করোনার টিকা নিয়ে তোলপাড় কেন
করোনার টিকা - ছবি সংগৃহীত
অবশেষে স্বস্তি! কোভিড-১৯ ভাইরাসের টিকা পাওয়া গেছে, এই ঘোষণায় গোটা বিশ্বে যেন খুশির হাওয়া। পোলিও টিকা তৈরি করতে সাত বছর লেগেছিল, চিকেন পক্স টিকা লেগেছিল ৩৪ বছর, আর ৩৬ বছর কেটে যাওয়ার পরও প্রস্তুত হয়নি এইচআইভির টিকা। এখনো তার কাজ চলছে। তুলনায় কোভিড-১৯-এর টিকা তৈরি করতে এক বছরেরও কম সময় লাগল!
আধুনিক টিকাপদ্ধতি শুরু করেছিলেন এডওয়ার্ড জেনার, ১৭৯৮ সালে। কিন্তু তার আগেও হাজার হাজার বছর ধরে এক ধরনের টিকার প্রচলন ছিল, যেখানে স্মল পক্স আক্রান্তদের গায়ের খোসা ঢুকিয়ে দেয়া হতো সুস্থদের দেহে, সুরক্ষার আশায়। অর্থাৎ, যে জৈব বস্তুটি রোগ ঘটায়, তাকে অসুস্থের দেহ থেকে সুস্থ দেহে প্রবেশ করালে রোগ এড়ানো যায়, এই ধারণা অনেক দিনই ছিল। জেনারের টিকা ভারতে আসে ১৮০২ সালে। তিন বছরের এক শিশু, অ্যানা ডাস্টহল, প্রথম সেই টিকা পায়। তার পর প্রায় ২০০ বছর ধরে আমরা নানা রোগের ভয়ানক মহামারি দেখেছি, যার সাম্প্রতিকতম হলো কোভিড-১৯। কিন্তু নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বিজ্ঞানের নানা মোড়-ঘোরানো আবিষ্কারের মাধ্যমে আমরা শিখেছি, কী করে আরো দ্রুত টিকা তৈরি করা যায়। আজ আমরা কয়েক মাসের মধ্যে এক সুবিশাল জনতাকে কোভিড-১৯’এর টিকা দেয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি।
যদিও স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রায় সব সময়েই টিকার চাইতে বেশি কার্যকর, তবু ভালো টিকা সত্যিই প্রাণ বাঁচায়। কোনো ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর টিকা তৈরি করা যায় কি না, তা নির্ভর করে ভাইরাসের গঠনের স্থিতিশীলতা, আর তার সংক্রমণ-ক্ষমতার উপরে। সাধারণত, যে ভাইরাস যত স্থিতিশীল (যার দ্রুত পরিবর্তন বা ‘মিউটেশন’ হয় না), সেটার মারণক্ষমতা ও সংক্রমণক্ষমতা তত বেশি হয়। টিকা তার বিরুদ্ধে কাজ করবে, সেই সম্ভাবনাও হয় বেশি। যেমন হামের ভাইরাস। যদিও তা খুবই সংক্রামক (এক জনের থেকে ৯ জনেও ছড়াতে পারে) এবং মারণক্ষমতাও বেশি, তবু হাম ভাইরাস বেশ স্থিতিশীল, তাই টিকাও খুবই কাজে দেয়। অন্য দিকে, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রামক ক্ষমতা কম (এক জনের থেকে সাধারণত আর এক জনেরই হয়), কিন্তু মিউটেশনের হার খুব বেশি। তাই টিকা তৈরি করা কঠিন, এবং সব সময়ে কার্যকরও হয় না। কোভিড-১৯ সৃষ্টিকারী ‘সার্স-কোভ-২’ ভাইরাস এই দুইয়ের মাঝামাঝি— হামের মতো অতটা স্থিতিশীল নয়, আবার ফ্লু-এর মতো পরিবর্তনশীলও নয় (সংক্রমণক্ষমতা এক জন থেকে তিন জন)।
২০১৯ সালে এই ভাইরাস আবিষ্কার হওয়ার পর এখন পর্যন্ত এর কেবল একটাই ‘মিউটেশন’-এর কথা জানা গিয়েছে, যা তার সংক্রমণক্ষমতাকে বদলে দিয়েছে। যদিও এমন কিছু মিউটেশনের কথাও জানা গিয়েছে, যা সংক্রমণক্ষমতায় বিশেষ রদবদল করে না। তাই ভাইরাস আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে আশা জেগেছিল যে, এর বিরুদ্ধে টিকা কার্যকর হবে। সাম্প্রতিক টিকাগুলো প্রত্যাশাকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রায় ২০০টি টিকা পরীক্ষা-নিরীক্ষার নানা ধাপে রয়েছে (কোনোটি ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা হচ্ছে, কোনোটি প্রাণিদেহে)। পনেরোটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রথম ধাপে রয়েছে (সুস্থ মানুষদের একটি ছোট দলের উপর পরীক্ষা হচ্ছে), আরো পনেরোটি রয়েছে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের দ্বিতীয় ধাপে (আরো বড় দলের মানুষদের উপর পরীক্ষা হচ্ছে, যার মধ্যে উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন ব্যক্তিরাও আছেন), আর দশটি রয়েছে তৃতীয় ধাপে (খুব বড় দলের উপর প্রয়োগ হচ্ছে, কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তা বোঝার জন্য)।
সম্প্রতি, এই তৃতীয় ধাপের তিনটি টিকাকে কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে অত্যন্ত কার্যকর বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এগুলো হলো ফাইজার-বায়োএনটেক টিকা, মডার্না টিকা এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ড টিকা। এই তিনটি টিকারই মূল কার্যপদ্ধতি এক— ভাইরাস যে স্পাইক প্রোটিনের মাধ্যমে শরীরের কোষে প্রবেশ করে, সেই স্পাইক প্রোটিনের একটি নিরীহ সংস্করণ যদি দেহে প্রবেশ করানো যায়, তা হলে দেহ ভাববে যে ভাইরাস ঢুকছে, এবং প্রচুর পরিমাণে তার প্রতিরোধক তৈরি করবে। প্রথম দু’টি টিকা একটি নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে, যা সার্স-কোভ-২’এর স্পাইক প্রোটিনের জেনেটিক কোড ‘মেসেঞ্জার আরএনএ’ নামে একটি রাসায়নিকের মাধ্যমে মানুষের দেহে ঢুকিয়ে দেয়।
এই দু’টি টিকার কার্যকারিতা ৯৫ শতাংশ, যা সব প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে গিয়েছে। তবে ফাইজার টিকাটি অত্যন্ত শীতল তাপমাত্রায় রাখতে হয় (মাইনাস ১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড), যা প্রান্তিক এলাকায় পৌঁছে দেয়ার পক্ষে অসুবিধাজনক। মডার্না টিকাটি অবশ্য মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে রাখা যায়।
দুটি টিকার ক্ষেত্রেই দুটি ডোজ দেয়া প্রয়োজন, ২৫-২৮ দিনের দূরত্বে। অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকাটি আর একটা কৌশল ব্যবহার করে। শিম্পাঞ্জিদের সর্দি-কাশি ঘটায়, এমন একটি নিরীহ ভাইরাস মানবদেহে ঢোকায়, যা তার পরে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের অনুকরণে প্রোটিন তৈরি করে। ফলে দেহ প্রস্তুত হয়ে থাকে আসল ভাইরাসকে প্রতিহত করতে। এই টিকা ৯০ শতাংশ কার্যকর। এরও দু’টি ডোজ দরকার হয়, তবে খানিকটা কাকতালীয়ভাবেই আবিষ্কার হয়েছে যে, প্রথম ডোজটি অর্ধেক পরিমাণে দিলে কাজ হয় বেশি। তাতে একটু বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে, তবে আশা করা যাচ্ছে যে, এটা ছাড়পত্র পেয়ে যাবে। সবচেয়ে জরুরি কথা, এটা ফ্রিজে রাখলেই (মাইনাস চার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) ভালো থাকে এবং এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সস্তা। তাই এই টিকার ব্যবহারই যে বিশ্বে হবে সবচেয়ে বেশি, বিশেষত দরিদ্র দেশগুলোতে, তা প্রায় নিশ্চিত।
এই ঘোষিত টিকাগুলো ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি টিকা ছাড়পত্র পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। তাই আগামী দিনে আরো টিকা আসবে আমাদের হাতে। টিকা ছাড়াও কোভিড প্রতিরোধ এবং নিরাময়ের জন্য অ্যান্টিবডি প্রভৃতি নানা জৈবপদার্থের ব্যবহার হতে পারে, সেই সম্ভাবনাগুলোও যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক। সেগুলো অবশ্য টিকার চাইতে বেশি দামি হতে পারে।
টিকা যখন হাতে এসে গেছে, তখন পরের প্রশ্ন, তার বিতরণ এবং টিকাকরণের বাস্তবিক প্রক্রিয়া। পশ্চিমের উন্নত দেশে শুধু নয়, দরিদ্র দেশেও তা প্রয়োজন। তবে বহু দরিদ্র দেশে এর আগেও মহামারি হয়েছে, তারা বহু মানুষকে একসঙ্গে টিকা দিতে অভ্যস্ত। তা হলেও প্রয়োজন হবে কেন্দ্রের সরকার ও স্থানীয় সরকারের কাজে সমন্বয়, বেশ কিছুটা ভর্তুকি, এবং ওষুধনির্মাতা সংস্থার সঙ্গে সংযোগ। সার্বিক প্রতিরোধক্ষমতা পেতে গেলে জনসংখ্যার অন্তত ৬০-৭০ শতাংশকে টিকা দিতে হবে, এবং রোগের বিস্তারও রোধ করতে হবে। সামান্য খরচে বা বিনা খরচে টিকা পাওয়া গেলেই ভালো।
যে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় কোভিড-১৯’এর টিকা নির্মাণ হলো, তা থেকে অন্যান্য সংক্রামক অসুখের বিরুদ্ধে লড়াইতেও অনেক কিছু শেখার রয়েছে। এক কোভিডের ২০০টি টিকা বা ওষুধ যেখানে এখন পরীক্ষাধীন, সেখানে অত্যন্ত সংক্রামক ৪১টি অসুখের মাত্র ২৫০টি মতো টিকা বা ওষুধ পরীক্ষাধীন। এর কারণ— কোভিড-১৯ পশ্চিমের দেশগুলোকে বিপর্যস্ত করেছে, কিন্তু এই ৪১টি সংক্রামক অসুখ প্রধানত দরিদ্র দেশগুলোকে বিপন্ন করে বেশি। তাই এগুলো নির্মূল করার জন্য যত টাকা, যত মনোযোগ দরকার, অত পায় না। যদি কোভিডের টিকা নির্মাণের মডেল অনুসরণ করা যায়, তবে এ বিশ্ব ধনী ও গরিব, উভয়ের জন্যই আরো একটু বাসযোগ্য হবে।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা