রোগীদের কেন এসব পরীক্ষা করতে বলেন চিকিৎসকেরা
রোগীদের কেন এসব পরীক্ষা করতে বলেন চিকিৎসকেরা - ছবি : সংগৃহীত
চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক মনে করা হয় হিপোক্রেটিসকে। তবে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক হিসেবে ইবনে সিনা খ্যাত।হিপোক্রেটিস হোক বা ইবনে সিনা অথবা অন্তর্বর্তী সব চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানী, সবারই মূল উদ্দেশ্য চিকিৎসাসেবাকে সর্বসাধারণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া এবং নতুন নতুন পদ্ধতি ও কৌশল আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে রোগমুক্তি ঘটানো। পৃথিবীতে সবচেয়ে মহৎ পেশা ধরা হয় এ পেশাকে। ক্ষেত্রবিশেষে চিকিৎসকদের স্রষ্টার আসনেও বসিয়ে ফেলেন অনেকেই। আবার অনেকেই তাদের তুলনা করেন ‘কসাই’য়ের সাথেও।
বাংলাদেশে সেবা প্রদানকারী প্রায় সকল চিকিৎসকই তাদের কর্মজীবনের কোনো না কোনো মুহূর্তে প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে ‘কসাই’ গালিটি শুনেছেন।এর পেছনে রোগীদের পক্ষ হতে ভুল চিকিৎসা প্রদান, চিকিৎসকের দুর্ব্যবহার, রোগীকে সময় না দেয়া, অহেতুক পরীক্ষা করানো, অপ্রয়োজনীয় ওষুধ প্রেসক্রাইব করার মনো নানা অভিযোগ দেখা যায়।
বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বেশি উঠে আসে ডায়াগনোসিসের বিষয়টা। বেশিরভাগ মানুষই মনে করে, চিকিৎসক হয়তো হাসপাতাল অথবা ক্লিনিক থেকে টেস্টের জন্য নির্দিষ্ট হারে অর্থ কমিশন পান বলেই অতিরিক্ত টেস্ট করানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
চিকিৎসকের সাথে প্যাথলজি প্রতিষ্ঠানের মালিকের সমীকরণ যা-ই হোক না কেন, টেস্টগুলো আদৌ আমাদের প্রয়োজনীয় নাকি অহেতুক, এ বিষয়টি রোগী হিসেবে সকলের জানা প্রয়োজন। কিছু সাধারণ টেস্টের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে সিবিসি, আরবিসি, এস. ক্রিয়েটিনিন, ইসিজি, এসজিপিটি টেস্টগুলো প্রায়ই রোগীদের প্রেসক্রিপশনে পাওয়া যায়।
সিবিসি (কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট) : আমরা প্রায় সবাই জানি, তিন ধরনের কণিকা ও পানির সমন্বয়ে আমাদের রক্ত গঠিত। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য শরীরে রক্তের মাত্রা ঠিক থাকা আবশ্যক। চিকিৎসা বিজ্ঞানে সকল বয়সী নারী ও পুরুষের জন্যই শরীরে রক্তের প্রতিটি উপাদানের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা নির্ধারণ করা রয়েছে। ওই মাত্রার থেকে কম বা বেশি কোনো উপাদান থাকলে তা স্বল্পমেয়াদি অথবা দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন রোগের লক্ষণ বা কারণ হয়ে উঠতে পারে।
আমরা হয়তো অনেকেই জানি না যে আমাদের শরীরের নিজস্ব সুরক্ষা সিস্টেম রয়েছে। রক্তের অন্তর্ভূক্ত শ্বেত কণিকা শরীরকে রক্ষা করে বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত রোগ-বালাইয়ের হাত থেকে। শরীরের শ্বেত কণিকার পরিমাণ কমে গেলে খুব সহজেই বিভিন্ন রোগজীবাণু আক্রমণ করতে পারে। আবার শ্বেত কণিকার পরিমাণ বেড়ে যাওয়াও ক্ষতিকর। নানা প্রয়োজনীয় অণুজীবের বসবাস রয়েছে মানবশরীরে। হজম প্রক্রিয়াসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কাজে এই অণুজীবগুলো অংশ নেয়। কিন্তু শ্বেত কণিকার পরিমাণ বেড়ে গেলে এই অণুজীবগুলো আর টিকে থাকতে পারে না বলে ব্যাহত হয় শরীরের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপও। ফলাফল অসুস্থতা দেখা যায়।
এছাড়াও অস্বাভাবিক কোষবৃদ্ধি বলতে কখনো ক্যান্সার বা টিউমারের মতো মারাত্মক রোগও নির্দেশ করে। তাই সম্পূর্ণ রক্তের হিসাব করা সঠিক চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য যেকোনো চিকিৎসকেরই প্রথম প্রয়োজন।
আরবিসি (র্যান্ডম ব্লাড সুগার) : প্রায় সকল বয়সী ও সব রোগীর চিকিৎসা করার আগেই এখন এ টেস্টটি করানো হয়। আরবিসি মূলত ডায়াবেটিস নির্ধারক একটি পরীক্ষা। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে দেশের প্রায় ৭৩ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন।অনেক সময় শিশুদেরও আরবিসি টেস্ট করানোর পরামর্শ দেয়া হয়। আর রোগীপক্ষের একটি ভুল ধারণা থেকে প্রায়ই আঙুল তোলা হয় দায়িত্বরত চিকিৎসকের ওপর। বেশিরভাগ মানুষই ধারণা করে যে অল্প বয়সে কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে না। এই ধারণা ভুল।
প্রথমত, ডায়াবেটিস বয়সনির্ভর কোনো রোগ নয় এবং সব বয়সী মানুষই রয়েছেন অনারোগ্য এ রোগটির ঝুঁকিতে। দ্বিতীয়ত, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ডায়াবেটিসে সমিতি হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রায় ১৭ হাজার শিশু ডায়াবেটিসে ভুগছে এবং সময়ের সাথে সাথে চক্রবৃদ্ধিহারে এই সংখ্যা আরো বেড়েছে বলে আশঙ্কা করা যায়।
ডায়াবেটিস রোগের মূলত কোনোই চিরস্থায়ী চিকিৎসা নেই। এই রোগ সারাজীবন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। সব বয়সী মানুষই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে। আবার ডায়াবেটিসের কারণে পরে শিকার হতে পারে নানা জটিলতার। তাই যেকোনো চিকিৎসার আগেই এই গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটারটি বিবেচনা করা আবশ্যক। এছাড়াও ডায়াবেটিস রোগীদের বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার মধ্যে থাকতে হয় এবং বিভিন্ন রকম চিনিযুক্ত ওষুধেও তাদের জন্য থাকে বিধিনিষেধ। তাই প্রেসক্রিপশনে ওষুধ লেখার আগে রোগীর ডায়াবেটিসের মাত্রাটা জেনে নেয়া আবশ্যক।
এস ক্রিয়েটিনিন (সিরাম ক্রিয়েটিনিন) : সিরাম ক্রিয়েটিনিন মূলত রক্ত বা ইউরিনে পাওয়া ক্রিয়েটিনিন বা বর্জ্য পদার্থের মাত্রা নিয়ন্ত্রক একটি টেস্ট। কিডনি রক্ত হতে পাওয়া ক্রিয়েটিনিন ও অন্যান্য শরীরের বর্জ্য পদার্থকে ফিল্টার করে ইউরিনের মাধ্যমে দেহ হতে বাইরে নিঃসরণ করে দেয়।সিরাম ক্রিয়েটিনিন টেস্টের মাধ্যমে শরীরে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা সম্পর্কে অবগত হওয়া যায় এবং কিডনি-সম্পর্কিত জটিলতারও সন্ধান পাওয়া যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বয়স্কদেরই এই পরীক্ষাটির আওতায় আনা হয়। ক্ষেত্রবিশেষে অল্প বয়সীদেরও কিডনির এ সাধারণ পরীক্ষাটি করার প্রয়োজন পড়তে পারে। কিডনির যেকোনো জটিলতা ব্যাহত করতে পারে আমাদের দৈনন্দিন জীবনধারাকে এবং দেহে বাসা বাঁধতে পারে জটিল-কঠিন রোগ।
ইসিজি (ইলেক্ট্রোকারডিওগ্রাম) : ইসিজি বা ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম হৃদপিণ্ডের বৈদ্যুতিক কার্যকলাপের মান নির্ধারক একটি পরীক্ষা। এই পরীক্ষার মাধ্যমে হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা সম্পর্কে জানা যায়। ২০১৮ সালে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার একটি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের চল্লিশোর্ধ্ব প্রায় ২৬ ভাগ মানুষই উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে হৃদরোগ থেকে শুরু করে ব্রেইন স্ট্রোক, প্যারালাইসিসের মতো নানারকম সমস্যা হতে পারে। ইসিজি পরীক্ষার মাধ্যমে হাইপারটেনশন, লো ব্লাড প্রেশার, এঞ্জাইনা, ব্লকেজ, হৃদযন্ত্রর ক্ষতসহ অনেক সমস্যার খোঁজ পাওয়া যায়। তাই লক্ষণ পাওয়া গেলে বা বয়স্ক রোগীদের চিকিৎসক ইসিজি টেস্ট করানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
এসজিপিটি (সিরাম গ্লুটামিক পাইরুভিক ট্রান্সামিনেস) : এসজিপিটি লিভারের সমস্যা নির্ধারক একটি টেস্ট। লিভারের কার্যকারিতা ব্যাহত হলে রক্তে এসজিপিটি লেভেল বেড়ে যায়। যেমন হেপাটাইটিস বা জন্ডিসের কারণেও এসজিপিটির পরিমাণ বাড়তে পারে। লিভার আমাদের শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। লিভারের যেকোনো সমস্যার প্রভাব পড়তে পারে পুরো শরীরে।তাই লক্ষণ পাওয়া গেলে ডাক্তার প্রাথমিকভাবে এসজিপিটি লেভেল পরিমাপ করিয়ে নেন এবং তারতম্য পাওয়া গেলে আরো নির্দিষ্ট পরীক্ষার পরামর্শ দেন সঠিক রোগ নির্ণয় করার জন্য।
দিবা-রাত্রির মতো পৃথিবীর সকল ক্ষেত্রেই ভালো-মন্দ, সাদা-কালো, সাধু-অসাধু রয়েছে। কিছু অর্থলোভী চিকিৎসকের কারণে চিকিৎসার মতন মহৎ পেশাটি বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হলেও সকল চিকিৎসককে একই কাতারে ফেলা একেবারেই অনুচিত।একজন চিকিৎসক কখনই জেনেবুঝে তার রোগীকে ভুল চিকিৎসা দেন না। সঠিক চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য প্রথম প্রয়োজন সঠিক রোগ শনাক্ত করা। রোগনির্ণয়ে গোলযোগ থাকলে তার প্রভাব চিকিৎসায় পড়তে বাধ্য। আর ভুল চিকিৎসার কারণে দীর্ঘ বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হতে পারে, এমনকি হতে পারে অন্য কোনো মারণরোগও।
এছাড়াও যেকোনো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। যেমন, প্যারাসিটামল বা ব্যথানাশক ওষুধগুলো লিভারের ওপর প্রভাব ফেলে।অন্যদিকে জ্বরের জন্য প্রথমেই প্যারাসিটামলের কথা যে কেউ চিন্তা করবে। কিন্তু জ্বর সাধারণত কোনো রোগ নয়, রোগের প্রাথমিক লক্ষণ। লিভারের এসজিপিটি টেস্ট না করা থাকলে প্যারাসিটামল জ্বরের রোগীকে সেবন করার পরামর্শ দেয়া হতেই পারে। কিন্তু লিভার সংক্রান্ত জটিলতায় আক্রান্ত একটি রোগীর জন্য প্যারাসিটামল বিষের মতো কাজ করতে পারে ক্ষেত্রবিশেষে।
সবসময় যে চিকিৎসক ইচ্ছাকৃত অহেতুক টেস্ট করানোর পরামর্শ দেন, কথাটি ভিত্তিহীন। চিকিৎসাসেবা নেয়ার দায়িত্বরত চিকিৎসকের প্রতি আস্থা রাখা উচিত। তবে চিকিৎসক যে সর্বদা সঠিক, এমনটিও বিশ্বাস করা ঠিক নয়। সন্দেহজনক কোনো বিষয় থাকলে দ্বিতীয় মতামতের দিকে যাওয়াই ভালো। কিন্তু অবশ্যই দ্বিতীয় ডাক্তারকে আগের চিকিৎসার বৃত্তান্ত খুলে বলতে হবে।
লেখক : এ-গ্রেড ফার্মাসিস্ট
এম.এস. ইন ফার্মাকোলজি (শিক্ষার্থী)
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর