চীন-পাকিস্তান-ইরান : ত্রিশক্তি জোট কেন
চীন-পাকিস্তান-ইরান - ছবি সংগৃহীত
চীন-পাকিস্তান-ইরান। তিন দেশ। ত্রিশক্তি ভৌগোলিকভাবে, ভূরাজনৈতিকভাবে ও কৌশলগতভাবে বিশ্বের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান করছে। তিন দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য রয়েছে। সামুদ্রিক পথ, আন্তঃদেশীয় সমস্যার মধ্যে মিল রয়েছে। এখন জরুরি ভিত্তিতে স্থলপথে তিন দেশের সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠাও প্রায় শেষ পর্যায়ে। এখানকার কোনো সমস্যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনকে হঠাৎ উত্তপ্ত করে দেয়ার মতো। অনেক আঞ্চলিক সমস্যা চাইলে ত্রিশক্তি সমাধান করতে পারে। আফগান সমস্যায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সব পক্ষ জড়িত। সব দেশই আফগানিস্তানে শান্তি চায়। সব স্টেকহোল্ডার একত্র হয়ে কারা অশান্তির জন্য দায়ী চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। অশান্ত আফগানিস্তানের জন্য পাকিস্তান অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। চীন ও ইরানের নিরাপত্তাও আফগান ইস্যুর সাথে জড়িত। আফগান সমস্যা নিয়ে পাকিস্তান ও ইরান একই অবস্থানে ছিল না।
কেননা পাকিস্তান ছিল তালেবানের পক্ষে ইরান ছিল উত্তর অ্যালায়েন্সের পক্ষে। চীন আফগানিস্তানের সাথে জড়িত, কেননা চীন বেল্ট ও রোড প্রকল্পে আফগানিস্তানকে সংযুক্ত করতে চায়। আফগানিস্তানে শান্তি ও রাজনৈতিক স্থায়িত্ব না এলে প্রকল্পটি কার্যকরভাবে সমাপ্ত করা সম্ভব নয়। চীন মধ্য-এশিয়ায়ও বিআরআই প্রকল্প কার্যকর করতে চায়। এসব স্থানে অশান্তি অর্থনৈতিক দুর্গতি থাকলে চীনের এ প্রকল্প সফলতার মুখ দেখবে না। তাই আফগানিস্তানসহ পুরো মধ্য এশিয়ায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ব্যাপারে চীন আগ্রহী। আফগানিস্তান অশান্ত হলে জিনজিয়াঙেও সমস্যা বাড়াবে। এ জন্য চীন চায় তাড়াতাড়ি আফগান সমস্যা শেষ হয়ে শান্তি ফিরে আসুক। মধ্য এশিয়ায় পাকিস্তান এবং ইরান উভয়েই বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে চায়। তাই ত্রিশক্তির সম্মিলিত উন্নয়ন প্রচেষ্টা আঞ্চলিক উন্নয়নের জন্য বড় নিয়ামক হতে পাারে। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতির ১৮ বছরেও শান্তি আসেনি। যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তে ত্রিশক্তি কাজে নামতে পারে। এই প্রচেষ্টাতেও পাকিস্তান বড় ভূমিকা রাখছে। যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান শান্তি আলোচনায় পাকিস্তান মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পাকিস্তানের প্রশংসা করে বলেছেন, ‘ভারতের এখানে কোনো কাজ নেই।’ যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তানে অবস্থান এবং ভারতের সাথে সম্পর্ক আফগান পরিস্থিতিকে আরো অস্থির করে তুলেছে। এ জন্য ত্রিশক্তির প্রত্যেকটি দেশের স্বার্থহানি হয়েছে। এই অবস্থায় ত্রিশক্তি জোট গঠনে এগিয়ে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান শান্তি আলোচনায় পাকিস্তান মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। পাকিস্তান-রাশিয়া সাম্প্র্রতিক সামরিক মহড়া এতদঅঞ্চলে আবারও রাশিয়ার ফিরে আসা ও উন্নয়নে অংশীদারিত্ব করার বিষয়টি মনে করিয়ে দেয়। ভারত নিজ স্বার্থের জন্য চেয়েছে আমেরিকার সেনা আফগানিস্তানে আরো সময়ের জন্য থাকুক। কেননা চীন ও পাকিস্তান কাশ্মির ও লাদাখ নিয়ে কোনো আগ্রাসন চালালে এই সেনা দল হয়তো কাজে আসতে পারে। ট্রাম্পের ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়া আঞ্চলিক কৌশলের জন্য সুখকর নয় বলে মনে করে এই ত্রিশক্তি। ভারত আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসাবে নিজকে জাহির করতে চায়।
ভারত-চীন বিরোধে বহিঃশক্তি ইচ্ছা করেই যুক্ত হতে চায়। একইভাবে কাশ্মির নিয়েও ভারত-পাকিস্তান বিরোধে বহিঃশক্তি এগিয়ে আসতে চায়। এই রকম উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে বেইজিংকে দুর্বল করার কিছু নিয়ামক ওয়াশিংটনের রয়েছে। ২০০৫ সালের ‘যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বেসামরিক পরমাণু চুক্তি’ এবং পরবর্তী রাজনৈতিক অগ্রগতি প্রমাণ করে যে ইরান-পাকিস্তান-চীনের সব সমস্যা মিটিয়ে ফেলা একেবারে সহজ নয়। যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল অক্ষ ভারতকে অ্যাডভান্স ডিফেন্স সিস্টেম দিয়েছে। মনে করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র কোনো ‘বেনিফিট’ না পাওয়া পর্যন্ত পাকিস্তান বা চীনের সাথে কোনো যুদ্ধে ভারতকে সমর্থন দেবে না। যুদ্ধের যে কোনো অভিযানে যুক্তরাষ্ট্র চাইবে চীন যেন দুর্বল হয়ে পড়ে বা কোনো অঙ্গহানি ঘটে।
যুক্তরাষ্ট্র-ভারত ফ্রন্ট চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের জন্য থ্রেট হিসাবে কাজ করছে। তাই ত্রিশক্তির বলয় যেন আবশ্যিক হয়ে পড়েছে। ভারতের সাথে চীনের সমঝোতা ও বন্ধুত্ব থাকলেও ‘ঢিমেতেতলা ও গড়িমসি’ চালের জন্য ভারত-চীন বন্ধুত্বে খরা দেখা দিয়েছে। পাকিস্তান চীন বন্ধুত্ব মজবুত। এখন ইরান যুক্ত হয়ে পাল্লা ভারী হলো। ইরানের অনেক ঝুঁকি রয়েছে। ওবামা থেকে শুরু হয়ে ট্রাম্প পর্যন্ত অবরোধের স্রোত প্রবাহিত হয়েছে ইরানের বিরুদ্ধে। ইরানবিরোধী শক্তি মুজাহেদিন খালককে ইরানের বিরেুদ্ধে কাজ করার জন্য লেলিয়ে দেয়া হয়েছে। একটি যুদ্ধাবস্থার মধ্যে ইরান সময় অতিবাহিত করছে এবং ইসরাইল ইরানের সাথে একটি যুদ্ধ পরিচালনা করছে। বাইডেনের আমলে পরমাণু আলোচনা আবার শুরু হলেও রাতারাতি ইরানবিরোধী কার্যক্রম বন্ধ হবে এমন কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে ঘায়েল করার জন্য ইসরাইল ও ভারতকে ব্যবহার করতে চায়। ভারত-চীন অনেক চুক্তি রয়েছে যেগুলো শুধু ‘পেপার ওয়ার্ক’। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ইরান-পাকিস্তান-ভারত গ্যাস লাইন প্রকল্প মুখথুবড়ে পড়েছে। ত্রিশক্তি লক্ষ করেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া পলিসি সবসময় ভারতের স্বার্থ রক্ষা করেছে; ফলে আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তা ব্যাহত হয়েছে এবং শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তিত হয়েছে। এতদঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় খবর পাওয়া যাচ্ছে যে, আরো একটি জোট তৈরি হচ্ছে যেখানে এই ত্রিশক্তি ছাড়াও রাশিয়া ও তুরস্ক যুক্ত হচ্ছে। রাশিয়ার ডিফেন্স অ্যানালিস্ট মাইকেল বরিস পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পলিসির কারণে রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্ক নিয়ে এই জোট হচ্ছে এবং ভারতকে বাইরে রাখা হচ্ছ।’ ভারতের সাথে কোনো পড়শির সুসম্পর্ক নেই। বরিস আরো জানান, মূলত মোদির রেসিস্ট পলিসি এই জোট গঠনের পিছনে কাজ করেছে।