মুসলিম বিজ্ঞানীকে কেন টার্গেট করল ইসরাইল?
মোহসেন ফখরিজাদেহ - ছবি সংগৃহীত
গত ২৭ নভেম্বর ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও উদ্ভাবনী সংস্থার প্রধান এবং শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফখরিজাদেহকে তেহরানের কাছে সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করেছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এর জন্য ইসরাইলকে দায়ী করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প টুইটবার্তায় এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ‘মোসাদের হাত আছে’ বলে মন্তব্য করেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস তিন মার্কিন কর্মকর্তা ও গোয়েন্দাদের উদ্ধৃতি দিয়ে ইসরাইলের জড়িত থাকার খবর প্রকাশ করেছে। এর আগে ৩ জানুয়ারি ইরানের বিপ্লবী রক্ষী বাহিনীর এলিটফোর্স আল-কুদসের প্রধান জেনারেল কাশেম সোলেইমানিকে বাগদাদ বিমানবন্দরে হঠাৎ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে মেরে ফেলা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল ‘মোসাদ’সহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের বিজ্ঞানী ও ইসলামী ব্যক্তিত্বদের হত্যার জঘন্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে চলেছে। কোনো মুসলিম রাষ্ট্র যাতে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হতে না পারে- ইসরাইল তার মিত্র দেশগুলোকে নিয়ে এ ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। মুসলিম বিশ্বের কোনো দেশে যদি বিস্ময়কর মেধার অধিকারী বিজ্ঞানীর জন্ম হয় এবং তার মেধা যদি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয় তাহলে নির্ঘাত ইহুদি হিটলিস্টে তার নাম অন্তর্ভুক্ত হবে। ঘাতক স্কোয়াড তার পেছনে লেগে থাকবে এবং সুযোগ পেলে গুলি করে মেরে ফেলবে। ইহুদিরা মুসলমানদের পরমাণু অস্ত্রশূন্য করতে চায় অথচ ইসরাইলের নিজের রয়েছে ৩০০ থেকে ৪০০টি পারমাণবিক অস্ত্রবাহী ক্ষেপণাস্ত্রের বহর। বিবিসি পরিচালিত এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রভাণ্ডারে রয়েছে ২২০০ পারমাণবিক বোমা, যুক্তরাজ্যের আছে ১৬০টি, ফ্রান্সের আছে ৩০০টি, রাশিয়ার আছে ২৮০০টি আর চীনের আছে ১৮০টি (কালের কণ্ঠ, ৭ মার্চ ২০১০, পৃষ্ঠা-৩)। পৃথিবীতে আরো বহু দেশ আছে যাদের কাছে মজুদ রয়েছে বিপুল পারমাণবিক অস্ত্র অথচ ইরানের নাকি এটা থাকতে পারবে না। এটা কেমন যুক্তি? ইহুদি-খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের কাছে পারমাণবিক বোমা থাকলে নিরাপদ, অপর দিকে মুসলিম দেশের থাকলে তা ‘বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি’। এ ধরনের অপবাদ গোয়েবলসীয় প্রচারণা ছাড়া আর কী?
মধ্যপ্রাচ্যে ইরাক ছিল এক শক্তিশালী দেশ। ইরাকের সেনাসদস্যরা চৌকস। ইঙ্গ-মার্কিন-ইহুদি শক্তি টার্গেট করল ইরাককে। দুর্ভাগ্য সাদ্দাম হোসেনের, যাদের প্ররোচনায় তিনি কুয়েতে অভিযান চালালেন, তাদের হাতেই কোরবানির ঈদের দিন সকালে ফাঁসিতে ঝুলতে হলো তাকে। ইরান-ইরাক ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের নেপথ্য নায়কও তারা। ১০ বছরের এ যুদ্ধে কত লাখ মানুষের প্রাণ গেছে, কত কোটি টাকার সম্পত্তি বিনষ্ট হলো তার ইয়ত্তা নেই। কত মেধাবী ও প্রতিভাবান মানুষ অকালে ঝরে গেছেন, তার হিসাব রাখে কে? সবই ষড়যন্ত্র সাম্র্রাজ্যবাদী ‘খেলা’। মুসলমান রাজা-বাদশাহ ও স্বৈরশাসকরা তাদের হাতের ক্রীড়নক। কেননা, ক্ষমতার মসনদই তাদের শেষ কথা।
ইরাকের বিশাল সেনাবাহিনী যাতে ইসরাইলের জন্য হুমকি সৃষ্টি না করে, সে জন্য মিথ্যা অজুহাতে ইহুদিবাদীদের মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০০৩ সালে এক লাখ ৭১ হাজার সেনা নিয়ে ইরাক দখল করে নেয়। বিদ্যুৎ তৈরির উদ্দেশ্যে প্রস্তুত করা পরমাণু সংক্রান্ত নথিপত্র, দলিল-দস্তাবেজ, বৈজ্ঞানিক গবেষণার তথ্য-উপাত্ত আগ্রাসী সেনাবাহিনী তাদের নিজ দেশে পাচার করে দিয়েছে। পারমাণবিক সব গবেষণা ও স্থাপনা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সম্প্রতি মার্কিন বাহিনী ইরাক থেকে বিদায় নিয়েছে কিন্তু রেখে গেছে পৈশাচিকতার উন্মত্ত তাণ্ডব, বাতাসে রাসায়নিক মারণাস্ত্রের বিষক্রিয়া আগ্রাসনের দুঃসহ স্মৃতি। দেশটাতে মার্কিন সশস্ত্র অভিযানে দেড় লাখ বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে। বিধবা হয়েছেন ৭ লাখ ৪০ হাজার মা।
মার্কিন হামলার পর ২০ লাখ ইরাকি যাদের মধ্যে রয়েছেন অনেক শিক্ষক, গবেষক, বিজ্ঞানী, সাহিত্যসেবী প্রমুখ সিরিয়া ও জর্দানসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে আশ্রয় নিয়েছেন উদ্বাস্তু হিসেবে। শত্রুর থাবায় লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে প্রাচীন সভ্যতার পাদপীঠ ইরাক। লড়াই চলাকালীন দুর্নীতি ও লুটপাটের ঘটনা রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। অস্ত্রের মুখে লুট হয়ে গেছে নগদ অর্থ, সোনা-দানা, বৈদেশিক মুদ্রা, রাষ্ট্রীয় রেকর্ড ফাইল, প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ ও পেট্রল। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সর্বশেষ বিশ্লেষণ অনুসারে, বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ইরাকের অবস্থান পঞ্চম। ‘অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম’কে কেন্দ্র করে মার্কিন অস্ত্র ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা করেছেন এবং নতুন গোলা ও অস্ত্রের পরীক্ষাও করেছেন ইরাকের মাটিতে। মার্কিন বাহিনীর নিক্ষিপ্ত বোমা ও ব্যবহৃত অস্ত্রের বিষক্রিয়ায় বাতাস হয়ে গেছে বিষাক্ত। ইরাকে প্রতি এক হাজার প্রসবের ঘটনায় শিশুমৃত্যুর সংখ্যা ৮০। দেশটিতে ২০০৪ সালের তুলনায় লিউকেমিয়া বেড়েছে ৩৮ আর স্তন ক্যান্সার ১০ গুণ। মার্কিন বাহিনীর যুদ্ধ শেষ হলেও সহিংসতা বন্ধ হয়নি। ইরাক পরমাণু প্রকল্পের প্রধান ড. ইয়াহইয়া আমিন আল মুশহিদ ১৯৮০ সালে প্যারিসে মোসাদ এজেন্টদের হাতে নিহত হয়েছিলেন। ইরাকি পরমাণু রিঅ্যাক্টর উন্নয়নের জন্য তিনি তখন ফ্রান্স কর্তৃপক্ষের সাথে প্যারিসে আলোচনা চালাচ্ছিলেন। তার মৃত্যু ইরাকের জন্য অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
লিবিয়ার পারমাণবিক স্থাপনার সব বৈজ্ঞানিক সামগ্রী মার্কিন সেনাসদস্যরা কার্গো জাহাজে করে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যায়। বিনিময়ে স্বৈরশাসক গাদ্দাফি কিছুকাল (২০০৩-২০১১) ক্ষমতায় থাকার নিশ্চয়তা পেয়েছিলেন। দালালি করেও ক্ষমতায় টিকে থাকা বেশি দিন সম্ভব হলো না গাদ্দাফির। ৪২ বছরের দুঃসহ স্মৃতি লিবিয়ার নাগরিকদের বহন করতে হবে বহুকাল। এখন লিবিয়ার অয়েল ফিল্ডের নতুন ‘মুরব্বি’ ন্যাটো। ২০০৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর গাদ্দাফি আমেরিকা ও ব্রিটেনের ইহুদি লবির চাপে পারমাণবিক গবেষণা প্রকল্প পরিত্যাগ করার পরপরই আকাশ ও নৌপথে কেমিক্যাল, নিউক্লিয়ার ও বায়োলজিক্যাল অস্ত্র উপাদান আমেরিকায় পৌঁছতে থাকে। ২০০৩ সালে ২০০ ব্যালিস্টিক স্কাড-বি ক্ষেপণাস্ত্রে ব্যবহার করার উপযোগী দুই হাজার টন ইউরেনিয়াম ও রেডিওলজিক্যাল ম্যাটেরিয়াল আমেরিকা নিয়ে গেছে। পরবর্তী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সময়ে টেনেসি স্টেট বিমানবন্দরে নিয়মিত ত্রিপোলি থেকে রাসায়নিক অস্ত্রসামগ্রী বহনকারী কার্গো বিমান অবতরণ করতে থাকে।
সর্বশেষ খবর হচ্ছে, লিবিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যোগসাজশে যুক্তরাষ্ট্র্র লিবিয়ার খ্যাতনামা বিজ্ঞানীদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজনে গ্রেফতার এবং বিজ্ঞান গবেষণাগার খুঁজে বের করার জন্য ৩০ লাখ ডলার ব্যয় করছে (এপি, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১১)। কেবল ত্রিপোলির বাইরে তাজুরা নামক স্থানে স্থাপিত পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রেই ৭৫০ জন বিজ্ঞানী কাজ করতেন। তাদের বর্তমান অবস্থান অনেকটা অজ্ঞাত।
সোয়াত উপত্যকায় শরিয়াহ আইন চালুকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র্র পাকিস্তানের কাহুটা পারমাণবিক কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণের পাঁয়তারা করছে। তালেবান গেরিলারা যেকোনো সময় পারমাণবিক স্থাপনা দখল করে নিতে পারে- আমেরিকা প্রতিনিয়ত এ আশঙ্কা প্রকাশ করে একটি অজুহাত খাড়া করতে চাচ্ছে। তালেবান যোদ্ধাদের নাগালের বাইরে রয়েছে এই পরমাণু অস্ত্র। পাকিস্তান বারবার আশ্বস্ত করলেও ওয়াশিংটন বলছে- ‘পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রের নিরাপত্তা এখনো বিরাট বিপদের মুখোমুখি’। যুক্তরাষ্ট্র্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল জেমস জোনস বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী যতই বলুক, তাদের পরমাণু অস্ত্র নিরাপদে আছে। এতদসত্ত্বেও ওয়াশিংটন আরো নিশ্চয়তার প্রয়োজন আছে বলে মনে করে।’ এভাবে তালেবান হুমকির প্রসঙ্গ তুলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক স্থাপনার পাহারাদারির জন্য পাকিস্তানকে বাধ্য করছে। ফলে মুসলিম বিশ্বের একমাত্র পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র, পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের ভাণ্ডার আমেরিকার নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। জেনারেল মোশাররফের শাসনামলে আমেরিকার নির্দেশে ‘পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের জনক’ ড. আবদুল কাদির খানকে গৃহবন্দী রাখা হয়। তাকে সিআইএ’র কাছে হস্তান্তরের জন্য আমেরিকা জোর দাবি জানায়। জনরোষের ভয়ে মোশাররফ সরকার এ দাবি মানতে পারেনি।
রহস্যজনক ‘US Contingency Plan’ অনুসারে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র জঙ্গিদের হাতে পৌঁছে যাওয়া অর্থাৎ আল কায়েদা বা তালেবান জঙ্গিরা যদি পাকিস্তানের পারমাণবিক প্রকল্প দখলে নেয়ার চেষ্টা করে, সে ক্ষেত্রে যেকোনো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তুতি রয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের বৈরী স¤পর্ক সৃষ্টি হলে পেন্টাগন পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র পাকিস্তান সরকারের অনুমতি ছাড়াই পাকিস্তানের বাইরে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ব্যাপক পরিকল্পনা করেছে। দেশটি নিউক্লিয়ার সাইট বিশেষ করে বৃহত্তর ‘খুনাব রিঅ্যাক্টর এবং নিউ ল্যাব প্রসেসিং প্ল্যান্ট’ বোমা মেরে ধ্বংস করার ব্যাপক পরিকল্পনা রয়েছে মার্কিনিদের (আমার দেশ ১ অক্টোবর ২০১১,পৃষ্ঠা-৭)।
ইরান পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত হোক- এটা ইসরাইল কোনো দিন চায়নি। ইহুদি লবির সাবেক প্রেসিডেন্ট বুশের ওপর বিরাট চাপ সৃষ্টি করে ইরানে হামলা পরিচালনার জন্য। কিন্তু আফগানিস্তান ও ইরাক সঙ্কটের পাশাপাশি আরেকটি সঙ্কট সৃষ্টি হোক, বুশ সে ঝুঁকি নিতে চাননি। আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে আমেরিকার বিপুলসংখ্যক সেনা ও প্রচুর অর্থহানি হয়েছে। মার্কিন সরকারের সবুজসঙ্কেত না পাওয়ায় খোদ ইসরাইল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সাহস করেনি। তবে যেকোনো মুহূর্তে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ইসরাইলের টার্গেট হতে পারে।
সরাসরি হামলা করতে না পেরে ইসরাইল গুপ্তহত্যার আশ্রয় নিয়ে মুসলিম বিশ্বকে মেধাশূন্য করার ষড়যন্ত্রে নেমেছে। ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে ইরানের শীর্ষস্থানীয় পরমাণু বিজ্ঞানী আরদাশির হাসান বাউর মোসাদ এজেন্টদের হাতে প্রাণ হারান। আরদাশির ইস্পাহানে অবস্থিত পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং পরমাণু গবেষণার অন্যতম পাদপীঠ সেন্টার ফর নিউক্লিয়ার ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক স্টাডিজের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ‘দ্য সানডে টাইমস’ পত্রিকার প্রতিবেদনে জানা যায়, ইরানের শীর্ষস্থানীয় আরো বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী ইসরাইলি বা ইহুদিদের হত্যার তালিকায় রয়েছে।
‘হামাস’-এর প্রতিষ্ঠাতা, ফিলিস্তিনের আধ্যাত্মিক গুরু অশীতিপর বৃদ্ধ শেখ আহমদ ইয়াছিন ফজরের নামাজ আদায় করে মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় ইসরাইলি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে শাহাদত বরণ করেন ২০০৪ সালের ২২ মার্চ। বহুদিন ইসরাইলি কারাগারে বন্দী আহমদ ইয়াছিন হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতেন। ১২ বছর বয়সে এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার মেরুদণ্ড ভেঙে গেলে তিনি হুইল চেয়ার ব্যবহার করতেন। নানা জটিল রোগের কারণে তিনি প্রায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এমন অসুস্থও বৃদ্ধ মানুষটিকে হত্যা করা যে কত বর্বরোচিত ও পৈশাচিক, সবাই তা বুঝেন। ফিলিস্তিন সংগ্রামের শীর্ষনেতা ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পেছনেও মোসাদের হাত ছিল বলে অনেকের সন্দেহ। সাইপ্রাসে নিযুক্ত জর্দানি বংশোদ্ভূত আল-ফাতাহ প্রতিনিধি হোসাইন আল বশির ১৯৭৩ সালের ২৪ জানুয়ারি মোসাদ এজেন্টদের হাতে মৃত্যুবরণ করেন। নিকোসিয়ায় তার হোটেল কক্ষে রক্ষিত বোমার বিস্ফোরণে তার মৃত্যু ঘটেছিল। ১৯৭২ সালের ২ ডিসেম্বর প্যারিসে নিযুক্ত পিএলও প্রতিনিধি ড. মুহাম্মদ হামশারিকে মোসাদ হত্যা করে তার অফিসের টেলিফোন টেবিলে টাইম বোমা পুঁতে।
আরব বিশ্বের খ্যাতনামা সব বিজ্ঞানীর ওপর রয়েছে ইসরাইলের কড়া গোয়েন্দা নজরদারি। মিসরীয় পরমাণু বিজ্ঞানী ড. সামিরা মূসা ১৯৫২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। অজ্ঞাত এক ড্রাইভার তার গাড়ি চালাচ্ছিল। ইসরাইল কর্তৃক পরমাণু অস্ত্রের ভাণ্ডার মজুদ করার কারণে যেকোনো সময় মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে- ড. সামিরা এমন আশঙ্কা প্রকাশ করতেন বলে ইসরাইল তাকে অপছন্দ করত। এ ছাড়া তিনি পরমাণু প্রকল্পের জন্য ইউরেনিয়ামের তুলনায় ধাতব পদার্থ থেকে আরো সাশ্রয়ী জ্বালানি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হন। ১৯৬৭ সালে মিসরের শীর্ষস্থানীয় পরমাণু বিজ্ঞানী ড. আমির নাজিব গুপ্তঘাতকের হাতে যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েটে নিহত হন। সামরিক অভিযানে পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহারের লক্ষ্যে তিনি বেশ কয়েকটি সফল পরীক্ষা পরিচালনা করেছেন।
১৯৮৯ সালের জুলাই মাসে অজ্ঞাত আততায়ী মিসরীয় বিজ্ঞানী সাঈদ আল বুদায়েরকে আলেকজান্দ্রিয়ার বাসভবনে গুলি করে হত্যা করে। মাইক্রোওয়েভ ফিল্ডে তিনি বেশ কয়েকটি অগ্রবর্তী থিওরি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হন। এসব হত্যাকাণ্ড মুসলমানদের পারমাণবিক অস্ত্র প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত রাখার ইহুদিবাদী কৌশলের অংশবিশেষ মাত্র। ইসরাইল ছাড়া যেন আর কারো হাতে পরমাণু অস্ত্র না থাকে এবং মধ্যপ্রাচ্যে যেন ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি না হয়- এটাই ইহুদিবাদীদের টার্গেট।
পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে (এনপিটি) ১৮৯টি রাষ্ট্র্র স্বাক্ষর করলেও আজ পর্যন্ত ইসরাইল এ চুক্তি মেনে নেয়নি। ইসরাইলকে এনপিটিতে যোগ দেয়ার জন্য কিংবা তার পরমাণু অস্ত্রের ধ্বংসের জন্য যুক্তরাষ্ট্র কোনো চাপ প্রয়োগ করেনি। মার্কিন নেতাদের এ ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’ বিশ্বে তাদের গ্রহণযোগ্যতাকে গুরুতর প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। আরব গোয়েন্দাদের হাতে মধ্যপ্রাচ্যে কোনো ইহুদি বিজ্ঞানী মারা গেলে দুনিয়াজুড়ে কী তুলকালাম কাণ্ড ঘটত, আমরা কি তা কল্পনা করতে পারি? খোদ আরব দেশের রাজা-বাদশাহরাও এটাকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলে চিৎকার দিয়ে উঠতেন। পশ্চিমা বিশ্ব এভাবে ইহুদিদের মাধ্যমে মুসলমানদের সৃজনশীল মেধাকে নিঃশেষিত করার বর্ণবাদী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছে। মার্কিন-ইসরাইলি গুপ্তঘাতক স্কোয়াডের হাত থেকে মুসলিম বিজ্ঞানীদের রক্ষার দায়িত্ব কে নেবে? এ মুহূর্তে এটাই বড় প্রশ্ন।
যুক্তরাষ্ট্র মুখে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন, সহিষ্ণুতা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা বললেও বাস্তবে তার প্রমাণ কোথায়? আফগানিস্তান ও ইরাক দখল তাদের আগ্রাসী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। গুয়ান্তানামো ঘাঁটিতে বীভৎস কায়দায় বন্দী নির্যাতন আর পবিত্র কুরআনের অবমাননা তাদের চরম অসহিষ্ণু মনোবৃত্তির পরিচয় বহন করে। পাকিস্তান ও ইরানের সার্বভৌমত্ব যখন মার্কিন হুমকির মুখে, এ মুহূর্তে ওআইসি এগিয়ে আসতে পারছে না আগ্রাসন প্রতিরোধের সংগ্রামে মুসলিম বিশ্বের পাশে দাঁড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে। মনে রাখা দরকার, সন্ত্রাসের মূল উৎস খুঁজে বের করে তা রুখে দেয়া পথে অগ্রসর হলেই সন্ত্রাস বন্ধ হতে বাধ্য। হামলা ও আগ্রাসন সন্ত্রাসকে অনেক বৃদ্ধি করবে। বুকে বোমা বেঁধে যারা প্রাণ দেয়, তাদের মনের দুঃখের খবর রাখে কে?
ইহুদিদের সর্বশেষ ষড়যন্ত্রের শিকার ড. আফিয়া সিদ্দিকা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্নায়ুবিজ্ঞানী। অসামান্য ধীসম্পন্ন পিএইচডিধারী এ মহিলার সম্মানসূচক ডিগ্রি ও সার্টিফিকেট রয়েছে প্রায় ১৪৪টি। যুক্তরাষ্ট্রের ব্রন্ডেইস বিশ্ববিদ্যালয় তাকে নিউরোলজি বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছে। আফিয়া যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নায়ুবিজ্ঞানে পড়ালেখা ও উচ্চতর গবেষণা করেন। তিনি হাফেজে কুরআন ও আলিমা। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে পারদর্শিণী এ মহিলা অত্যন্ত দ্বীনদার ও পরহেজগার। ইসলামী আদর্শ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি রয়েছে তার সুদৃঢ় কমিটমেন্ট। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় আল কায়েদার সাথে যোগাযোগ থাকার অভিযোগে ২০০৩ সালে ড. আফিয়াকে তার তিন সন্তান আহমদ, সুলায়মান ও মরিয়মসহ করাচির রাস্তা থেকে অপহরণ করে নেয়। পাকিস্তানের কোনো কারাগারে না রেখে এবং পাকিস্তানি আদালতে উপস্থাপন না করে তাকে আফগানিস্তানের বাগরাম সামরিক ঘাঁটিতে বন্দী করে রাখা হয়। এরপর চলে তার ওপর শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন। বাগরামে কুখ্যাত মার্কিন কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়া ব্যক্তিরা বলেছেন, ‘নির্যাতনের সময় একজন নারী বন্দীর আর্তচিৎকার অন্য বন্দীদের সহ্য করা কষ্টকর ছিল। ওই নারীর ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে অন্য বন্দীরা অনশন পর্যন্ত করেছিলেন।
ড. আফিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তাকে গ্রেফতারের সময় তার সাথে থাকা হাতব্যাগ তল্লাশি করে মার্কিন স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনাসংবলিত কাগজপত্র, গজনীর মানচিত্র, রাসায়নিক অস্ত্র তৈরির নিয়ম ও রেডিওলজিক্যাল এজেন্ট সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যায়। ব্রিটেনের দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকার প্রখ্যাত সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ব্রন্ডেইস বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডিধারী একজন পাকিস্তানি-আমেরিকান তার হাতব্যাগে করে মার্কিন স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা নিয়ে ঘুরছেন- এ কথা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য?’
ইহুদিরা মানবতার শত্রু, কুচক্রী, চুক্তি ভঙ্গকারী ও বিশ্বাসঘাতক। তাদের রক্তের কণায় কণায় ইসলামবিদ্বেষ।
ইহুদিরা অর্থ ও সুন্দরী ললনা দিয়ে প্রতিপক্ষকে বশে আনে। ওরা মুসলমানদের কোনো দিন আপন মনে করেনি, আগামী দিনেও করবে না। তাদের দলভুক্ত হলে ভিন্ন কথা। ‘হে মুমিনরা! ইহুদি-খ্রিষ্টানদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না, তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।’ ‘আপনি (হে রাসূল!) সব মানুষের চাইতে মুসলমানদের অধিক শত্রুরূপে ইহুদি ও মুশরিকদের পাবেন।’ পবিত্র কুরআনের এ পরম হুঁশিয়ারি অবজ্ঞা করলে উম্মাহর ওপর বিপদ অনিবার্য। মুসলমানদের অন্যায়প্রীতি আল্লাহ তায়ালার গজব ডেকে নিয়ে আসবে। এখনই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানচর্চায় মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় নিতে হবে সমন্বিত ও চৌকস কর্মপ্রয়াস।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক