চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা কেন?

মো: বজলুর রশীদ | Dec 03, 2020 05:06 pm
চীনা প্রেসিডেন্ট শি

চীনা প্রেসিডেন্ট শি - ছবি সংগৃহীত

 

তাইওয়ানের আগের নাম ফরমোজা। চীনের মূল ভূখন্ড থেকে ১৫০ মাইল, কোরিয়া থেকে ৬৯০ মাইল এবং ফিলিপাইন থেকে ৭৪৯ মাইল দূরে। ২৪ মিলিয়ন মানুষের বসবাস। ২০১৪ সালে দ্বীপে সানফ্লাওয়ার মুভমেন্ট হয়। ডিপিপির রাজনৈতিক দল আন্দোলন করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এগিয়ে নিয়ে যায় এবং সাই ইং ওয়েন তাইওয়ানের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। নেতারা দাবি করেন, তাইওয়ানের সংসদ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত, প্রেসিডেন্ট গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত। আছে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি ও মন্ত্রণালয়।

বিশ্বের ১৫টি দেশ তাইওয়ানকে সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে স্বীকার করে। ভ্যাটিকানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে। স্বীকৃতি দেয়া দেশ গুয়াতেমালা, হাইতি, হোলিসি, হন্ডুরাস, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, নাউরো, নিকারাগুয়া, পালাউ, পেরাগুয়ে, সেন্ট লুসিয়া, সেন্ট কিটস নেভিস, সেন্ট ভিনসেন্ট, বেলিজ, সুইজারল্যান্ড ও টাভালু। এদের চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই।

সপ্তম শতাব্দীতে ইসলাম চীনে প্রবেশ করে। ১৯৪৯ সালে চীনে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে ২০ হাজার মুসলিম পরিবার চীনের মূল ভূখ- ত্যাগ করে তাইওয়ানে আশ্রয় নেয়। স্থানীয় চীনা মেয়েদের বিয়ে করে মুসলিম জনগোষ্ঠী বৃদ্ধি পায়। এরা ‘হুই’ নামে নতুন মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর জন্ম নেয়। সীমিত আকারে মুসলিম মেয়েরা পর্দা প্রথা মেনে চলে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, তাইওয়ানের নিবন্ধিত মুসলমানের সংখ্যা ৫৩ হাজার। এ ছাড়া ৮৮ হাজার ৫০০ ইন্দোনেশীয় মুসলমান সেখানে কর্মরত। সব মিলে এক লাখ ৩৪ হাজার। পুরো তাইওয়ানে মসজিদ আছে ছয়টি, গণপাঠাগার চারটি এবং প্রকাশনা সংস্থা একটি। চীনা ও মান্দারিন ভাষায় কুরআন ও হাদিস গ্রন্থ পাওয়া যায়।

পেন্টাগন স্টেট ডিপার্টমেন্ট সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে তাইওয়ানে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ও অন্যান্য যুদ্ধবিমানের খুচরা যন্ত্রপাতি বিক্রির সিদ্ধান্ত জানিয়েছে, যার মূল্যমান ৩৩০ মিলিয়ন ডলার। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত এক চীন নীতির বিরুদ্ধে গেছে এবং যুক্তরাষ্ট্র-চীন বলবৎ তিনটি স্মারকের এবং ১৯৭২, ১৯৭৮ এবং ১৯৮২ সালের তিনটি চুক্তির অবমাননা করা হয়েছে বলে চীন অভিযোগ করেছে।

মূলত বহু বছর ধরে আমেরিকা তাইওয়ানে অস্ত্র বিক্রি করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, তাইওয়ানকে অস্ত্রসম্ভারে সমৃদ্ধ করতে পারলে তার প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়বে এবং তাইওয়ান প্রণালীর এপার-ওপারের শক্তির ভারসাম্য মানানসই পর্যায়ে আসবে। ১৯৭৯ সাল থেকে চীনের সাথে চুক্তি বলবৎ থাকা অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি সরকার তাইওয়ানে অস্ত্র বিক্রি করেছে।

আমেরিকা তাইওয়ান প্রণালীতে নিয়মিত যুদ্ধজাহাজ পাঠায় এবং সেখানে নৌবহর অবস্থান করে। লক্ষ্য তাইওয়ান নয়, চীন। তাইওয়ানকে কোনোভাবে কুক্ষিগত করতে পারলে আমেরিকা সেখানে শক্ত ঘাঁটি করতে সক্ষম হবে। এটাই আমেরিকার মূল উদ্দেশ্য।

ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের সাথে ফোনালাপ করে চীনকে ক্ষেপিয়ে দেন। আগের কোনো প্রেসিডেন্ট এরকম করেননি। তারা চীনের বিরোধিতা করলেও ‘এক চীন’ নীতিতে সরাসরি আঘাত থেকে বিরত ছিলেন। ট্রাম্প বলতেন, চীনা প্রশ্নে তাইওয়ান কার্ড সবসময়ই ব্যবহারযোগ্য। তিনি চীনকে সবসময় একটা ঝুঁকি ও বিপদের মাঝে রাখতে পছন্দ করতেন। ফলে চীন পুরোপুরি ট্রাম্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বিগত নির্বাচনে প্রকাশ্যে বাইডেনকে সাপোর্ট দেয়। রাশিয়া ও ইরানও ট্রাম্পের বিরোধিতা করে। চলতি বছর মার্চে ট্রাম্প তাইওয়ান ভ্রমণ অ্যাক্টকে আইনে পরিণত করেন। ফলে মার্কিন কর্মকর্তারা ইচ্ছেমতো তাইওয়ান সফরে যেতে এবং তাইওয়ান বিষয়ে বেশি অংশগ্রহণ করতে পারবেন।

২০১৮ সালে ট্রাম্প ৩৩০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির সিদ্ধান্ত নিলে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে ভাঙন আরম্ভ হয়। কিন্তু ওয়াশিংটন তাইওয়ানকে অস্ত্র দেয়া অব্যহাত রাখে। তাইওয়ান মনে করে, অত্যাধুনিক অস্ত্র ও মারণাস্ত্র ছাড়া তার নিরাপত্তা রক্ষা সম্ভব নয়। তাই তারা হাই এন্ড অস্ত্রের জন্য ওয়াশিংটনকে চাপ দিতে থাকে। ট্রাম্প রাজি হননি।

এ বছর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে তাইওয়ান উন্নত মানের সাবমেরিন নিজ দেশে তৈরি করছে। তারা স্পষ্ট করেই বলছে, চীনের মিলিটারি ‘থ্রেট’ থেকে আত্মরক্ষার জন্য এই পদক্ষেপ। এই প্রকল্পে আটটি সাবমেরিন তৈরি হবে। বর্তমানে তাইওয়ানের চারটি সাবমেরিন আছে। এর মধ্যে দুটি সেকেলে। আধুনিক সাবমেরিন তৈরির জন্য তাইওয়ান নতুন ডিজাইনে কাওশিওং শিপইয়ার্ড সাজিয়েছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের তাইওয়ান কার্ড চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বিনষ্টের বড় কারণ। বাণিজ্য সঙ্ঘাত নিয়ে চীনকে আঘাত করতে তাইওয়ানকে ব্যবহার করলে সুবিধা হবে না এটি ট্রাম্প বুঝতেন। তাইওয়ানে চীনা ভূখন্ডের মানুষ ও তাদের রক্ত সম্পর্কীয় লোকজনও রয়েছে। চীনের প্রশাসন তাইওয়ানকে মর্যাদা দিলেও নিজের ভূখন্ড মনে করে। সেখানে যেকোনো রকম কর্মতৎপরতা চীন সহ্য করবে না। এটা জেনেও ট্রাম্প প্রশাসন তাইওয়ানকে সামরিকভাবে সমৃদ্ধ করেছে। তাইওয়ানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ না করে তার সামরিক সম্ভার বৃদ্ধির প্রয়াস পেয়েছে। কিন্তু চীনের সাথে যুদ্ধ করে তাইয়ান নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে সে এক অবান্তর ও অবাস্তব বিষয়। তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট ছাড়া এমনটি কেউ ভাবে না। কোল্ড ওয়ার পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্ট তাইওয়ান কার্ড খেলে সুবিধা অর্জন করতে পারেননি। সমালোচকরা মনে করেন, ছোটখাটো লাভের জন্য বড় ক্ষতির সম্মুখীন না হওয়ার জন্য ট্রাম্প অতীতের নেতাদের থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেননি।

চলতি বছর ১৮ সেপ্টেম্বর তাইওয়ান প্রণালীতে ১৮টি চীনা বিমানের মহড়া চলাকালে বেশ কয়েকটি জঙ্গিবিমান ধ্বংস করে দিয়েছে তাইওয়ান। যুক্তরাষ্ট্র ও তাইওয়ানের মধ্যে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে তার নিন্দা জানিয়ে এই যুদ্ধ মহড়ার ঘোষণা দেয় চীন। চীনের বিমানগুলো তাইওয়ান প্রণালীর মিডলাইন পেরোনোর অভিযোগ আনে তাইওয়ান। চীনা জঙ্গিবিমানগুলো যে পথ দিয়ে উড়ে গেছে তার একটি মানচিত্র দেখিয়ে তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রমাণ দিয়েছে, কোনো পক্ষের জঙ্গি বিমান সাধারণত এই মিডলাইন পেরোয় না। কিন্তু এবার তাইওয়ানের ভাষ্যমতে, চীন সেখানে অনেকগুলো জঙ্গিবিমান উড়িয়েছে। চীন বলেছে, এই ঘটনার জবাব দেয়া হবে।

যুক্তরাষ্ট্র আবার ২.৩৭ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করছে তাইওয়ানে। রকেট লঞ্চার, রিকনেসেন্স সেন্সর, আর্টিলারিও রয়েছে তালিকায়। আরো আছে ৬৪ এম ৫৭ ইউনাটারি টেকটিকাল মিসাইল, এই মিসাইল চীনা মূল ভূখন্ডে আঘাত হানতে সক্ষম। এছাড়া আছে অন্যান্য অস্ত্র। বলা হচ্ছে, আক্রমণকারী অর্ধেক সেনা, যুদ্ধের প্রথম ঘণ্টায়, এসব অস্ত্রের আঘাতে মত্যুবরণ করবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ৪০ বছরে আক্রমণাত্মক অস্ত্র কেনার প্রথম ঘটনা এটি। তাইয়ানের প্রচুর কর্মকর্তা চীনের সাথে সঙ্ঘাত চান না। তাইওয়ানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়ান জি ফা বলেন, ‘এসব অস্ত্র আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ শক্তিশালী করবে।’

ইন্দো-প্যাসিফিক ও তাইওয়ান প্রণালীর সুরক্ষায়ও কাজে লাগবে। এদিকে চীনও ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিয়েছে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানিয়েছেন, তাইওয়ানের সাথে চীনের তিনটি চুক্তি রয়েছে এর একটি অস্ত্র সংগ্রহ ও নিরাপত্তা বিষয়ক। তাইওয়ান প্রণালীর নিরাপত্তার জন্য এসব চুক্তিকে যথেষ্ট মনে করা হয় এবং এতদিন তাই হয়ে আসছে। ওয়াশিংটন অস্ত্র বিক্রি ও ঘন ঘন সফরের মাধ্যমে তাইওয়ান প্রণালীকে উতপ্ত করছে। চীন আমেরিকার কোম্পানিগুলোকে বিশেষ করে বোয়িং, লকহিড ও রিথিউনের অস্ত্র বিক্রির ওপর অবরোধ দিয়েছিল। এসব অবরোধ বেশির ভাগ ছিল কাগুজে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সেখানে এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান পাঠিয়েছে। ১৯৯০ সালে তাইওয়ান ফ্রান্স থেকে অ্যাডভান্সড মিসাইল ইন্টারফিয়ারেন্স সিস্টেম কিনেছিল। সেটি এ বছর আরো আপগ্রেড করার কাজ চলছে।

রাজধানী তাইপেতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য ফরমোসা অ্যালায়েন্স নামের একটি সংগঠন অনেক দিন ধরে বিক্ষোভ করে আসছে। বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েনের দল ডেমোক্র্যাটিক প্রোগ্রেসিভ পার্টিকে (ডিপিপি) গণভোটের জন্য চাপ দেয়। ডিপিপি বর্তমান প্রেসিডেন্টের দল।
চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, “কোনো শক্তিই চীনের ‘পুনরেকত্রীকরণ’ প্রক্রিয়া রোধ করতে পারবে না।”

পুনরেকত্রীকরণ নিশ্চিত করতে তাইওয়ানে চীনের শক্তি প্রয়োগেরও অধিকার আছে বলে মনে করে বেইজিং। তাইওয়ানকে চীন তাদের বিচ্ছিন্ন প্রদেশ হিসেবেই মনে করে এবং এক্ষেত্রে তারা ‘এক দেশ, দুই নীতি’ মেনে চলে। তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘চীনের আদর্শ হচ্ছে কমিউনিজম এবং তাইওয়ানের গণতন্ত্র, কিভাবে দুটি একত্র হবে বোধগম্য নয়।’ ১৯৪৯ সালে মূল ভূখন্ডের সাথে গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে যদিও চীন ও তাইওয়ান আলাদাভাবে শাসিত হচ্ছে। তাউওয়ান একসময় ওলন্দাজ কলোনি ছিল। তবে ১৬৮৩ থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত চীনের রাজারাই শাসন করেছে তাইওয়ান। ঐতিহাসিকভাবেই তাইওয়ান মূল চীনের।
তাইওয়ানে যারা যুদ্ধের জন্য অধীর তাদের বার্তা দিতে প্রেসিডেন্ট শি বলেন, ‘তাইওয়ানকে অবশ্যই মূল ভূখন্ডের সাথে মিশতে হবে। তাইওয়ানের স্বাধীনতা দিবস মৃত্যুর শেষ প্রান্তে পৌঁছেছে।’ শি বলেন, ‘একত্র হওয়ার জন্য হংকং মডেলকে তাইওয়ান অনুসরণ করতে পারে। রাজনৈতিক পার্থক্য ঘুচিয়ে আনতে, এক দেশ দুই সিস্টেম মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে।’

স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তিতে এই বার্তা পেয়ে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েন সাত তাড়াতাড়ি জবাব দেন, তাইওয়ানের বেশির ভাগ জনগণ ‘এক দেশ দুই সিস্টেম’ পছন্দ করে না। সরকারের সাথে সরকারের আলাপ-আলোচনা হতে পারে। বেইজিংয়ের উচিত দ্বীপ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে সম্মান দেখানো।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us