রাজমোহনের মিশন ইসরাইল
সি রাজামোহন - ছবি সংগৃহীত
সি রাজামোহন (সিলামকুরি রাজা মোহন) একজন ভারতীয় একাডেমিক, জার্নালিস্ট ও ফরেন পলিসি মেকার- এভাবেই তার পরিচিতি দেয়া আছে উইকিপিডিয়াতে। রাজামোহন ভারতের তেলেগুভাষী অন্ধ্র প্রদেশের বাসিন্দা। সেখানকারই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে মাস্টার্স। কিন্তু পরে দিল্লি জওয়াহের লাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় (জেএনইউ) থেকে ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্ক’ বিষয়ে মাস্টার্স ও পিএইচডি করেন। তার পিএইচডি গবেষণার বিষয় ছিল ‘স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ ও আর্মস কনট্রোল’। পরে জেএনইউ বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষকতায় প্রফেসর হন তিনি। কিন্তু ক্রমশ তিনি নজরে পড়েন এবং হয়ে পড়েন ভারতে ‘আমেরিকার বন্ধু’।
এতে পরবর্তী সময়ে ভারতে এমন কোনো আমেরিকান ফান্ডেড এনজিও বা থিংক ট্যাংক আর বাকি নাই যার পরিচালনার সাথে তিনি সংশ্লিষ্ট নন। এসবই চলতি শতকের প্রথম দশকের ঘটনা। যখন গ্লোবাল ইকোনমিতে চীনা উত্থান ক্রমশ বড় করে সবার চোখে পড়তে শুরু করেছিল। ফলে চায়না কনটেইনমেন্ট বা ‘চীন ঠেকানো’ এর জন্য কাজ করা আমেরিকান ফরেন পলিসির গুরুত্বপূর্ণ শুধু নয়, প্রায় প্রধান প্রোগ্রাম হয়ে উঠেছিল। তবে আমেরিকা নিজেরই নানান গবেষণা ও স্টাডি এবং সেসবের রিপোর্টে পরিষ্কার করেই নির্দেশ করছিল যে, চীনের উত্থান ও অর্থনীতিতে এর আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাওয়া ও নেতার আসনে বসাটা অনিবার্য। রোধ করা যাবে না এমন অনিবার্যকে।
তবু এশিয়াতে আমেরিকার প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায় চীন ঠেকানোর কাজে নেমে পড়া। একাজে ভারতের একাডেমিক জগতে স্থানীয় ভাবাদর্শ ও চিন্তাকে চীনবিরোধী করে প্রভাবিত করার কিছু কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল। দিল্লি হয়ে ওঠে এর কেন্দ্র। তখন ভারতের ট্রাডিশনাল (সোশ্যাল ও সামরিক-স্ট্রাটেজিক) গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো সবসময়ই স্থানীয় ও সরকারি সীমিত ফান্ডের মধ্যে কোনো মতে খুঁড়িয়ে চলছিল। তারা নিজেদেরকে থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠানও বলত না, তখনো চালু হয়নি এ পরিভাষা। আমেরিকা এসব প্রতিষ্ঠানকে পাশে ফেলে এসবেরই প্যারালাল ধারা হিসেবে আমেরিকান থিংক ট্যাংকের ভারতীয় শাখা খুলে অথবা সরাসরি এনজিও ফান্ড ঢেলে ভারতে চিন্তা ও ভাবাদর্শে দখল তৎপরতা শুরু করেছিল। তেমনি সবচেয়ে প্রভাবশালী এক থিংক ট্যাংক হলো, ‘কার্নেগি অ্যান্ডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’, যা ওয়াশিংটনভিত্তিক।
সংক্ষেপে এটাকে কার্নেগি অ্যান্ডাওমেন্ট অথবা শুধু কার্নেগি বলে অনেকে। যেমন ভারতে এরই শাখা খোলা হয়েছে ‘কার্নেগি ইন্ডিয়া’ নামে। এর প্রতিষ্ঠাতা ডিরেক্টর হন সি রাজামোহন। শুধু তাই নয়, ভারতের আগেকার ট্রাডিশনাল ও পরের আমেরিকা ফান্ডেড থিংক ট্যাংকগুলো এবং ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয় মিলে একটা নীতি-পলিসির সমন্বয় করার দায়িত্বও নেয় এই ‘কার্নেগি ইন্ডিয়া’। কোনো থিংক ট্যাংকের প্রোগ্রামে ফান্ডের সংস্থান বা বিদেশে পড়তে যাওয়ার বৃত্তি যোগানোর কাজটা ভারতে করে থাকে মূলত এই কার্নেগি ইন্ডিয়া। অবশ্য ভারতে এখন দেশী-বিদেশী সব ধরনের থিংক ট্যাংকের নেয়া যেকোনো প্রোগ্রামের লিখিত অনুমোদনদাতা প্রতিষ্ঠান বিদেশ মন্ত্রণালয়। তবু এক কথায় বলা যায়, গত প্রায় ২০ বছরের বেশির ভাগ সময় ধরে ওয়ার অ্যান্ড টেরর প্রোগ্রামসহ ভারত-আমেরিকার কৌশলগত সব তৎপরতার প্রধান বাস্তবায়ন ও সমন্বয়ের কাজ হয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে।
ব্যতিক্রম ছিল গত চার বছরে ট্রাম্পের আমল। কারণ ট্রাম্পের ধারণা এসব গ্লোবাল প্রভাব তৈরি করে তা দিয়ে আমেরিকার আর কোনো কাজ নেই, মানে এসব আর কাজে আসবে না। বরং আমেরিকান জাতিবাদী-অর্থনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে চীনবিরোধিতা বা চীনের সাথে বাণিজ্যযুদ্ধ করা ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ চিন্তা ও তৎপরতার জন্য বেশি লাভজনক ও উপকারী। ফলে এসব কাজের যত প্রস্তাব পেন্টাগন বা স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে অনুমোদনের জন্য হোয়াইট হাউজে গেছে তার সবই ট্রাম্প ফেলে রেখেছিলেন। ফলে সেই থেকে ভারতে রাজামোহন বা তার থিংক ট্যাংকের কাজ একেবারেই সীমিত হয়ে পড়েছিল, যদিও একেবারে বন্ধ হয়নি। রাজামোহন এখন কার্নেগি ত্যাগ করে সাময়িকভাবে যুক্ত আছেন সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাথে।
রাজামোহনের নতুন অ্যাসাইনমেন্ট ইসরাইল : সেই রাজামোহনকে এবার দেখা যাচ্ছে, আবার তৎপর হয়েছেন। তার এবারের অ্যাসাইনমেন্ট ‘ইসরাইল’। সরাসরি বললে, পাকিস্তান এবং সেই সূত্রে বাংলাদেশও যেন ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়, এর পক্ষে ওকালতি করা। রাজামোহন এই স্বীকৃতি দেয়ার ‘ফায়দা’ বেচতে এসেছেন, তবে সাথে হুমকি-ভয়ও দেখাচ্ছেন।
রাজামোহন নিয়মিত ভারতের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ইংরেজি দৈনিকে কলাম লিখেন। এর সর্বশেষ ভাষ্যে তিনি যে রচনাটা পাঠিয়েছেন এর শিরোনাম হলো, ‘পশ্চিম এশিয়ায় বদলে যাওয়া ভূরাজনীতি বাস্তবতাকে ইন্ডিয়া, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের অবশ্যই মোকাবিলা করতে হবে।’
তার লেখার এই শিরোনাম ঘোরতর চাতুরীতে পূর্ণ। এখানে ‘পশ্চিম এশিয়া’ মানে কী? তিনি ইরানের নাম না নিয়ে বলছেন, পশ্চিম এশিয়া। ইরান যেন তার ও ইসরাইলের ‘ভাসুর’! তা ছাড়া এমন কোনো কাজের এরিয়া আমরা দেখাতে পারব কি যেখানে ইন্ডিয়া, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের একই পলিসি গ্রহণের কোনো সুযোগ আছে? ইন্ডিয়া এমন কোনো কমন স্বার্থ-অবস্থানের ইস্যু বলে কিছু অবশিষ্ট রাখেনি; উগ্র হিন্দুত্ব মাখিয়ে তিতা করে ফেলেছে। কারণ ভারতের আচরণ হলো- মনে মনে দাবিও বলা যায়- যেন ভারত বলতে চায়, ‘আমেরিকা এখন আমার পিঠে হাত রেখেছে, কাজেই আমি অনেক উঁচুতে।’ ফলে সে তো বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের ওপরে কোনো প্রভাব বিস্তারযোগ্য শাসক মনে করে নিজেকে। ভারত নিজেকে যখন থেকে এমনই এক ‘মুই কী হনু রে’ জায়গায় অনুভব করে সেদিন থেকে সম্পর্কটাই তো অসম, কাজেই কমন স্বার্থ বলে এখানে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। ফলে এ অবস্থায় রাজামোহনের তিন দেশকে এক নিঃশ্বাসে হাজির করাটাই সন্দেহজনক।
আসলে রাজামোহন এখন ‘ইসরাইলের এজেন্সি’ নিয়ে এসেছেন। তাই আকার ইঙ্গিত নয় একেবারে সরাসরি বলছেন, আমরা এই তিন দেশ যেন ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেই যেটা ভারত ইতোমধ্যেই করে ফেলেছে, ইসরাইলের কোলে উঠে বসেছে।
কিন্তু এই কথাটা রাজমোহন তুলেছেন অত্যন্ত ধূর্ততায় ও অনৈতিকভাবে। তার লেখার প্রথম প্যারার অনুবাদ হলো এরকম- “তেহরান থেকে বাইরে গত সপ্তাহে ইরানি এক পরমাণু বিজ্ঞানীকে (মোহসেন ফখরিজাদে) নির্লজ্জ ও বেপরোয়া খুনের ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যের এই পরিচিত রাজনৈতিক বয়ানকেই গুরুত্ব আরোপ করে যে, আপনি ভুল না সঠিক অবস্থানে তাতে কিছু যায় আসে না। বরং আপনি দুর্বল না শক্তিশালী, এটাতেই আসলে সবকিছু যায় আসে। ফখরিজাদের গুপ্তহত্যাটা প্রমাণ করে ইরানের বেড়ে চলা মারাত্মক ‘স্ট্রাটেজিক দুস্থ’ অবস্থা। এ অঞ্চলে ইরানকে উপেক্ষা করে কিছু আরব দেশ ও ইসরাইলের মধ্যে সম্পর্ক ধারাবাহিকভাবে স্বাভাবিকীকরণে পুনঃসজ্জিত করা চলছে- এ দিকটাই উল্লেখযোগ্য।”
এখন লক্ষণীয়, শুরুতে তিনি ফখরিজাদের গুপ্তহত্যাকে বর্ণনা করতে ইংরেজিতে ‘ব্রাজেন’ (brazen) বলে একটা শব্দ ব্যবহার করেছেন; যার অর্থ নির্লজ্জ ও বেপরোয়াভাবে যে কাজ করা হয়- অর্থাৎ নিন্দাসূচক কাজ এটা; তিনি তাই বলছেন। অথচ পরের বাক্যে গুপ্তহত্যার পক্ষে সাফাই দিয়ে বলছেন, এসব কাজকে ঠিক-বেঠিক দিয়ে বুঝা যাবে না; বুঝতে হবে আপনি দুর্বল না শক্তিশালী সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। পরের বাক্যে এবার তিনি খোলাখুলি বলছেন, “ফখরিজাদের গুপ্তহত্যাটা প্রমাণ করে, ইরানের বেড়ে চলা মারাত্মক ‘স্ট্রাটেজিক দুস্থ’ অবস্থা।”
ফখরিজাদে খুন হয়েছেন মানে ইরানের স্ট্রাটেজিক দুরবস্থা প্রমাণিত হয়েছে, কাজেই এখন দল বেঁধে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে হবে- এমন কথা যিনি বলেন তিনি তো নিম্ন শ্রেণীর কোনো দালালের চেয়েও অধম!
এক কথায় রাজামোহন বলতে চাচ্ছেন, ইসরাইল যেহেতু ‘শক্তিশালী’ এবং ‘এটাই ম্যাটার করে’ অতএব ইসরাইলের ‘পা’চাটতে হবে’ আমাদের। আসলে এ ধরণের লোকের মধ্যে সমস্ত মনুষ্যগুণ লোপ পেয়েছে। তাদের ন্যূনতম কোনো নৈতিকতা আর অবশিষ্ট নেই।
আচ্ছা কালকে যদি ইরান প্রতিশোধমূলক কোনো অ্যাকশন নেয় যেটা সে প্রতিজ্ঞা করেছে এবং যেটা সে ট্রাম্পের ক্ষমতা ত্যাগের পরে নেবে বলে অনুমান করা হচ্ছে- তাহলে কী হবে?
আসলে এখন রাজামোহনের প্রথম কাজ হতে হবে পড়াশোনায় ফেরত যাওয়া। আর ‘ক্ষমতা’- এই ইস্যুটা নিয়ে তিনি যেন আবার পড়াশোনা শুরু করেন। তাতে তিনি দেখবেন, ক্ষমতা নেয়াই যায়, এটা বড় ঘটনা নয়। বড় দিকটা হলো, ক্ষমতার সপক্ষে একটা নৈতিকতা, একটা সাফাই হাজির করে দেখাতে পারা। এটা না পারলে ওই ক্ষমতা তাকে সবসময় পীড়া দিতেই থাকবে। আর সাফাই হাজির করতে না পারলে ওই ক্ষমতা তার হাত থেকে চলে যাবে এবং তারই বিরুদ্ধে হাজির হতে থাকবে। চাই কি, যাওয়ার আগে তাকেই মেরে ফেলে দিয়ে যেতে পারে।
ইসরাইল সম্পর্কে কেবল একটা কথা বলব। যেদিন আমেরিকা গ্লোবাল নেতৃত্ব হারিয়ে ফেলবে, সেদিন ইসরাইল রাষ্ট্র একই কারণে- নৈতিকতা বা সাফাইহীন ক্ষমতা খাড়া করার কারণে নিজ অস্তিত্ব টেকানোর সঙ্কটে পড়বে। তবে এসবের আগেই এখন আমরা যেদিকে চোখ রাখতে পারি তা হলো, চীন-ইরানের ২৫ বছরের হবু চুক্তি।
সৌদি আরবের বাদশাহরাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভাব ও টিকে থাকা আমেরিকার সাথে সৌদিদের সম্পর্কের সমান বয়সী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নায়ক-নির্ধারক আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট আর সৌদি বাদশাহর চুক্তি (১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৫) হয়েছিল। সৌদি আরবের এখনো মধ্যপ্রাচ্যের কেন্দ্র হয়ে থাকার ভিত্তি সেটাই; যদিও তা এখন শেষ বয়সের দিকে পৌঁছাচ্ছে বলে অনুমান করা হয়। চীনের গ্লোবাল নেতৃত্ব নেয়া আর চীন-ইরানের ২৫ বছরের চুক্তি কার্যকর হওয়া- হবু এসব ঘটনারই সোজা পরিণতি হবে, আজকের সৌদি অবস্থানটা তখন নেবে ইরান। মধ্যপ্রাচ্য বা জিসিসির প্রতিটি আমিরাতের অস্তিত্ব সঙ্কটাপন্ন হবে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সৌদি আরব আর ইউএই (দুবাই, আবুধাবি ইত্যাদি)। তবে আমিরাত হওয়া সত্ত্বে¡ও সবচেয়ে ভালো অবস্থানে যাবে কাতার। এক ধরনের ব্যাপক ওলটপালট ঘটে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা, রাজতন্ত্র টেকানোই মুশকিল হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া আরো বড় সঙ্কট সবার জন্য (আমাদেরসহ) অপেক্ষা করছে। সেটা হলো- ২০৩০ সালের পরে মাটির নিচের তেলভিত্তিক শিল্পসভ্যতা আর থাকছে না। জ্বালানির উৎস বদলে যাবে পরিবেশসম্মত জ্বালানিতে। এর প্রভাবে আয়-ইনকামের সঙ্কট যেটা দেখা দেবে, এর বিকল্প যা এত দিনে বাদশাহদের তৈরি করে ফেলা দরকার ছিল, বলতে গেলে এর কিছুই হয়নি।
২০২৫ সাল থেকেই এই সঙ্কট দৃশ্যমান হতে থাকবে। মধ্যপ্রাচ্যে কষ্টকর শরীর-ঘাম বেচে আয় করা বৈদেশিক মুদ্রার যে আরামে আমরা এখন আছি, ৪২ বিলিয়ন রিজার্ভের গরম অনুভব করছি, এসব বদলে যাবে। বসে বসে মাটির নিচের তেল বেচে আয়েশ করার দিন শেষ হয়ে যাবে। বরং এবার শিল্পভিত্তির ওপরে অর্থনীতিকে দাঁড় করানোর প্রতিযোগিতায় ইরান প্রতিটি রাজতন্ত্রকে হয়তো বুঝিয়ে দেবে কে কতটা যোগ্য!
আর চীন মধ্যপ্রাচ্যের এসব ওলটপালটকে সক্রিয় সমর্থন দিয়ে যাবে। কারণ চীনকে সেসময়ের মধ্যপ্রাচ্যের লেনদেন-বিনিময় বাণিজ্যের শীর্ষ মুদ্রার ভূমিকায় ডলারের বদলে ইউয়ানকে বসাতে হবে। এ কারণে সব ওলটপালট ঢেলে সাজানোতে চীনের প্রবল সক্রিয় সমর্থন থাকবে। আজো চীনের সাথে ইসরাইলের কোনো প্রত্যক্ষ বিরাট স্বার্থবিরোধ নেই। কিন্তু তা না থাকলেও, এখন থেকে নতুন বা হবু মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল চীনের স্বার্থের বিরোধী। কারণ ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে ওলটপালট ঢেলে সাজানোতে, রাজতন্ত্রগুলোকে টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা নেবে যা চীনের জন্য বাধা। এ কারণেই প্রকাশ্যে বা গোপনে আমিরাতগুলো ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে রাখতে চায় যাতে ইসরাইল তাদের প্রটেক্ট করে, নিরাপত্তা দেয়। অতএব চীন কিছুই চিন্তা না করে কেবল ইরানের সাথেই গাঁটছড়া বাঁধেনি বা ২৫ বছরের স্ট্রাটেজিক অ্যালায়েন্স গড়েনি, এটা বুঝতে হবে।
অতএব, রাজামোহন সাহেব, আপনি হারু পার্টির এজেন্সি নিয়ে এসেছেন। অন্তত বাংলাদেশ আপনার সাথে যাবে না। আপনার কোনো অনুমানই নেই যে, আমাদের সমাজে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে হবে- এ কথায় প্রতিক্রিয়া কী হবে? এ ছাড়া এ কথাটা টেবিলে তুলবে কে? যে তুলবে সে সব নৈতিকতা হারানো এক লোক বলে সমাজে চিহ্নিত হয়ে যাবে, এর দায়ে তার সামাজিক অস্তিত্ব সঙ্কটগ্রস্ত হবে। ফলে ব্যতিক্রম হিসেবে দু’-চারজন কেউ কেউ নিশ্চয়ই থাকবেন, কিন্তু তারাও অপ্রকাশ্য থাকবেন। এমনকি প্রগতিশীলরাও তাদের এতদিনের অবস্থান ছেড়ে ইসরাইলের পক্ষ নিচ্ছেন, এমন দেখা পাওয়া খুবই কঠিন হবে। বাংলাদেশে কমন অবস্থান যেটা দেখা যায় তা হলো, ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল ও তাদের জীবনের ওপর সব ধরনের অত্যাচার নির্যাতনের প্রতীক হলো ইসরাইলিরা। এটাই তাদের সাধারণ পারসেপশন।
অথচ রাজামোহন পরামর্শ দিচ্ছেন বাংলাদেশ যেন ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়। বোঝা যাচ্ছে, তিনি নিজ পেশাতেও কোনো দক্ষতা রাখেন না, বুঝাবুঝির পড়াশোনাতেও দুর্বল। তাকে বুঝতে হবে, বাংলাদেশ ধান্ধাবাজ দেশ নয়। বাংলাদেশে এখনো একটা কাজের পক্ষে ন্যূনতম নৈতিক অবস্থান, সামাজিক অবস্থান থাকা ম্যাটার করে অনেক। পুওর রাজামোহন!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক