সাদ্দামের শক্তিশালী ইরাককে যেভাবে শেষ করে দেয়া হলো
সাদ্দাম - ছবি সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যে ইরাক ছিল এক শক্তিশালী দেশ। ইরাকের সেনাসদস্যরা চৌকস। ইঙ্গ-মার্কিন-ইহুদি শক্তি টার্গেট করল ইরাককে। দুর্ভাগ্য সাদ্দাম হোসেনের, যাদের প্ররোচনায় তিনি কুয়েতে অভিযান চালালেন, তাদের হাতেই কোরবানির ঈদের দিন সকালে ফাঁসিতে ঝুলতে হলো তাকে। ইরান-ইরাক ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের নেপথ্য নায়কও তারা। ১০ বছরের এ যুদ্ধে কত লাখ মানুষের প্রাণ গেছে, কত কোটি টাকার সম্পত্তি বিনষ্ট হলো তার ইয়ত্তা নেই। কত মেধাবী ও প্রতিভাবান মানুষ অকালে ঝরে গেছেন, তার হিসাব রাখে কে? সবই ষড়যন্ত্র সাম্র্রাজ্যবাদী ‘খেলা’। মুসলমান রাজা-বাদশাহ ও স্বৈরশাসকরা তাদের হাতের ক্রীড়নক। কেননা, ক্ষমতার মসনদই তাদের শেষ কথা।
ইরাকের বিশাল সেনাবাহিনী যাতে ইসরাইলের জন্য হুমকি সৃষ্টি না করে, সে জন্য মিথ্যা অজুহাতে ইহুদিবাদীদের মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০০৩ সালে এক লাখ ৭১ হাজার সেনা নিয়ে ইরাক দখল করে নেয়। বিদ্যুৎ তৈরির উদ্দেশ্যে প্রস্তুত করা পরমাণু সংক্রান্ত নথিপত্র, দলিল-দস্তাবেজ, বৈজ্ঞানিক গবেষণার তথ্য-উপাত্ত আগ্রাসী সেনাবাহিনী তাদের নিজ দেশে পাচার করে দিয়েছে। পারমাণবিক সব গবেষণা ও স্থাপনা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সম্প্রতি মার্কিন বাহিনী ইরাক থেকে বিদায় নিয়েছে কিন্তু রেখে গেছে পৈশাচিকতার উন্মত্ত তাণ্ডব, বাতাসে রাসায়নিক মারণাস্ত্রের বিষক্রিয়া আগ্রাসনের দুঃসহ স্মৃতি। দেশটাতে মার্কিন সশস্ত্র অভিযানে দেড় লাখ বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে। বিধবা হয়েছেন ৭ লাখ ৪০ হাজার মা।
মার্কিন হামলার পর ২০ লাখ ইরাকি যাদের মধ্যে রয়েছেন অনেক শিক্ষক, গবেষক, বিজ্ঞানী, সাহিত্যসেবী প্রমুখ সিরিয়া ও জর্দানসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে আশ্রয় নিয়েছেন উদ্বাস্তু হিসেবে। শত্রুর থাবায় লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে প্রাচীন সভ্যতার পাদপীঠ ইরাক। লড়াই চলাকালীন দুর্নীতি ও লুটপাটের ঘটনা রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। অস্ত্রের মুখে লুট হয়ে গেছে নগদ অর্থ, সোনা-দানা, বৈদেশিক মুদ্রা, রাষ্ট্রীয় রেকর্ড ফাইল, প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ ও পেট্রল। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সর্বশেষ বিশ্লেষণ অনুসারে, বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ইরাকের অবস্থান পঞ্চম। ‘অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম’কে কেন্দ্র করে মার্কিন অস্ত্র ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা করেছেন এবং নতুন গোলা ও অস্ত্রের পরীক্ষাও করেছেন ইরাকের মাটিতে। মার্কিন বাহিনীর নিক্ষিপ্ত বোমা ও ব্যবহৃত অস্ত্রের বিষক্রিয়ায় বাতাস হয়ে গেছে বিষাক্ত। ইরাকে প্রতি এক হাজার প্রসবের ঘটনায় শিশুমৃত্যুর সংখ্যা ৮০। দেশটিতে ২০০৪ সালের তুলনায় লিউকেমিয়া বেড়েছে ৩৮ আর স্তন ক্যান্সার ১০ গুণ। মার্কিন বাহিনীর যুদ্ধ শেষ হলেও সহিংসতা বন্ধ হয়নি। ইরাক পরমাণু প্রকল্পের প্রধান ড. ইয়াহইয়া আমিন আল মুশহিদ ১৯৮০ সালে প্যারিসে মোসাদ এজেন্টদের হাতে নিহত হয়েছিলেন। ইরাকি পরমাণু রিঅ্যাক্টর উন্নয়নের জন্য তিনি তখন ফ্রান্স কর্তৃপক্ষের সাথে প্যারিসে আলোচনা চালাচ্ছিলেন। তার মৃত্যু ইরাকের জন্য অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
লিবিয়ার পারমাণবিক স্থাপনার সব বৈজ্ঞানিক সামগ্রী মার্কিন সেনাসদস্যরা কার্গো জাহাজে করে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যায়। বিনিময়ে স্বৈরশাসক গাদ্দাফি কিছুকাল (২০০৩-২০১১) ক্ষমতায় থাকার নিশ্চয়তা পেয়েছিলেন। দালালি করেও ক্ষমতায় টিকে থাকা বেশি দিন সম্ভব হলো না গাদ্দাফির। ৪২ বছরের দুঃসহ স্মৃতি লিবিয়ার নাগরিকদের বহন করতে হবে বহুকাল। এখন লিবিয়ার অয়েল ফিল্ডের নতুন ‘মুরব্বি’ ন্যাটো। ২০০৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর গাদ্দাফি আমেরিকা ও ব্রিটেনের ইহুদি লবির চাপে পারমাণবিক গবেষণা প্রকল্প পরিত্যাগ করার পরপরই আকাশ ও নৌপথে কেমিক্যাল, নিউক্লিয়ার ও বায়োলজিক্যাল অস্ত্র উপাদান আমেরিকায় পৌঁছতে থাকে। ২০০৩ সালে ২০০ ব্যালিস্টিক স্কাড-বি ক্ষেপণাস্ত্রে ব্যবহার করার উপযোগী দুই হাজার টন ইউরেনিয়াম ও রেডিওলজিক্যাল ম্যাটেরিয়াল আমেরিকা নিয়ে গেছে। পরবর্তী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সময়ে টেনেসি স্টেট বিমানবন্দরে নিয়মিত ত্রিপোলি থেকে রাসায়নিক অস্ত্রসামগ্রী বহনকারী কার্গো বিমান অবতরণ করতে থাকে।
সর্বশেষ খবর হচ্ছে, লিবিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যোগসাজশে যুক্তরাষ্ট্র্র লিবিয়ার খ্যাতনামা বিজ্ঞানীদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজনে গ্রেফতার এবং বিজ্ঞান গবেষণাগার খুঁজে বের করার জন্য ৩০ লাখ ডলার ব্যয় করছে (এপি, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১১)। কেবল ত্রিপোলির বাইরে তাজুরা নামক স্থানে স্থাপিত পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রেই ৭৫০ জন বিজ্ঞানী কাজ করতেন। তাদের বর্তমান অবস্থান অনেকটা অজ্ঞাত।