ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ও ইসরাইলের ভাবনা
ইরানের পরমাণু স্থাপনা - ছবি সংগৃহীত
ইরান পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত হোক- এটা ইসরাইল কোনো দিন চায়নি। ইহুদি লবির সাবেক প্রেসিডেন্ট বুশের ওপর বিরাট চাপ সৃষ্টি করে ইরানে হামলা পরিচালনার জন্য। কিন্তু আফগানিস্তান ও ইরাক সঙ্কটের পাশাপাশি আরেকটি সঙ্কট সৃষ্টি হোক, বুশ সে ঝুঁকি নিতে চাননি। আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে আমেরিকার বিপুলসংখ্যক সেনা ও প্রচুর অর্থহানি হয়েছে। মার্কিন সরকারের সবুজসঙ্কেত না পাওয়ায় খোদ ইসরাইল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সাহস করেনি। তবে যেকোনো মুহূর্তে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ইসরাইলের টার্গেট হতে পারে।
সরাসরি হামলা করতে না পেরে ইসরাইল গুপ্তহত্যার আশ্রয় নিয়ে মুসলিম বিশ্বকে মেধাশূন্য করার ষড়যন্ত্রে নেমেছে। ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে ইরানের শীর্ষস্থানীয় পরমাণু বিজ্ঞানী আরদাশির হাসান বাউর মোসাদ এজেন্টদের হাতে প্রাণ হারান। আরদাশির ইস্পাহানে অবস্থিত পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং পরমাণু গবেষণার অন্যতম পাদপীঠ সেন্টার ফর নিউক্লিয়ার ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক স্টাডিজের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ‘দ্য সানডে টাইমস’ পত্রিকার প্রতিবেদনে জানা যায়, ইরানের শীর্ষস্থানীয় আরো বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী ইসরাইলি বা ইহুদিদের হত্যার তালিকায় রয়েছে।
‘হামাস’-এর প্রতিষ্ঠাতা, ফিলিস্তিনের আধ্যাত্মিক গুরু অশীতিপর বৃদ্ধ শেখ আহমদ ইয়াছিন ফজরের নামাজ আদায় করে মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় ইসরাইলি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে শাহাদত বরণ করেন ২০০৪ সালের ২২ মার্চ। বহুদিন ইসরাইলি কারাগারে বন্দী আহমদ ইয়াছিন হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতেন। ১২ বছর বয়সে এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার মেরুদণ্ড ভেঙে গেলে তিনি হুইল চেয়ার ব্যবহার করতেন। নানা জটিল রোগের কারণে তিনি প্রায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এমন অসুস্থও বৃদ্ধ মানুষটিকে হত্যা করা যে কত বর্বরোচিত ও পৈশাচিক, সবাই তা বুঝেন। ফিলিস্তিন সংগ্রামের শীর্ষনেতা ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পেছনেও মোসাদের হাত ছিল বলে অনেকের সন্দেহ। সাইপ্রাসে নিযুক্ত জর্দানি বংশোদ্ভূত আল-ফাতাহ প্রতিনিধি হোসাইন আল বশির ১৯৭৩ সালের ২৪ জানুয়ারি মোসাদ এজেন্টদের হাতে মৃত্যুবরণ করেন। নিকোসিয়ায় তার হোটেল কক্ষে রক্ষিত বোমার বিস্ফোরণে তার মৃত্যু ঘটেছিল। ১৯৭২ সালের ২ ডিসেম্বর প্যারিসে নিযুক্ত পিএলও প্রতিনিধি ড. মুহাম্মদ হামশারিকে মোসাদ হত্যা করে তার অফিসের টেলিফোন টেবিলে টাইম বোমা পুঁতে।
আরব বিশ্বের খ্যাতনামা সব বিজ্ঞানীর ওপর রয়েছে ইসরাইলের কড়া গোয়েন্দা নজরদারি। মিসরীয় পরমাণু বিজ্ঞানী ড. সামিরা মূসা ১৯৫২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। অজ্ঞাত এক ড্রাইভার তার গাড়ি চালাচ্ছিল। ইসরাইল কর্তৃক পরমাণু অস্ত্রের ভাণ্ডার মজুদ করার কারণে যেকোনো সময় মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে- ড. সামিরা এমন আশঙ্কা প্রকাশ করতেন বলে ইসরাইল তাকে অপছন্দ করত। এ ছাড়া তিনি পরমাণু প্রকল্পের জন্য ইউরেনিয়ামের তুলনায় ধাতব পদার্থ থেকে আরো সাশ্রয়ী জ্বালানি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হন। ১৯৬৭ সালে মিসরের শীর্ষস্থানীয় পরমাণু বিজ্ঞানী ড. আমির নাজিব গুপ্তঘাতকের হাতে যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েটে নিহত হন। সামরিক অভিযানে পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহারের লক্ষ্যে তিনি বেশ কয়েকটি সফল পরীক্ষা পরিচালনা করেছেন।
১৯৮৯ সালের জুলাই মাসে অজ্ঞাত আততায়ী মিসরীয় বিজ্ঞানী সাঈদ আল বুদায়েরকে আলেকজান্দ্রিয়ার বাসভবনে গুলি করে হত্যা করে। মাইক্রোওয়েভ ফিল্ডে তিনি বেশ কয়েকটি অগ্রবর্তী থিওরি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হন। এসব হত্যাকাণ্ড মুসলমানদের পারমাণবিক অস্ত্র প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত রাখার ইহুদিবাদী কৌশলের অংশবিশেষ মাত্র। ইসরাইল ছাড়া যেন আর কারো হাতে পরমাণু অস্ত্র না থাকে এবং মধ্যপ্রাচ্যে যেন ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি না হয়- এটাই ইহুদিবাদীদের টার্গেট।
পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে (এনপিটি) ১৮৯টি রাষ্ট্র্র স্বাক্ষর করলেও আজ পর্যন্ত ইসরাইল এ চুক্তি মেনে নেয়নি। ইসরাইলকে এনপিটিতে যোগ দেয়ার জন্য কিংবা তার পরমাণু অস্ত্রের ধ্বংসের জন্য যুক্তরাষ্ট্র কোনো চাপ প্রয়োগ করেনি। মার্কিন নেতাদের এ ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’ বিশ্বে তাদের গ্রহণযোগ্যতাকে গুরুতর প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। আরব গোয়েন্দাদের হাতে মধ্যপ্রাচ্যে কোনো ইহুদি বিজ্ঞানী মারা গেলে দুনিয়াজুড়ে কী তুলকালাম কাণ্ড ঘটত, আমরা কি তা কল্পনা করতে পারি? খোদ আরব দেশের রাজা-বাদশাহরাও এটাকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলে চিৎকার দিয়ে উঠতেন। পশ্চিমা বিশ্ব এভাবে ইহুদিদের মাধ্যমে মুসলমানদের সৃজনশীল মেধাকে নিঃশেষিত করার বর্ণবাদী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছে। মার্কিন-ইসরাইলি গুপ্তঘাতক স্কোয়াডের হাত থেকে মুসলিম বিজ্ঞানীদের রক্ষার দায়িত্ব কে নেবে? এ মুহূর্তে এটাই বড় প্রশ্ন।