তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন রণতরী কেন?
মার্কিন রণতরী - ছবি সংগৃহীত
বিশ্বের ১৫টি দেশ তাইওয়ানকে সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে স্বীকার করে। ভ্যাটিকানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে। স্বীকৃতি দেয়া দেশ গুয়াতেমালা, হাইতি, হোলিসি, হন্ডুরাস, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, নাউরো, নিকারাগুয়া, পালাউ, পেরাগুয়ে, সেন্ট লুসিয়া, সেন্ট কিটস নেভিস, সেন্ট ভিনসেন্ট, বেলিজ, সুইজারল্যান্ড ও টাভালু। এদের চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই।
সপ্তম শতাব্দীতে ইসলাম চীনে প্রবেশ করে। ১৯৪৯ সালে চীনে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে ২০ হাজার মুসলিম পরিবার চীনের মূল ভূখ- ত্যাগ করে তাইওয়ানে আশ্রয় নেয়। স্থানীয় চীনা মেয়েদের বিয়ে করে মুসলিম জনগোষ্ঠী বৃদ্ধি পায়। এরা ‘হুই’ নামে নতুন মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর জন্ম নেয়। সীমিত আকারে মুসলিম মেয়েরা পর্দা প্রথা মেনে চলে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, তাইওয়ানের নিবন্ধিত মুসলমানের সংখ্যা ৫৩ হাজার। এ ছাড়া ৮৮ হাজার ৫০০ ইন্দোনেশীয় মুসলমান সেখানে কর্মরত। সব মিলে এক লাখ ৩৪ হাজার। পুরো তাইওয়ানে মসজিদ আছে ছয়টি, গণপাঠাগার চারটি এবং প্রকাশনা সংস্থা একটি। চীনা ও মান্দারিন ভাষায় কুরআন ও হাদিস গ্রন্থ পাওয়া যায়।
পেন্টাগন স্টেট ডিপার্টমেন্ট সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে তাইওয়ানে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ও অন্যান্য যুদ্ধবিমানের খুচরা যন্ত্রপাতি বিক্রির সিদ্ধান্ত জানিয়েছে, যার মূল্যমান ৩৩০ মিলিয়ন ডলার। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত এক চীন নীতির বিরুদ্ধে গেছে এবং যুক্তরাষ্ট্র-চীন বলবৎ তিনটি স্মারকের এবং ১৯৭২, ১৯৭৮ এবং ১৯৮২ সালের তিনটি চুক্তির অবমাননা করা হয়েছে বলে চীন অভিযোগ করেছে।
মূলত বহু বছর ধরে আমেরিকা তাইওয়ানে অস্ত্র বিক্রি করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, তাইওয়ানকে অস্ত্রসম্ভারে সমৃদ্ধ করতে পারলে তার প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়বে এবং তাইওয়ান প্রণালীর এপার-ওপারের শক্তির ভারসাম্য মানানসই পর্যায়ে আসবে। ১৯৭৯ সাল থেকে চীনের সাথে চুক্তি বলবৎ থাকা অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি সরকার তাইওয়ানে অস্ত্র বিক্রি করেছে।
আমেরিকা তাইওয়ান প্রণালীতে নিয়মিত যুদ্ধজাহাজ পাঠায় এবং সেখানে নৌবহর অবস্থান করে। লক্ষ্য তাইওয়ান নয়, চীন। তাইওয়ানকে কোনোভাবে কুক্ষিগত করতে পারলে আমেরিকা সেখানে শক্ত ঘাঁটি করতে সক্ষম হবে। এটাই আমেরিকার মূল উদ্দেশ্য।
ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের সাথে ফোনালাপ করে চীনকে ক্ষেপিয়ে দেন। আগের কোনো প্রেসিডেন্ট এরকম করেননি। তারা চীনের বিরোধিতা করলেও ‘এক চীন’ নীতিতে সরাসরি আঘাত থেকে বিরত ছিলেন। ট্রাম্প বলতেন, চীনা প্রশ্নে তাইওয়ান কার্ড সবসময়ই ব্যবহারযোগ্য। তিনি চীনকে সবসময় একটা ঝুঁকি ও বিপদের মাঝে রাখতে পছন্দ করতেন। ফলে চীন পুরোপুরি ট্রাম্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বিগত নির্বাচনে প্রকাশ্যে বাইডেনকে সাপোর্ট দেয়। রাশিয়া ও ইরানও ট্রাম্পের বিরোধিতা করে। চলতি বছর মার্চে ট্রাম্প তাইওয়ান ভ্রমণ অ্যাক্টকে আইনে পরিণত করেন। ফলে মার্কিন কর্মকর্তারা ইচ্ছেমতো তাইওয়ান সফরে যেতে এবং তাইওয়ান বিষয়ে বেশি অংশগ্রহণ করতে পারবেন।
২০১৮ সালে ট্রাম্প ৩৩০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির সিদ্ধান্ত নিলে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে ভাঙন আরম্ভ হয়। কিন্তু ওয়াশিংটন তাইওয়ানকে অস্ত্র দেয়া অব্যহাত রাখে। তাইওয়ান মনে করে, অত্যাধুনিক অস্ত্র ও মারণাস্ত্র ছাড়া তার নিরাপত্তা রক্ষা সম্ভব নয়। তাই তারা হাই এন্ড অস্ত্রের জন্য ওয়াশিংটনকে চাপ দিতে থাকে। ট্রাম্প রাজি হননি।
এ বছর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে তাইওয়ান উন্নত মানের সাবমেরিন নিজ দেশে তৈরি করছে। তারা স্পষ্ট করেই বলছে, চীনের মিলিটারি ‘থ্রেট’ থেকে আত্মরক্ষার জন্য এই পদক্ষেপ। এই প্রকল্পে আটটি সাবমেরিন তৈরি হবে। বর্তমানে তাইওয়ানের চারটি সাবমেরিন আছে। এর মধ্যে দুটি সেকেলে। আধুনিক সাবমেরিন তৈরির জন্য তাইওয়ান নতুন ডিজাইনে কাওশিওং শিপইয়ার্ড সাজিয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের তাইওয়ান কার্ড চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বিনষ্টের বড় কারণ। বাণিজ্য সঙ্ঘাত নিয়ে চীনকে আঘাত করতে তাইওয়ানকে ব্যবহার করলে সুবিধা হবে না এটি ট্রাম্প বুঝতেন। তাইওয়ানে চীনা ভূখন্ডের মানুষ ও তাদের রক্ত সম্পর্কীয় লোকজনও রয়েছে। চীনের প্রশাসন তাইওয়ানকে মর্যাদা দিলেও নিজের ভূখন্ড মনে করে। সেখানে যেকোনো রকম কর্মতৎপরতা চীন সহ্য করবে না। এটা জেনেও ট্রাম্প প্রশাসন তাইওয়ানকে সামরিকভাবে সমৃদ্ধ করেছে। তাইওয়ানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ না করে তার সামরিক সম্ভার বৃদ্ধির প্রয়াস পেয়েছে। কিন্তু চীনের সাথে যুদ্ধ করে তাইয়ান নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে সে এক অবান্তর ও অবাস্তব বিষয়। তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট ছাড়া এমনটি কেউ ভাবে না। কোল্ড ওয়ার পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্ট তাইওয়ান কার্ড খেলে সুবিধা অর্জন করতে পারেননি। সমালোচকরা মনে করেন, ছোটখাটো লাভের জন্য বড় ক্ষতির সম্মুখীন না হওয়ার জন্য ট্রাম্প অতীতের নেতাদের থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেননি।