নগদ টাকা। অথচ গৃহস্থদের কাছে ছিল জমি ও শস্য। ব্রিটিশরা ফসল দিয়ে রাজকর পরিশোধের হাজার বছরের নীতি পাল্টিয়ে নগদ অর্থে কর শোধের বন্দোবস্ত করায় অবস্থাপন্ন কৃষকরাও ভূমিহীন মিসকিন হয়ে পড়েন এবং নতুন বেনিয়া মুৎসুদ্দিরা জমির মালিক হয়ে যান। রিকার্ডোর খাজনাতত্ত্ব বিধি অবিষ্কারের অন্তত অর্ধ সহস্র বছর আগেই ভারতে আবাদ অনুযায়ী ভূমি করের চমৎকার ও বাস্তব বিধান চালু ছিল। যে নতুন চতুর মাড়োয়ারি ও বাঙালি উচ্চবর্ণ বাবু শ্রেণী সমাজের নতুন হর্তাকর্তা হয়ে ওঠেন তাদেরকে ঘিরে সমাজের চিহ্নিত শোষক ঠগ ও মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীদের একটি অপবিত্র সংঘ (Unholy Alliance) গড়ে ওঠে, যার মধ্যে ছিল রাজানুগত আমিল (আমলা), নায়েব, বেনিয়া, দাদনদার কুসিদজীবী, গোমস্তা, পাইকার, রাখিদার এবং স্বর্ণকার (Shroff)। এই স্বর্ণকারও এখনকার মতো অলঙ্কার তৈরি করা ‘ছ্যাকরা’ ছিলেন না। তারা রাজশক্তির কাছ থেকে ধাতব ঢালাই (Mint) এবং মোহর ছাপ দেয়ার এখতিয়ার নিয়ে এসে টাকশাল খুলে বসতেন। লোকে আস্ত স্বর্ণপিণ্ড, রূপা, তামা, দস্তা এমনকি নিকেলের পাত নিয়ে এলে তারা ছাঁচে মুদ্রা ঢালাই বা পাত করে দিতেন এবং ধাতব মুদ্রার রাজ-চিহ্ন খোদাই, ধাতুছাপ বা ‘এমবোস’ করে দিতেন।
এই নব্য সুবিধাখোর, হারামখোর কুসিদজীবী চক্র ব্রিটিশ জবরদখলকে কায়েমি করে রাখে। এই চক্রের প্রতিভূ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের হাতে তাই ভারতকে তুলে দেয়ার জন্য ব্রিটিশ কেবিনেট মিশনের প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে নাকচ করে তারা ভারতের প্রধান দুই শস্যভাণ্ডার পাঞ্জাব ও বাংলাকে ভাগ করে কার্যত গোটা ভারতকেই রেখে দেয় ভারতের হাওলায় আর ‘কীটদুষ্ট, পোকায় খাওয়া’ অনগ্রসর ভূখণ্ড দেয় তদানীন্তন পাকিস্তানকে। সে পাকিস্তানেও যেটুকু সম্পদ ও সম্ভাবনা ছিল, তাও অকার্যকর হয়ে যায় লাগাতার জঙ্গি শাসন এবং চাপিয়ে দেয়া একের পর এক যুদ্ধে। পূর্ব বাংলা, সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান, সিন্ধু ও খণ্ড-বিখণ্ড কাশ্মির আজাদীর সুফল থেকে বঞ্চিত হয়। পাঞ্জাব রাজ্যটিই শুধু লাভবান হয়েছে। পাঞ্জাবে তাই কখনো দুর্ভিক্ষ হানা দেয়নি, যা দিয়েছে পূর্ব বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ও আসামে।
অথচ এই পূর্ব বাংলা এবং আসাম উপত্যকাই ছিল হাজার বছরের শস্যভাণ্ডার। বাংলার দুর্ভিক্ষ নিতান্তই ব্রিটিশ দুঃশাসন, অব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে শেষের দিকে, উইনস্টন চার্চিলের ভারত-বিদ্বেষী এবং যুদ্ধনীতির কারণে। তাই আজ যেমন খোদ নিজ শহরেই ক্লাইভের বিশাল প্রস্তর মূর্তিটি অপসারণের দাবি উঠেছে; একই দাবি উঠেছে বাংলায় ইতিহাসের মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের মরণোত্তর বিচারের, অন্তত ন্যায্য বিচারের জন্য ইতিহাসের নিরপেক্ষ পুনর্মূল্যায়নের। ব্রিটিশদের যত দোষই থাক, ইতিহাসের ঋণ পরিশোধে তারা খুব একটা কার্পণ্য করেন না। এর দৃষ্টান্ত হলো, মহারাজা নন্দকুমারের ফাঁসির বিচারে খোদ বড়লাট ওয়ারেন হোস্টিংসকে ইংল্যান্ডে ফেরৎ নিয়ে বিচার করে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল। ইতিহাসের দাবি তেমনি ক্লাইভের মূর্তি অপসারণ এবং গণহত্যার মতো অপরাধে চার্চিলের মরণোত্তর বিচারের।