কোহলির অধিনায়কত্ব নিয়ে বিরাট প্রশ্ন
বিরাট কোহলি - ছবি সংগৃহীত
বিরাট কোহলির নেতৃত্ব এখন প্রশ্নের মুখে। গত তিন দশকে ভারতীয় ক্যাপ্টেন হয়েছেন আজহার, শচিন, সৌরভ, রাহুল, সেহবাগ, কুম্বলে, ধোনি, বিরাট, রাহানে। তাদের তুলনামূলক আলোচনায় সব্যসাচী সরকার।
কেউ বলছেন বিষোদ্গার, আবার কারো বক্তব্য, কাউকে না কাউকে তো মুখ খুলতেই হতো। কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, সেই প্রশ্নে না হয় পরে আসছি। কিন্তু ঘটনা হলো, এককালের দিল্লি তথা ভারতের টিমমেট বিরাট কোহলির উপর তোপ দেগেই চলেছেন গৌতম গম্ভীর। আইপিএলের সময় বলেছিলেন, ক্যাপ্টেন হিসেবে চরম ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু সেই বিরাটকেই ক্যাপ্টেন রেখে দিয়েছে। কোনো ক্যাপ্টেন এই সুযোগ পাবেন না। অস্ট্রেলিয়ায় ওয়ান ডে সিরিজে টানা দুটো ম্যাচে হারের পরে বলেছেন, 'টিমের এক নম্বর বোলার বুমরাকে শুরুতে মাত্র দুই ওভার দিয়ে সরিয়ে দেয়ার মতো সিদ্ধান্ত কোনো ক্যাপ্টেন নেবে না।' এতেই শেষ নয়। সরাসরি বলছেন, 'এরপরে রোহিতকে সাদা বলের ক্রিকেটে ক্যাপ্টেন না করলে সেটা ভারতের ক্ষতি, রোহিতের নয়!'
দিল্লির টিমমেট থাকাকালীন গৌতম গম্ভীরের সঙ্গে বিরাট কোহলির সম্পর্ক মোটেই মধুর ছিল না। কিন্তু শুধু সে জন্যই গম্ভীর এত কথা বলছেন? আরসিবি-র বোলিং কোচ আশিস নেহরাও তো বিরাট সম্পর্কে বলে দিচ্ছেন, 'ক্যাপ্টেন হিসেবে ও খুব আবেগপ্রবণ!' তা হলে কি এ বার অন্তত সাদা বলের ক্রিকেটে টি টোয়েন্টিতে রোহিতকে অধিনায়কত্ব দেয়ার সময় এসেছে? বিশেষত সামনে যখন তিন বছরে তিনটি বিশ্বকাপ? ২০২১ সালে ঘরের মাঠে টি-টোয়েন্টি, পরের বছর অস্ট্রেলিয়া আবার টি-টোয়েন্টি এবং সব শেষে ২০২৩ সালে ফের দেশের মাঠে ওয়ান ডে বিশ্বকাপ। যুক্তি হল, টেস্টে বিরাট ক্যাপ্টেন থাকুন, কিন্তু ওয়ান ডে-তে রোহিতকে সুযোগ দেয়া হোক। বিশ্বকাপের অন্তত এক বছর আগে। এই যুক্তি সোজাসুজি উড়িয়ে দিচ্ছেন কপিল। বলছেন, 'একটা কোম্পানিতে যেমন দু'জন সিইও থাকতে পারে না, ঠিক তেমনই একটা টিমে দু'জন ক্যাপ্টেন থাকতে পারে না। আমাদের দেশের ধরণটা সেরকম নয়।' ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়া কিন্তু দিব্যি আলাদা আলাদা ক্যাপ্টেন রেখে সাফল্য পাচ্ছে। ইংল্যান্ডে ইওন মর্গ্যান টি-টোয়েন্টি ও ওয়ান ডে ক্যাপ্টেন, টেস্টে জো রুট। আবার অস্ট্রেলিয়ায় অ্যারন ফিঞ্চ সাদা বলে ক্যাপ্টেন, টেস্টে টিম পেইন।
গত তিন দশকে ভারতীয় ক্যাপ্টেন্সির ইতিহাস বিচার করলে আমরা দশজন ক্যাপ্টেন পাচ্ছি। পর্যায়ক্রমে আজহার, শচিন, সৌরভ, রাহুল, সেহবাগ, কুম্বলে, ধোনি, বিরাট, রাহানে। সহবাগ আর রাহানে অস্থায়ী ক্যাপ্টেন হিসেবে কাজ করেছেন আর স্থায়িত্ব বিচার করলে সবচেয়ে বেশি টেস্টে ক্যাপ্টেন্সি করেছেন চারজন। আজহার (৪৭), সৌরভ (৪৯), ধোনি (৬০) ও বিরাট (৫৫)। টেস্ট ক্যাপ্টেন্সিতে সাফল্যের বিচারে এই চার জনের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে বিরাটই। ৫৫ টেস্টে ক্যাপ্টেন্সি করে ৩৩টি টেস্ট জিতেছেন, সাফল্যের হার শতকরা ৬০ শতাংশ। তার উপর প্রথম ভারতীয় ক্যাপ্টেন হিসেবে ২০১৯ সালে টেস্ট সিরিজ জিতেছেন অস্ট্রেলিয়ায়। এর পরে ধোনি, যিনি ৬০ টেস্টে ক্যাপ্টেন্সি করে জিতেছেন ২৭ টেস্ট, সাফল্যের হার ৪৫ শতাংশ। সৌরভ সেখানে ৪৯ টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে জিতেছেন ২১ টেস্ট, সাফল্য ৪২.৮৫ শতাংশ। আজহার আবার ৪৭ টেস্টে নেতা থেকে জিতেছেন ১৪ টেস্ট, সাফল্য ২৯.৭৮ শতাংশ।
এই তথ্য বলছে, পরিসংখ্যানের দিক থেকে বিরাট টেস্টে সবার চেয়ে এগিয়ে। কিন্তু লাল বল ছেড়ে যদি সাদা বলের দিকে তাকানো যায়? সেখানে ধোনির কাছে কেউ নেই। দুটি বিশ্বকাপ, একটা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেছেন। সেখানে নেতা বিরাটের আইসিসি টুনার্মেন্টগুলোর দিকে তাকালে শুধুই শূন্যতা। ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে উড়ে যাওয়া। ২০১৯ সালে আবার বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে নিউ জিল্যান্ডের সামনে হার। আইসিসি নক আউট টুনার্মেন্টগুলোয় ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন বারবার উঠেছে। যখন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ মাত্র এক বছর দূরে, প্রশ্নটা উঠছে।
স্রেফ ব্যাটিং পারফরম্যান্স যদি দেখা যায়, বিরাটকে নিয়ে প্রশ্ন নেই। বহু ম্যাচ একা ভারতকে জিতিয়েছেন। কিন্তু কিছু সিদ্ধান্ত টিমকে বড় চাপে ফেলে দিয়েছে। যেমন বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ধোনিকে সাত নম্বরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত। হতে পারে টিম ম্যানেজমেন্ট সম্মিলিতভাবে সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কিন্তু ক্যাপ্টেন হিসেবে দায় এড়াতে পারেন না বিরাট। ২০১৪ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরে ধোনি ক্যাপ্টেন্সি ছেড়ে দেয়ার পরে টেস্ট নেতৃত্ব আসে বিরাটের কাছে। অর্থাৎ ছয় বছর হয়ে গেল, টেস্ট টিমের ক্যাপ্টেন্সি করছেন। আসন্ন টেস্ট সিরিজেও অস্ট্রেলিয়ায় তিনিই ক্যাপ্টেন, যদিও সন্তান জন্মের জন্য প্রথম টেস্টের পরে দেশে ফিরে আসবেন। টেস্ট অধিনায়ক হিসেবেও সব সিদ্ধান্ত বিরাট নির্ভুল নিয়েছেন তা নয়। ইংল্যান্ডে ২০১৮ সালের সিরিজে এজবাস্টনে পূজারাকে না খেলানো বা লর্ডসে কুলদীপ যাদবকে খেলানোর মতো সিদ্ধান্ত বুমেরাং হয়েছিল। দুটি টেস্টেই ভারতকে হারতে হয়। কিন্তু তার পরও বিদেশে অস্ট্রেলিয়ায় সিরিজ জয়ের কারণ একঝাঁক ভালো পেসারের উত্থান। ইশান্ত শর্মার সঙ্গে জশপ্রীত বুমরা ও মোহম্মদ সামি--বিদেশেও যেকোনো টিমের সঙ্গে টক্কর দিতে পারে। বিদেশে এত উঁচু মানের পেস আক্রমণ কিন্তু ধোনি বা সৌরভ তাদের সময়ে পাননি। এমনিতে ভারতীয় নিবার্চকরা যথেষ্ট রক্ষণশীল, সাদা ও লাল বলে আলাদা ক্যাপ্টেন করার মতো সিদ্ধান্ত তাদের নেওয়ার ক্ষমতাই নেই। সেই সিদ্ধান্ত সৌরভ গাঙ্গুলি ও জয় শাহ নিতে পারেন। আইপিএলে বছর পর বছর মুম্বইকে চ্যাম্পিয়ন করার পরে রোহিত শর্মার একটা দাবিও জন্মায়। আবার বিরাট ভক্তরা বলছেন, রোহিতের মুম্বইয়ের মতো ব্যালান্সড টিম বেঙ্গালুরুতে বিরাট পাননি। প্রতিবারই ব্যালান্সের অভাবে ভুগতে হয়েছে।
যুক্তি, পাল্টা যুক্তি থাকবেই। রোহিতের অস্ট্রেলিয়া যাওয়া নিয়ে যে নাটক হয়েছে, তাতে সাদা বলে ক্যাপ্টেন আর ভাইস ক্যাপ্টেনে কতটা যোগাযোগ, তা নিয়েও একরাশ প্রশ্ন। ভাইস ক্যাপ্টেন দেশে ফিরছেন, সেটাই নাকি ক্যাপ্টেন জানতেন না! সামনে বিশ্বকাপ। দেশের মাঠে। ইগোর সংঘাত বন্ধ না হলে ফের গল্প কিন্তু 'হাতে রইল পেন্সিল' হয়ে যেতে পারে।
সূত্র : এই সময়