অজু যেভাবে করোনা প্রতিরোধ করে
অজু - ছবি সংগৃহীত
কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস নামক একটি ঘাতক সংক্রামক মহামারী রোগ সাম্প্রতিককালে সারা বিশ্বকে এক ধরনের যুদ্ধাবস্থার দ্বারপ্রান্তে উপনীত করেছে। এ জাতীয় মহামারী বিশ্বের মানুষ ইতঃপূর্বে প্রত্যক্ষ করেনি।
দুনিয়ার বুকে এমন কোনো জনপদ নেই যেখানে এই মহামারী হানা দেয়নি। তবে রোগের কোনো ওষুধ অথবা এর সংক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার কোনো প্রতিষেধক এখনো পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। ইতোমধ্যে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ছাড়াও কোটি কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। উন্নত রাষ্ট্রগুলো সর্বশক্তি নিয়োগ করে অদৃশ্য এই ভাইরাসের কবল থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ যাবত আশানুরূপ কোনো ফল মেলেনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই রোগের সংক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য মুখে মাস্ক ব্যবহার, দৈহিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং সর্বোপরি ঘন ঘন হাত ধোয়ার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। এ জন্য অফিস-আদালত এবং জনবহুল বিপণি কেন্দ্রে হাত ধোয়ার জন্য বেসিন স্থাপন করা হয়েছে। মোট কথা, ভাইরাস সংক্রমণ রোধের জন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ওপর বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা: বলেছেন, ‘পাক-পবিত্রতা ঈমানের অর্ধাংশ’। মহান আল্লাহ পাক ‘উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জনকারীকে ভালোবাসেন।’
মহানবী সা: পবিত্রতা অর্জনের জন্য ‘অজু’ নামক একটি বিধান রেখে গেছেন যা দৈহিক পবিত্রতা অর্জনের জন্য অপরিহার্য। একজন মুমিনের নামাজ আদায়ের প্রথম স্তর হলো ‘অজু’। ‘অজু’ করাও ফরজ হিসেবে নির্ধারিত। ‘অজু’ একটি আরবি শব্দ। শরীরের অনাবৃত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোতে বায়ুমণ্ডলে বিরাজমান ধুলোবালির সাথে রোগ জীবাণু অতি সহজেই সংক্রমিত হতে পারে। নাক, কান, ঠোঁট, জিহ্বা এসব দিয়ে রোগ জীবাণু দেহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে। এ জন্য শরীরের যে অঙ্গগুলো সাধারণত অনাবৃত অর্থাৎ খোলা থাকে সেই বিশেষ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহপাকের নির্দেশ ও রাসূল সা:-এর সুন্নত অনুসরণে বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ধোয়ার নাম ‘অজু’।
আল্লাহ তা’লা অজুতে চারটি কাজ ফরজ করেছেন। ১. দুই হাত কনুই পর্যন্ত ধোয়া; ২. সমগ্র মুখমণ্ডল ধোয়া; ৩. পায়ের গিট অর্থাৎ টাখনু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত ধোয়া ও ৪. মাথার চার ভাগের একভাগ মাসেহ করা।
মহানবী সা: উপরোক্ত চারটি ফরজের সাথে আরো ১০টি কাজ সংযোজন করেছেন যেগুলো সুন্নত নামে অভিহিত। এগুলো হলো- ১. ‘বিছমিল্লাহ’ বলে অজু শুরু করা; ২. কব্জিসহ দুই হাত ধোয়া; ৩. কুলি করা; ৪. নাকের ভেতরের নরম অংশ কনিষ্ঠাঙ্গুলি দ্বারা ধোয়া; ৫. মেছওয়াক করা; ৬. সমস্ত মাথা একবার মাসেহ করা; ৭. কান মাসেহ করা; ৮. প্রত্যেক অঙ্গ তিনবার করে ধোয়া ও ৯-১০. হাত ও পায়ের আঙ্গুল খিলাল করা।
অজুতে যেসব অঙ্গ ধোয়া ফরজ ও সুন্নত হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে, রোগ জীবাণুর সংক্রমণ থেকে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সেগুলো অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত বলে চিকিৎসা ও দেহবিদদের কাছে প্রমাণিত। কর্মজীবী মানুষ অফিস-আদালত, কল-কারখানা, ব্যবসায়-বাণিজ্য এবং চাষাবাদে, আর মহিলারা রান্না-বান্না, শিশুর পরিচার্যাসহ প্রতিটি কাজে হাত দিয়ে শুরু ও শেষ করতে হয়। অজুর শুরুতে হাতের কব্জি ও কনুই পর্যন্ত ধোয়ার ফলে ময়লা আবর্জনা ও রোগ জীবাণুমুক্ত হাত দিয়ে অজুর পরবর্তী স্তরগুলো সম্পন্ন করা সম্ভব হয়ে থাকে। মেসওয়াক ও কুলি করলে মুখের ভেতরে জিহ্বা ও দাঁতের ফাঁকে জমে থাকা খাদ্য কণা পরিষ্কার হয়ে যায়। মুখমণ্ডল ধোয়ার ফলে চোখের পাতা, ভ্রু এবং পুরুষের দাঁড়ি গোঁফে আটকে থাকা ধুলোবালিমিশ্রিত রোগ জীবাণু বিদূরিত হয়। শাহাদাত আঙ্গুল দিয়ে দু’কানের ছিদ্র, বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে দু’কানের পেছন দিক এবং হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঘাড় মাসেহ করলে রোগ জীবাণু মিশ্রিত ধুলোবালি ওইসব অঙ্গ থেকে হয়ে যায়।
সবশেষে দু’পা গিরা থেকে গোড়ালি ও পায়ের তলা, দু’পায়ের আঙ্গুল, নখের কোণাসহ অতি যত্নসহকারে ধুয়ে অজু সম্পন্ন করতে হয়। একবার মাথা মাসেহ ব্যতীত সব অঙ্গ তিনবার ধৌত করা সুন্নত। শরীরের অনাবৃত যেইসব অঙ্গ অজুর আওতায় আনা হয়েছে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য পাঁচবার অজু করার সময় তিনবার করে মোট ১৫বার ওই সমস্ত অঙ্গ ধোয়া হলে করোনাভাইরাসসহ সব ধরনের রোগ জীবাণু থেকে দেহ সুরক্ষিত থাকা খুবই সহজ। অজুর মাধ্যমে হাত-পা, চোখ-কান, নাক, মাথার পবিত্রতা অর্জনের সাথে সাথে মন-মস্তিষ্কের কলুষতা দূরীভূত হয়ে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এক ধরনের নূরানি আভা ফুটে উঠে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক সুপারিশকৃত ঘন ঘন হাত ধোয়া, মাস্ক পরার চাইতে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা: কর্তৃক নির্ধারিত অজুর বিধান বহুগুণ ফলপ্রসূ ও বিজ্ঞানসম্মত। অজুর মাহাত্ম্য শুধু দুনিয়াতে নয়, আখিরাতেও আল্লাহপাকের অত্যন্ত প্রশংসনীয় ও পছন্দনীয় আমল হিসেবে স্বীকৃত হবে। এ প্রসঙ্গে অনেকগুলো হাদিসের মধ্যে একটি হাদিস উল্লেখ করা হলো : এক ব্যক্তি হুজুর পাক সা:কে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সা:, হাশরের ময়দানে অগণিত মানুষের মধ্যে আপনি আপনার উম্মতকে চিনবেন কিভাবে? হুজুর পাক সা: বললেন, ‘অজুর বরকতে তাদের ললাট এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দীপ্তিময় হবে। অন্য কোনো উম্মতের এই বৈশিষ্ট্য নসিব হবে না। তাদের জন্য একটি আলামত হবে যে, আমলনামা তাদের ডান হাতে থাকবে। তাদের সম্মুখভাগে নূরের রোশনি পতিত হতে থাকবে।’
আসুন, আমরা মহান আল্লাহ পাকের রহমতের আশা নিয়ে প্রত্যহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আগে একাগ্রচিত্তে শুদ্ধভাবে অজু করি। আমিন।