তুরস্ক-সৌদি আরব-কাতার সমীকরণ
তুরস্ক-সৌদি আরব-কাতার সমীকরণ - ছবি সংগৃহীত
সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যার পর তুরস্ক ও সৌদি আরবের সম্পর্কে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে। উভয় প্রশাসন তুর্কি-সৌদি সম্পর্কের অবনতি থেকে উপকৃত অন্য আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের বিবেচনায় নিয়ে এ বিষয়টি নতুনভাবে বিবেচনা করতে পারে। এর আগে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যকার জোট ইরানের বিরুদ্ধে তেমন কার্যকর প্রমাণিত হয়নি। ফলে বিরোধপূর্ণ দলগুলোর মধ্যে তুরস্কের মধ্যস্থতার প্রয়োজন হতে পারে।
তুর্কি-সৌদি সম্পর্কের অবনতির পেছনের কারণগুলো খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য দুই দেশের মধ্যে যে সাম্প্রতিক সম্পর্ক প্রয়োজন, তার গুরুত্ব সহজেই অনুভব করা যায়। তুরস্ক ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্ভাব্য অনুকূল সম্পর্ক তুরস্ক ও মিসরের সম্পর্ককেও ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এটি হলে তা সুন্নি আফ্রিকায় একটি নতুন জোট তৈরি করতে পারে।
তুরস্ক ও সৌদি আরবের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুত তাদের সম্পর্কের উন্নতির উদ্যোগ নেবেন বলে মনে হয় দুই দেশের নেতৃবৃন্দের সাম্প্রতিক আলোচনায়। এর মধ্যে নভেম্বরের প্রথম দিকে ফোনে কথা বলার পরে তুর্কি প্রেসিডেন্টের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট এরদোগান এবং বাদশাহ সালমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নত করতে এবং বিবাদের ইস্যুগুলোতে সমঝোতায় পৌঁছতে সংলাপের চ্যানেলগুলো উন্মুক্ত রাখতে সম্মত হয়েছেন।
দুই নেতার কথোপকথনের পরে তুরস্ক ও সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীরও একই রকম উষ্ণ বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে। তারা নাইজারে ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সম্মেলনের সময় সাইডলাইনে বৈঠক করেছেন। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু টুইট করে বলেছেন, ‘তুরস্ক-সৌদি আরবের একটি শক্তিশালী অংশীদারিত্ব কেবল আমাদের দেশগুলোর জন্য নয়, পুরো অঞ্চলের জন্য উপকারী হবে।’ একই ধরনের আশাবাদ সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যেও উচ্চারিত হয়েছে।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ও বাস্তবতা বিবেচনা করেই তুরস্ক ও কাতারের সাথে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার পথেই এগুতে চাইছেন সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ। এক্ষেত্রে শর্ত থাকতে পারে- সৌদি আরবে সৌদ রাজপরিবারের শাসনবিরোধী কোনো তৎপরতায় যুক্ত থাকতে পারবে না মুসলিম ব্রাদারহুড। আর ব্রাদারহুডের ব্যাপারে যে দমন-পীড়ন চলছে, সেটি থাকবে না। কাতারের আল জাজিরা টেলিভিশন রাজতন্ত্রবিরোধী কোনো প্রচারণার অংশ হবে না। সিরিয়ার শান্তি ও সমঝোতার ব্যাপারে সৌদি আরব, কাতার ও তুরস্ক অভিন্ন ভূমিকা রাখবে। আঙ্কারায় ক্ষমতা পরিবর্তনের ব্যাপারে কোনো প্রচেষ্টায় সৌদি আরব অংশ হবে না। ইয়েমেনের যুদ্ধের অবসানের ব্যাপারে তুরস্ক প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করবে। এ ধরনের একটি সমঝোতার পৌঁছানোর ক্ষেত্রে যে, নেতৃস্থানীয় মুসলিম দেশগুলো সক্রিয় রয়েছে সেটি বোঝা যায় নাইজারে সাম্প্রতিক ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে।
ওই সম্মেলনের ঘোষিত অ্যাজেন্ডায় যেখানে কাশ্মির ইস্যুর কোনো উল্লেখই ছিল না, সেখানে কাশ্মিরের ব্যাপারে অত্যন্ত জোরালো প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। একই সাথে, এই সংস্থাটিকে কার্যকর করার ব্যাপারেও কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। নেতৃস্থানীয় মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সঙ্ঘাতকে সমঝোতায় রূপান্তরের প্রচেষ্টা এবং ইসরাইলের দানবীয় দাপটে হঠাৎ করে কিছুটা নমনীয়তা আসা মুসলিম বিশ্বের জন্য সুসংবাদই বয়ে আনবে বলে মনে হচ্ছে।
আশির দশকের শেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে স্নায়ুযুদ্ধের যে অবসান ঘটেছিল, তাতে মুসলিম দেশগুলোর অনেক বিশ্লেষককে উল্লসিত হতে দেখা গিয়েছিল। এর পথ ধরে মধ্য এশিয়ার বেশ কয়েকটি মুসলিম প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতা লাভের ইতিবাচক ঘটনাও ঘটেছিল। কিন্তু মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য শক্তির সামনে কমিউনিস্ট প্রতিপক্ষ হারিয়ে যাওয়ার কারণেই আদর্শিক প্রতিপক্ষ হিসেবে ইসলামকে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। এর ফলে তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন ও লিবিয়া এক প্রকার ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। মুসলিম দেশগুলোতে অনেক প্রাকৃতিক সম্পদে আধিপত্যবাদী শক্তির কর্তৃত্ব নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হয়।
এখন নতুন এক স্নায়ুযুদ্ধের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এই স্নায়ুযুদ্ধের পরস্পর প্রধান প্রতিপক্ষ সম্ভবত হতে যাচ্ছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। করোনাভাইরাস সংক্রমণকে কেন্দ্র করে চাঙ্গা হওয়া এই স্নায়ুযুদ্ধে জীবাণুঅস্ত্রের ব্যাপক প্রয়োগের শঙ্কা মানবজাতির জন্য বিপর্যয়ের অশনি সঙ্কেতও নিয়ে এসেছে। তবে এর মধ্যে দিয়ে নতুন শক্তির অভ্যুত্থানের সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধের দুই পক্ষের সামনে মুসলিম দেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। আর এ সময়ে মুসলিম ঐক্য ও প্রাতিষ্ঠানিক সমঝোতা বজায় রাখতে পারলে মুসলিম দেশগুলোর মধ্য থেকেই মহাশক্তির অভ্যুদয় ঘটতে পারে। তুরস্ক-সৌদি সমঝোতা এ ক্ষেত্রে হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।
mrkmmb@gmail.com