‘দি হান্ড্রেড’ : মহানবী সা. সম্পর্কে যা বলেছিলেন মাইকেল হার্ট
‘দি হান্ড্রেড’ - ছবি : সংগৃহীত
মাইকেল এইচ হার্ট একজন প্রখ্যাত আমেরিকান লেখক। তিনি বিশ্বের ইতিহাস, মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও সভ্যতার বিকাশে, মানবমণ্ডলীর চিন্তাধারা ও জীবনপ্রণালীতে সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী বিভিন্ন মহামানবের জীবন ও কর্মধারা বিশ্লেষণ করে একশজন বিশিষ্ট ব্যক্তির একটি তালিকা প্রস্তুত করেছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন ধর্ম-প্রচারক, দার্শনিক, চিন্তাবিদ, আবিষ্কারক, বিজ্ঞানী, রাষ্ট্রনায়ক, শিল্পী, সমরনায়ক ইত্যাদি বিভিন্ন শ্রেণির মনীষী ও ক্ষমতাধর ব্যক্তির নাম। মানব সভ্যতার ইতিহাসে সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তি হিসাবে তিনি মুহম্মদুর রাসূলুল্লাহ সা:-এর নাম উল্লেখ করেছেন। এজন্য তিনি তাঁর মতের সমর্থনে জোরালো যুক্তি ও বিভিন্ন বাস্তব নিদর্শন উল্লেখ করেছেন।
লেখক নিজে খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও খ্রিষ্টান ধর্ম-প্রচারক যিশুখ্রিষ্টকে তিন নম্বরে স্থান দিয়েছেন। বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক আইজ্যাক নিউটনকে দুই নম্বরে, বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধকে চার নম্বরে, চীনের ধর্মগুরু কনফুসিয়াসকে পাঁচ, সেন্ট পলকে ছয়, শা. আই. লুনকে সাত, জোহান গুটেনবার্গকে আট, ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে নয়, বৈজ্ঞানিক আলবার্ট আইনস্টাইনকে দশ, কমিউনিজমের প্রবর্তক কার্ল মার্কসকে এগারো নম্বরে স্থান দিয়েছেন। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত এ গ্রন্থটি সারা বিশ্বে চিন্তাশীল মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। প্রকাশের পর বহুবার বহু দেশে এ গ্রন্থ প্রকাশিত ও ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। গ্রন্থের পূর্ণ শিরোনাম : THE HUNDRED - A Ranking of The Most Influential Persons in History. বাংলাভাষী পাঠকের সুবিধার জন্য এখানে ‘মুহম্মদ’ শিরোনামের প্রথম প্রবন্ধটি বাংলায় অনূদিত হলো। -অনুবাদ}
মুহাম্মদ (৫৭০-৬৩২)
পৃথিবীর সর্বাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় আমি মুহম্মদের সা: নাম সর্বশীর্ষে স্থান দেয়ায় পাঠকরা অনেকেই হয়তো বিস্মিত হয়েছেন, অনেকের মনে হয়তো এ ব্যাপারে প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে। কিন্তু আমার বিবেচনায়, তিনি মানব-ইতিহাসে একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ধর্মীয় ও জাগতিক উভয় ক্ষেত্রে সর্বাধিক সফল। অতি সাধারণ অবস্থা থেকে মুহম্মদ সা: বিশ্বের অন্যতম প্রধান একটি ধর্ম আবিষ্কার ও প্রবর্তন করেন এবং অত্যন্ত প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা হিসাবে গণ্য হন। তাঁর ইন্তেকালের পর তেরো শো বছর (১৯৮১ সালের হিসাবে) অতিক্রান্ত হলেও তাঁর প্রভাব অত্যন্ত শক্তিশালী ও সর্বব্যাপী বিরাজমান।
এ গ্রন্থে যেসব ব্যক্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশেরই জন্ম এবং বসবাস উন্নত সভ্যতা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন অঞ্চলে। অন্য দিকে, মুহম্মদ সা:-এর জন্ম ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে আরবের দক্ষিণাঞ্চলে মক্কা নগরীতে। তখন মক্কা নগরী ছিল একটি পশ্চাৎপদ এলাকাÑ ব্যবসা-বাণিজ্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিক্ষার কেন্দ্র থেকে বহু দূরে। জন্মের পূর্বেই তাঁর পিতৃ-বিয়োগ ঘটে, ছয় বছর বয়সে তাঁর মাতৃ-বিয়োগ ঘটে। এতিম অবস্থায় তাঁর শৈশব জীবন অতিবাহিত হয় অতি সাধারণ অবস্থায়। তাঁর জীবনীকারদের থেকে জানা যায়, তিনি ছিলেন নিরক্ষর। পঁচিশ বছর বয়সে তিনি এক ধনাঢ্য বিধবা রমণীকে বিয়ে করার পর তাঁর আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়। তা সত্ত্বেও চল্লিশ বছরে উত্তীর্ণ হওয়ার সময় পর্যন্ত তিনি কোনো গণ্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন না।
আরবের অধিকাংশ লোক ঐ সময় ছিল মরুচারী বেদুঈন। তারা বহু দেব-দেবতায় বিশ্বাস করত। ওই সময় মক্কায় অতি অল্পসংখ্যক ইহুদি ও খ্রিষ্টানের বসবাস ছিল। ইহুদি ও খ্রিষ্টান ধর্মে এক বিশ্ব¯্রষ্টার কথা বলা হয়েছে। তিনি তাদের নিকট থেকে সম্ভবত একেশ্বরবাদের ধারণা প্রথম লাভ করেন। তারপর চল্লিশ বছর বয়সে মুহম্মদের সা: ওপর ওহি নাযিল হয় এবং তিনি তৌহিদ বা একেশ্বরবাদের প্রচার শুরু করেন।
নুবওত প্রাপ্তির প্রথম তিন বছর মুহম্মদ সা: গোপনে শুধু নিকটজনদের কাছে ইসলাম প্রচার করেন। ৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করেন। ইসলামে দীক্ষিত লোকের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় মক্কার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা শঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং ইসলাম প্রচারে তাঁকে নানাভাবে বাধা দিতে থাকে। তাদের অত্যাচারের মাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে হত্যা করার ষড়ষন্ত্র করায় তিনি ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা থেকে দু’শো মাইল দূরে মদিনায় হিজরত করেন। মদিনাবাসীগণ তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে এবং সেখানে গিয়ে তিনি নগররাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করে রাষ্ট্রষন্ত্র পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেন।
হিজরত রাসূলের সা: জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। মক্কায় তাঁর স্বল্পসংখ্যক অনুসারী ছিলেন। মদিনায় তাঁর অনুসারীর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং এর ফলে তাঁর প্রভাবও বৃদ্ধি পায় এবং নেতৃত্বের গুণে তিনি একচ্ছত্র কর্তৃত্ব লাভ করেন। পরবর্তী কয়েক বছর মুহম্মদের সা: অনুসারীর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে মক্কার কাফিরদের বিরুদ্ধে একের পর এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে মুহম্মদের সা: মক্কা বিজয়ের পর এ যুদ্ধের অবসান ঘটে। এর পরবর্তী আড়াই বছরে তাঁর ইন্তেকালের সময় পর্যন্ত আরবের বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা সকলে দলে দলে নতুন ধর্মে দীক্ষিত হয়। ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে মুহম্মদের সা: ইন্তেকালের সময়ে তিনি প্রকৃতপক্ষে সমগ্র দক্ষিণ আরবের একচ্ছত্র আধিপত্য লাভ করেন।
আরবের বেদুঈন গোত্রের লোকেরা দুর্ধর্ষ বীরযোদ্ধা হিসেবে খ্যাত। কিন্তু তাদের সংখ্যা ছিল ক্ষুদ্র এবং তারা নানা গোত্রে বিভক্ত ও পরস্পর দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতে লিপ্ত। বড় কোনো রাষ্ট্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়বার বা উত্তর আরবের কৃষিপ্রধান স্থায়ী অধিবাসীদের সাথে মোকাবেলা করার কোনো শক্তি-সামর্থ্য ছিল না। মুহম্মদের সা: নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে, এক আল্লার ওপর দৃঢ় ঈমান এনে এ ক্ষুদ্র শক্তি তাদের ইতিহাসে প্রথমবার একের পর এক মানব ইতিহাসের বিস্ময়কর সব বিজয়াভিযান সম্পন্ন করে। আরবের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বৃহৎ পারসিক সাম্রাজ্য, উত্তর-পশ্চিম আরবের শক্তিধর বাইজেন্টাইন অথবা কনস্টান্টিনোপলের রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে এ বিস্তীর্ণ এলাকায় ইসলামের বিজয়-পতাকা উড্ডীন করে। সংখ্যার দিক দিয়ে আরবরা প্রতিপক্ষের সমকক্ষ নয়। যুদ্ধের ময়দানে ঈমানী শক্তির বলে বলীয়ান আরব বাহিনী দ্রুত যুদ্ধ জয় করে মেসোপটেমিয়া, সিরিয়া এবং ফিলিস্তিন দখল করে নেয়। ৬৪২ খ্রিষ্টাব্দে আরবরা বাইজেন্টাইনীয়দের থেকে মিসর দখল করে নেয়। ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে কাদেসিয়া প্রান্তরে বিশাল পারস্য বাহিনীকে পরাস্ত করে এবং ৬৪২ খ্রিষ্টাব্দে নেভাভেন্দ যুদ্ধে জয়লাভ করে।
মুহম্মদের সা: বিশ্বস্ত সহচর আবু বকর রা: ও ওমর ইবনুল খাত্তাবের রা: নেতৃত্বে এসব বিস্ময়কর বিজয়াভিযান পরিচালিত হয়। কিন্তু আরবরা এখানেই থেমে থাকেনি। ৭১১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে আরব বাহিনী উত্তর আফ্রিকার সমগ্র ভূ-ভাগ দখল করে আটলান্টিকের তীর পর্যন্ত আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত করে। সেখান থেকে তাদের সমরাভিযান উত্তর দিকে পরিচালিত হয় এবং জিব্রাল্টার (জাবালুত্ তারিক) প্রণালী পাড়ি দিয়ে সমগ্র স্পেনে আধিপত্য বিস্তার করে।
একসময় সমগ্র খ্রিষ্টান ইউরোপের ওপর মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশেষে ৭৩২ খ্রিষ্টাব্দে মধ্য ফ্রান্সের বিখ্যাত ‘তুর যুদ্ধক্ষেত্রে’ মুসলিম বাহিনী ফরাসি বাহিনীর হাতে পরাজয় বরণ করে। তা সত্ত্বেও আরব বেদুঈন বাহিনী মুহম্মদের সা: শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে আটলান্টিকের সমুদ্রোপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত ভূ-ভাগ দখল করে বিশ্বে সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। তাছাড়া, মুসলিম বাহিনী যেসব এলাকা দখল করে, সেসব এলাকার বিপুলসংখ্যক মানুষ ক্রমান্বয়ে নতুন ধর্মমতে দীক্ষিত হয়।
অবশ্য মুসলিম বাহিনী যেসব এলাকা দখল করে পরবর্তীতে তার কোনো কোনো এলাকায় তাদের আধিপত্য স্থায়ী হয়নি। ইরানের জনগণ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হলেও পরবর্তীতে তারা আরবের আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়ে তাদের স্বাধীন সত্তা পুনরুদ্ধার করে। মুসলিম বিজয়ের সাত শ’ বছর পর স্পেনীয়রা যুদ্ধ করে আরবদেরকে পরাজিত করে সমগ্র স্পেনকে পুনরায় খ্রিষ্টান রাষ্ট্রে পরিণত করে। অবশ্য প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি মেসোপটেমিয়া ও মিসরে আরবদের আধিপত্য বহাল থাকে। অনুরূপভাবে, উত্তর আফ্রিকার সমুদ্রোপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগে আরবদের আধিপত্য বহাল থাকে। তাছাড়া, ইসলামের প্রচারকার্য শুধু আরবদের অধিকারভুক্ত এলাকায় নয়, বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং ক্রমান্বয়ে আফ্রিকা, মধ্য এশিয়া, পাকিস্তান, পূর্ব ভারত, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষ নতুন ধর্মে দীক্ষিত হয়। ইন্দোনেশিয়ায় ইসলাম রাষ্ট্রীয় ঐক্যের ভিত্তি রচনা করে। অন্য দিকে, ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম বিরোধ ঐক্যের পথে অন্তরায় হয়ে দেখা দেয়।
এসব বিষয় পর্যালোচনা করে মানবজাতির ইতিহাসে মুহম্মদের সা: প্রভাব কতটা তা নিরূপণ করা যেতে পারে। অন্য সব ধর্মের মতো ইসলামের প্রভাব তার অনুসারীদের জীবনে অত্যন্ত প্রবল। এ কারণে বিশ্বের প্রধান প্রধান ধর্মের সব প্রবর্তককে এ গ্রন্থে যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। সারা বিশ্বে মুসলিমদের তুলনায় খ্রিষ্টানদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হওয়া সত্ত্বেও কেন যিশুখ্রিষ্টের ওপরে মুহম্মদকে সা: স্থান দেয়া হয়েছে, সেটা অনেককে হয়তো বিস্মিত করবে। প্রধানত দু’টি কারণে আমি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। প্রথমত, মুহম্মদ সা: তাঁর অনুসারীদের ইসলামের নীতি-আদর্শ ও শিক্ষায় এমনভাবে উদ্বুদ্ধ-অনুপ্রাণিত করেন, যিশুখ্রিষ্ট অনুরূপভাবে তাঁর ধর্মাদর্শ খ্রিষ্টানদের মধ্যে সেভাবে প্রচার করতে পারেননি। অবশ্য যিশুখ্রিষ্ট খ্রিষ্টবাদের মূল তত্ত্ব ও নৈতিকতা (যতটুকু ইহুদিদের থেকে স্বতন্ত্র) শিক্ষা দিয়ে গেলেও খ্রিষ্টধর্মের প্রচার-প্রবর্তনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন তাঁর অনুসারী সেন্ট পল। সেন্ট পল শুধু খ্রিষ্টান ধর্মাদর্শ প্রবর্তন করেননি, নিউ টেস্টামেন্টের (বাইবেল) একটি বৃহৎ অংশ তিনি পরবর্তীতে সংযোজন করেন।
অন্য দিকে, মুহম্মদ সা: ইসলামের মূলতত্ত্ব, নৈতিকতার মানদণ্ড উভয়ই নিজে প্রবর্তন করে গেছেন। এছাড়া, ইসলামের ধর্মাদর্শের পূর্ণাঙ্গ রূপ তাঁর দ্বারাই সম্পন্ন হয়েছে এবং বাস্তব জীবনে তার অনুসরণ কিভাবে করতে হবে সেটাও তিনি স্বয়ং প্রদর্শন করে গেছেন। উপরন্তু, মুসলিমদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ‘কুরআনে’র পূর্ণাঙ্গ রূপ তাঁর মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে মুহম্মদের সা: ওপর নাজিলকৃত বাণীর সমষ্টিই কুরআন। তাঁর ওপর অবতীর্ণ ঐশী বাণী যথাযথরূপে হিফ্জ করা হয় এবং মুহম্মদের সা: ইন্তেকালের অত্যল্পকাল পরে তা একত্রে সঙ্কলিত হয়। যিশুখ্রিষ্টের বাণী এভাবে সংরক্ষিত হয়নি। যদিও খ্রিষ্টানদের নিকট বাইবেল যেমন পবিত্র ও অনুসরণীয়, মুসলিমদের নিকট কুরআন তেমনি পবিত্র ও অনুসরণীয়, তবে কুরআনের আলোকে মুহম্মদ সা: মুসলিমদের যেভাবে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করেছেন, তার কোনো তুলনা নেই। ফলে খ্রিষ্টানদের ওপর যিশুখ্রিষ্ট ও সেন্ট পল উভয়ের মিলিত প্রভাব যতটা, মুসলিমদের ওপর মুহম্মদের সা: প্রভাব তা বহুগুণে বেশি। শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে মনে হতে পারে, মানবেতিহাসে যিশুখ্রিষ্টের প্রভাব যতটা, মুহম্মদের সা: প্রভাবও ঠিক অতটাই।
তবে, মুহম্মদ সা: (এক্ষেত্রে যিশুখ্রিষ্ট থেকে ভিন্ন) একাধারে জাগতিক ও ধর্মীয় নেতা। প্রকৃতপক্ষে, আরবদের বিশ্বজয়ের পিছনে তাঁর যে অনন্য অবদান সেটা বিচার করলে মানবজাতির ইতিহাসে তাঁকে সর্বাধিক প্রভাবশালী নেতা হিসাবে গণ্য করতেই হবে।
বিশ্বে এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে যা থেকে এটা সহজেই ধারণা করা চলে যে, সেসব ঘটনার মূল সংঘটক যাঁরা তাঁদের ছাড়াও সে সব ঘটনা সংঘটিত হতে পারত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সিমন বলিভারের জন্ম না হলেও হয়তো দক্ষিণ আমেরিকার উপনিবেশসমূহ স্পেনের অধীনতা থেকে মুক্ত হতে পারত। কিন্তু আরবদের বিশ্বজয় সম্পর্কে এরূপ বলার কোনোই অবকাশ নেই। মুহম্মদের সা: জন্ম না হলে আরবদের পক্ষে বিশ্বজয় কস্মিনকালেও সম্ভব ছিল না। ইতিহাসে অনুরূপ আর একটি বিশ্বজয়ের ঘটনা হলো ত্রয়োদশ শতকে মোঙ্গলদের বিজয়াভিযান, যার মূলে ছিলেন চেঙ্গিস খান। যদিও চেঙ্গিস খানের বিজয়াভিযান ছিল আরবদের তুলনায় অধিকতর বিস্তৃত এলাকাজুড়ে, কিন্তু সে বিজয় স্থায়ী হয়নি। চেঙ্গিস খানের আবির্ভাবের সময় মোঙ্গলদের কর্তৃত্ব যে এলাকায় ছিল, বর্তমানে তাদের আধিপত্য তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
আরবদের বিজয় এ অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইরাক থেকে মরক্কো পর্যন্ত বিস্তৃত ভূ-ভাগ আরব জাতীয়তাবাদের নামে আজ ঐক্যবদ্ধ। এ ঐক্যের মূল ভিত্তি ইসলাম, তাছাড়া সাধারণ ভাষা, ইতিহাস ও সংস্কৃতিও এ ঐক্যকে সংহত করেছে। ইসলামের মূলভিত্তি কুরআন। এ কুরআন আরবি ভাষায় রচিত। সম্ভবত, শুধু এ কারণেই আরবি ভাষা বিগত তেরো শ’ বছর বিচ্ছিন্ন ও বিভিন্ন আঞ্চলিকরূপে বিভক্ত হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছে। (কুরআনের উৎকৃষ্ট ভাষাভঙ্গি আরবি ভাষার উৎকর্ষ সাধন ও সংহতি রক্ষায় সহায়ক হয়েছে।Ñ অনুবাদক) বিভিন্ন আরব দেশের মধ্যে মতবিরোধ ও বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও ঐক্যসূত্র রচনায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বিদ্যমান রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইরান ও ইন্দোনেশিয়া দু’টি তেল-উৎপাদনকারী ইসলামী রাষ্ট্র ১৯৭৩-৭৪ সালের শীত মৌসুমে একসাথে তেল-অবরোধে অংশগ্রহণ করে। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, সবগুলো আরব দেশ এবং শুধু আরব দেশসমূহ অনাবর ইরান ও ইন্দোনেশিয়ার সাথে তেল-অবরোধে ঐক্যবদ্ধ হয়।
এ থেকে ধারণা করা চলে, সপ্তম শতকে আরবদের (ইসলামের) যে বিজয় অভিযান পরিচালিত হয়েছিল, অদ্যাবধি মানবেতিহাসে তার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিদ্যমান। ধর্মীয় ও জাগতিক উভয় ক্ষেত্রে এ অসাধারণ সমন্বয় সাধনে আমার বিবেচনায় মুহম্মদের সা: যে অনন্য অবদান সে কারণে তিনি এককভাবে মানবেতিহাসের সর্বাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত হওয়ার যোগ্য।