অনিদ্রা কী, কেন ও তার প্রতিকার
অনিদ্রা - ছবি সংগৃহীত
ভালো ঘুম শান্তি ও সুস্থতার প্রতীক। সবারই কাম্য রাতে কয়েক ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন ঘুম, তারপর সারা দিন ফ্রেশ থাকা; যাতে দৈনন্দিন জীবনে স্বাভাবিক বোধ হয়। অনেক সময় তাতে ব্যত্যয় ঘটতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, তিনজনের মধ্য একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ঘুমের সমস্যা থাকতে পারে। যা হোক, অনেক কিছু আছে যা করে আপনি আপনাকে সাহায্য করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ নির্দিষ্ট খাবার ও পানীয় এড়িয়ে যাওয়া এবং রাতে নির্দিষ্ট সময় ঘুমানো। অনিদ্রার ব্যাপারগুলো আমরা ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করব।
১. স্বাভাবিক ঘুম বলতে কী বুঝি?
২. অনিদ্রা কী?
৩. ঘুমের স্বাভাবিক পরিমাণ কী?
৪. কিভাবে ভালো ঘুমাতে পারি?
৫. ঘুমের পরিমাণ কী ধরনের?
স্বাভাবিক ঘুম বলতে কী বুঝি
স্বাভাবিক ঘুমের তিনটি প্রধান অংশ আছে-
ক) প্রশান্ত ঘুম (Quiet sleep/Deep sleep)
খ) REM Sleep: Rem sleep-এ ঘুম তখনই ঘটে যখন মস্তিষ্ক খুবই সক্রিয়, কিন্তু শরীর ক্লান্ত থাকে।
গ) ১-২ মিনিটের জন্য জাগ্রত হওয়া।
প্রতি রাতে ৪-৫ ঘণ্টা REM Sleep এবং ৪-৫ ঘণ্টা জঊগ ঝষববঢ় হয়ে থাকে। উপরন্তু ১-২ মিনিটের জন্য জাগ্রত কয়েকটি সংক্ষিপ্ত সময় প্রতি দুই ঘণ্টা অন্তর প্রায় ঘটতে থাকে, যা সাধারণত হয়ে থাকে রাতের শেষ ভাগে। সাধারণত দুই মিনিটের কম সময় ধরে আপনি জেগে থাকেন, যা আপনি মনে রাখতে পারেন না। জাগ্রত সময়গুলো কোনো কারণে দীর্ঘস্থায়ী হলে-
উদাহরণস্বরূপ Partner নাক ডাকলে, Traffic Noise-এর ফলে আপনি তাদের মনে রাখতে পারেন।
অনিদ্রা কী
প্রায় এক-তৃতীয়াংশ প্রাপ্তবয়স্ক যতটা ঘুম দরকার ততটা ঘুমাতে পারেন না।
অনিদ্রা হতে পারে-
ক্স যথাসময়ে ঘুমাতে না যেতে পারা।
ক্স ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি জেগে ওঠা।
ক্স রাতে দীর্ঘ সময়ের জন্য জাগ্রত থাকা।
ক্স রাতে ঘুমানোর পর সকালে ফ্রেশ বোধ না করা।
যদি অনিদ্রা একটি দীর্ঘ সময়কাল ধরে থাকে তাহলে অনিদ্রা আপনার স্বাভাবিক জীবনযাপনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন- দিনান্তে ক্লান্তি ও শক্তি হ্রাস, কম মনোযোগ, স্বাভাবিক কার্যক্রমে আগ্রহ হ্রাস, খিটখিটে মেজাজ, বিষণ্নতা ও উদ্বেগ। এর ফলে দৈনিক স্বাভাবিক কার্যকলাপেও অক্ষমতা দেখা দেয়। ত্রুটিগুলো কর্মক্ষেত্রে বা ড্রাইভিংয়ের সময় ঘটতে পারে, যার ফলে গুরুতর পরিণতি আসতে পারে জীবনে এবং জীবনযাপনের মানও কমে আসে।
ঘুমের স্বাভাবিক পরিমাণ কী?
বিভিন্ন মানুষের ঘুম বিভিন্ন পরিমাণে প্রয়োজন। কিছু লোক রাতে মাত্র কয়েক ঘণ্টা ঘুমানোর পর দিনে ক্লান্তি বোধ করে না। বেশির ভাগ মানুষের এর চেয়ে বেশি ঘুমের প্রয়োজন। প্রত্যেকের গড়ে ৬-৯ ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন। বেশির ভাগ মানুষ তাদের প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে স্বাভাবিক ঘুমের জন্য একটি PATTERN ESTABLISH করে। যা হোক, যখন আপনি বড় হচ্ছেন তখন স্বাভাবিকভাবে ঘুম কমতে থাকবে।
সুতরাং ওই পরিমাণ ঘুমই আপনার জন্য প্রয়োজন, যে পরিমাণ ঘুমিয়ে দিনে ফ্রেশ অনুভব করেন এবং ঘুম ঘুম ভাব অনুভূত হয় না।
অনিদ্রার কারণ
কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াও অনিদ্রা হতে পারে। যা হোক, কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ রয়েছে-
ক) সচেতনতা সম্পর্কে : অস্থায়ী সমস্যা- অনিদ্রা অনেক সময় অস্থায়ী হয়। এটা হতে পারে Stress-এর জন্য। পারিবারিক সমস্যার জন্য, Routine change-এর জন্য, নতুন শিশুর আগমন, অদ্ভুত বিছানা ইত্যাদি কারণে হতে পারে। উদ্বেগ বা বিষণ্নতা অস্থায়ী অনিদ্রার কারণ। আপনার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও অফিসের সমস্যা বা আবেগের কারণ, যা বন্ধ করা কঠিন হয়ে যায়। আবার বিষণ্নতার কারণেও অনিদ্রা হতে পারে। বিষণ্নতা বা উদ্বেগের চিকিৎসা প্রায়ই অনিদ্রার নিরাময় হয়।
বিভিন্ন অসুস্থতা অনেক সময় অনিদ্রার কারণ। উদাহরণস্বরূপ- কিছু কিছু অসুস্থতা আছে, যা শরীরের ব্যথার কারণ, Leg cramps, শ্বাসকষ্ট, বদহজম, কাশি, চুলকানি, hot flash, মানসিক সমস্যা।
খ) উত্তেজক পদার্থ :
- Caffine
- Alcohol
গ) Street Drug (Cocaine, গাঁজা) : ঘুমের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
ঘ) নির্ধারিত ওষুধ : কোনো কোনো মেডিসিনও নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পানি কমাতে Diuretic, কিছু অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস, স্টেরয়েড, ক্যাফিন ধারণকারী ব্যথার ওষুধ, ঠাণ্ডা প্রতিরোধক।
ঙ) স্কিন টাইম : কিছু কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, শিশু ও কিশোরদের মধ্যে যারা ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো ব্যবহার করে তাদের রাতে অনিদ্রা হয়ে থাকে বেশি।
অবাস্তব প্রত্যাশা : কিছু মানুষের অন্যদের তুলনায় কম ঘুম প্রয়োজন। যদি ঘুমের প্যাটার্ন পরিবর্তিত না হয় তাহলে বয়স্ক ব্যক্তি এবং যারা সামান্য ব্যায়াম করেন, তাদের ঘুম কম হয়ে থাকে।
অনিদ্রার কিছু শ্রেণিবিন্যাস
ক) প্রাথমিক অনিদ্রা : যখন কোনো অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণ শনাক্ত করা যায় না। দীর্ঘমেয়াদি অনিদ্রার পাঁচটি কারণের মধ্যে প্রাথমিক অনিদ্রা একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
খ) সেকেন্ডারি কারণ : অনিদ্রা যখন অন্য রোগের একটি লক্ষণ বা সাথে যুক্ত, এটি হতে পারে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, ড্রাগ বা পদার্থের অপব্যবহার।
সময় দ্বারা অনিদ্রার শ্রেণিবিন্যাস
স্বল্পমেয়াদি- যদি অনিদ্রা চার সপ্তাহ চলতে থাকে।
দীর্ঘমেয়াদি- যদি অনিদ্রা চার সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে চলতে থাকে।
কিভাবে আমি ভালো ঘুমাতে পারি?
ক্যাফেইন, ধূমপান, অ্যালকোহল এবং বিছানায় যাওয়ার আগে ভারী খাবার বা কঠোর ব্যায়াম এড়িয়ে চলুন। প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় বিছানায় যেতে হবে এবং ঘুম থেকে উঠতে হবে। দিনের বেলায় ব্যায়াম, রাতে Mood Relaxed এবং শয়নকালে ক্লান্ত বোধ করতে সহায়তা করে।
নিচের পাঁচটি বিষয়, যা উন্নত ঘুম হতে সাহায্য করবে
১. কিছু ঘটনা বোঝা।
২. ঘুমের স্বাস্থ্যবিধি।
৩. রিলাক্সেন কৌশল।
৪. দিনের বেলায় ব্যায়াম।
৫. মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা ও আচরণগত থেরাপি।
কার্যত এটি একটি ধাপ অনুযায়ী ফ্যাশন হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
কিছু ঘটনা বোঝা : অল্প সময়ের জন্য প্রতি রাতে জাগ্রত হওয়া স্বাভাবিক। মাঝরাতে মাঝে মাঝে জেগে ওঠা অনেকের জন্য উদ্বেগের কারণ, যা অনিদ্রার অবস্থাকে আরো জটিল করে তোলে।
ঘুম স্বাস্থ্যবিধি
ভালো ঘুমের জন্য সাধারণ টিপস-
ক্স ক্যাফিন হ্রাস : ঘুমাতে যাওয়ার ৬ ঘণ্টা আগ থেকে ক্যাফিন বা ক্যাফিনযুক্ত খাবার বর্জন করতে হবে।
ক্স শয়নকালের আগের ৬ ঘণ্টার মধ্যে ধূমপান করবেন না।
ক্স শয়নকালের আগে ৬ ঘণ্টার মধ্যে মদপান থেকে বিরত থাকবেন।
ক্স শয়নকালের আগে ভারী খাবার খাবেন না।
ক্স ঘুমাতে যাওয়ার আগে ৪ ঘণ্টার মধ্যে কোনো কঠোর ব্যায়াম করবেন না।
ক্স সকালে জাগ্রত হওয়া ও রাতে ঘুমাতে যাওয়ার একটি জযুঃযস পাওয়ার চেষ্টা করুন।
আপনি যদি একটি রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে যান তাহলে আপনার ঘুম আরো আরামদায়ক হবে। আপনি যতই ক্লান্ত থাকুন না কেন, দিনে ঘুমাবেন না। যখনই আপনি বিছানায় যাবেন সাথে সাথে সুইচ বন্ধ করে দেবেন। সপ্তাহে সাত দিন একই সময়ে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করুন। আপনি এই অভ্যাস আয়ত্তে আনার জন্য অ্যালার্ম ব্যবহার করতে পারেন। ঘুমের প্রলোভন প্রতিরোধ করুন, এমনকি রাতে অল্প ঘুম হলেও।
শয়নকক্ষ শান্ত রাখুন : শয়নকক্ষ কখনই গরম, ঠাণ্ডা বা শোরগোলপূর্ণ থাকবে না। শয়নকক্ষ ভালো গাঢ় পর্দা দিয়ে ঘেরাও করে রাখতে হবে। যাতে সকালে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে না পারে। শয়নকক্ষে কখনই কাজ, খাওয়া-দাওয়া বা টেলিভিশন দেখার জন্য ব্যবহার করা উচিত নয়। বিছানায় যাওয়ার আগে কিছু রুটিন অভ্যাস করে রিলাক্স হওয়ার চেষ্ট করুন।
উদাহরণস্বরূপ- কিছু পড়া, একটি সময় পানীয় পান করা (ক্যাফিন ছাড়া) মিউজিক শোনা। মানসিকভাবে কোনো কিছুই ঘুমাতে যাওয়ার সময় করবেন না। যেমন- বই পড়া ইত্যাদি।
তখনই ঘুমাতে যাওয়া উচিত যখন ঘুম পাবে এবং ক্লান্ত লাগবে। যদি আপনার ঘুম ২০-৩০ মিনিটের মধ্যে না আসে তাহলে বই পড়ুন। যদি পারেন ভিন্ন কিছু না কিছু করুন, যেমন টিভি দেখা, কিছু পড়া। ঘুম ধরলে পুনরায় বিছানায় চলে যান।
রিলাক্সেশন কৌশল : বিছানায় যাওয়ার আগে যা আপনার মানসিক ও শারীরিক আবেগ কমাতে সাহায্য করে। উদহারণস্বরূপ- শরীরের বিভিন্ন মাসল গ্রুপ পর্যায়ক্রমে জবষধী ধহফ ঃবহংব করা। নিয়মিত ব্যায়াম আপনাকে রাতে বেশি জবষধীবফ ধহফ ঞরৎবফ বোধ করতে সাহায্য করবে এবং আরামপ্রদ ঘুম হবে। যদি সম্ভব হয় তবে বেশির ভাগ দিনেই কিছু ব্যায়াম করুন। যা হোক, আদর্শভাবে আপনার উচিত অন্তত ৩০ মিনিট মধ্যপন্থী ব্যায়াম সপ্তাহে চার-পাঁচ দিন অনুশীলন করা। যদি আপনার গুরুতর স্থায়ী অনিদ্রা থাকে তাহলে ডাক্তার আপনাকে মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসার জন্য একজন মনোবিজ্ঞানীর কাছে পাঠাতে পারেন।
বিভিন্ন ধরনের থেরাপি আছে, যা আপনার মস্তিষ্ককে পুনরায় প্রশিক্ষিত করতে সাহায্য করবে এবং যেভাবে আপনি অনুভব করেন, মনে করেন বা আচরণ করেন। গবেষকেরা দেখেছেন, একটি ইবযধারড়ঁৎধষ থেরাপির মাধ্যমে একজন প্রাপ্তবয়স্ক অনিদ্রাজনিত কারণে আক্রান্ত মানুষের ভালো ঘুমের উন্নতি সম্ভব।
গ) Stimulas Control Therapy : এটি আপনাকে ঘুমের সাথে বিছানা এবং বেডরুমের পুনর্নির্ধারণ করতে এবং সঙ্গতিপূর্ণ ঘুম বা জাগরণের প্যাটার্ন পুনরায় স্থাপন করতে সহায়তা করবে।
ঘুমের ওষুধ খাবো কি না?
ঘুমের ট্যাবলেট এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। অতীতে ঘুমের ট্যাবলেট সাধারণত Prescribed করা হতো। তবে কিছু সমস্যা দেখা দেয়ায় ঘুমের ওষুধগুলো সাধারণত বেশি প্রয়োজন না হলে Prescribed করা হয় না। ঘুমের ট্যাবলেটগুলোর সম্ভাব্য সমস্যা হলো-
১. পরের দিন ঝিমানো। আপনি ড্রাইভিং বা ভারী যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য নিরাপদ নন।
২. অনেক সময় বয়স্ক মানুষ ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমালে রাতে টয়লেটে যাওয়ার জন্য ঘুম থেকে উঠলে পড়ে গিয়ে কোমরের হাড্ডি ভাঙার ঝুঁকি থাকে।
৩. ঘুমের বড়ির নির্ভরশীল হয়ে গেলে এক সময় বেশি মাত্রার ঘুমের বড়ি খেয়েও ঘুম হয় না।
৪. অনেকে ঘুমের বড়ির ওপর এমনভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে যে, বড়ি বন্ধ করলে Withdrawal symtom develop করে।
তবে কখনো কখনো ঘুমের বড়ির পরামর্শ দেয়া হয়। মাঝে মাঝে ডাক্তার ঘুমের বড়ি প্রতিদিন না খেয়ে সপ্তাহে দু-তিন দিন খাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এভাবে খেলে ঘুমের বড়ির ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি হয় না।
সর্বশেষ উপদেশ : আপনি যদি মনে করেন, অসুস্থতা বা ওষুধটি অনিদ্রার কারণ তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। যেকোনো অন্তর্নিহিত অবস্থা, যা অনিদ্রার সৃষ্টি করছে তার চিকিৎসা করলে অনিদ্রার উন্নতি হতে পারে। বিশেষ করে বিষণ্নতা ও উদ্বেগ অনিদ্রার সাধারণ কারণ, যা চিকিৎসাযোগ্য।
এমবিবিএস, ডি-কার্ড (বিএসএমএমইউ)
মেডিসিন অ্যান্ড কার্ডিওলজি স্পেশালিস্ট
কনসালট্যান্ট মেডিসিন
ইবনে সিনা হাসপাতাল