তুরস্ক-সৌদি আরব সমীকরণ
এরদোগান ও সালমান - ছবি সংগৃহীত
সৌদি আরবের বাইরে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে ইসরাইল, তুরস্ক ও ইরান। ইরানের সাথে বোঝাপড়ায় সৌদি প্রচেষ্টায় কার্যত কোনো ফল আসেনি। ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মানে হলো, এই ইহুদি রাষ্ট্রের অধীনতা মেনে নেয়া যাতে সৌদি জনগণ, ধর্মীয় এস্টাবলিশমেন্ট ও শাসন কাঠামোকে সম্মত করা যায়নি এখনো। এর বাইরে রয়েছে তুরস্ক। দেশটি ‘আরব বসন্ত’ ইস্যুতে গণতন্ত্রকামীদের সমর্থন দেয়ার পর থেকে দু’দেশের সম্পর্কে এক প্রকার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। আর তুরস্ক আঞ্চলিকভাবে নির্ধারক শক্তি হওয়া মানে, মুসলিম ব্রাদারহুড শক্তিশালী হওয়া। সৌদি আরবের জন্য যেকোনো আঞ্চলিক সমীকরণে এই বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
গত পাঁচ বছরে তুরস্কের ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একে পার্টি) সরকার এক ধরনের অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে সময় পার করেছে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তুরস্ককে ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি এবং একটি বিকাশমান গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য এই অঞ্চলের ‘জ্বল জ্বলে নক্ষত্র’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল। এ সময় ধারাবাহিক সঙ্কট মোকাবেলায়, সে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব একটি স্বতন্ত্র বিদেশ নীতি গ্রহণের মাধ্যমে নিজস্ব জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে অনুসৃত তুরস্কের বহুপাক্ষিক বৈদেশিক নীতি কিছু ক্ষেত্রে পশ্চিমা মিত্রদের জন্য সমস্যাও সৃষ্টি করে।
পশ্চিমা শক্তিগুলো স্নায়ুযুদ্ধ- পরবর্তী সময়ে শক্তির নতুন ভারসাম্যের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করতে অসুবিধা হয়; যদিও এসব শক্তি রাজনৈতিক, বিচারিক ও সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে একে পার্টি সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টার সাথেও যুক্ত হয়েছে। এসব চেষ্টার পরও প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান এখনো ব্যাপক নির্বাচনী সমর্থন নিয়ে তুরস্কের রাজনৈতিক ক্ষমতায় রয়েছেন।
তুরস্ক সাম্প্রতিক অস্থির সময়ে তিনটি বৈরী সংগঠনকে মোকাবেলায় সফল হয়েছে। ২০১৬ সালের ১৫ জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের ব্যর্থতার পরে রাষ্ট্রীয় কাঠামো থেকে ‘গুলেনিস্ট গ্রুপ’ সংশ্লিষ্টদের বিদায় করা হয়েছে। তার দক্ষিণ-পূর্ব সীমানাজুড়ে প্রাকৃতিক সামরিক উপস্থিতি তৈরি করে সিরিয়া ও ইরাক, কুর্দিদের দু’দেশে পিকেকে পার্টিকে পরাজিত করেছে। তুরস্ক প্রথম দেশ যে সরাসরি আইএসকে লড়াই করে পরাজিত করে। আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে তুরস্কের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি সিরিয়া, লিবিয়া ও আজারবাইজানের সামরিক এবং রাজনৈতিক সাফল্য দিয়ে সুসংহত হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ওবামা প্রশাসন ইরানকে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল। তেহরান এর সুযোগে এই অঞ্চলে একটি প্রভাববলয় গঠনের চেষ্টা করে। এই সময়ে, তুরস্ক ইরানি সম্প্রসারণ হুমকির বিরুদ্ধে সৌদি আরবকে সমর্থন করেছিল। এদিকে, আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদ (এমবিজেড) ‘পাওয়ার ব্রোকার’ হিসেবে আগত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জামাতা ও উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনারের সাথে মিলে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতির ওপর আধিপত্য বিস্তার শুরু করে দেন। এটি উপসাগরীয় দেশগুলো বিশেষ করে সৌদি রাজনীতির জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দেয়। কারণ সৌদি জনগণ ফিলিস্তিনের পক্ষে দীর্ঘকাল ধরে জোরালো সমর্থন জানিয়ে আসছিল।
শক্ত ক্ষমতার মাধ্যমে আঞ্চলিক রাজনৈতিক প্রভাব অর্জনের পরে, তুরস্ক এখন কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক উপায়ে তার আঞ্চলিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। এই অর্থে, তুরস্ক এবং সৌদি আরবের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কোন্নয়নের শক্তিশালী সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এটি স্পষ্ট, দু’দেশের মধ্যকার সাম্প্রতিক উত্তেজনা অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে উভয় দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তুরস্কের পণ্য রফতানি করার জন্য শক্তিশালী বাজারের প্রয়োজন থাকলেও সৌদি নাগরিকরা তুরস্কে বিনিয়োগ করতে বা থাকতে চান।