আরসিইপির প্যাঁচে নতুন বিশ্বব্যাবস্থা
আরসিইপি - ছবি সংগৃহীত
দুনিয়াতে অর্থনীতিভিত্তিক রাষ্ট্র-জোট অনেকই গড়া হয়েছে, বেশির ভাগ সময় তাতে আঞ্চলিক একটা ছোঁয়াও খুঁজে দেখলে পাওয়া যাবে অথবা অঞ্চলের একটা আবছা ভাবধারণাও তাতে থাকতে দেখা গেছে। তাই বিভিন্ন রাষ্ট্র-জোটের অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা নতুন কিছু নয়। কিন্তু আরসিইপি বড় ব্যতিক্রম। কাঠামোগতভাবে দেখতে আগের মতো কিছু একটা মনে হলেও এটা ‘বিশেষ’ এক অর্থনীতিভিত্তিক রাষ্ট্র-জোট। রিজিওনাল কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ- এরই সংক্ষিপ্ত রূপ ‘আরসিইপি’। অঞ্চল হিসেবে এটি এশিয়াকেন্দ্রিক অবশ্যই। কিন্তু মূলত চীনকেন্দ্রিক। গত আট বছর ধরে চলা প্রচেষ্টায় এবার সদস্যদের অংশগ্রহণ ও চূড়ান্ত স্বাক্ষরদানের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার মাধ্যমে এর উদ্বোধন ঘটানো হলো গত ১৫ নভেম্বর ২০২০ এক ভার্চুয়াল মিটিংয়ের মাধ্যমে। কারা এর সদস্য?
আগের অর্থনৈতিক জোট আসিয়ান (সাউথ-ইস্ট এশিয়ার রাষ্ট্র সমিতি), যার সদস্যরা হলো- ব্রুনাই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম- এই ১০ দেশ। এরা সবাই আরসিইপির সদস্য হয়েছে। এ ছাড়া নতুন রাষ্ট্র হলো- জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া। সাথে চীন তো আছেই। এভাবে মোট ১৫ রাষ্ট্রসহযোগে গঠিত হয়েছে আরসিইপি জোট।
এটা আনুষ্ঠানিক চালু হতে আরো কিছু সময় লাগবে। সাধারণত ৬০-৭০ শতাংশ হবু সদস্যের স্বাক্ষর পেলে সেই জোট উদ্যোগের চলাচল শুরু হয়। আসিয়ান থেকে ন্যূনতম ছয় রাষ্ট্র আর বাকিদের থেকে ন্যূনতম তিন রাষ্ট্র সদস্য হতে সম্মতি স্বাক্ষর করলেই আরসিইপি কার্যকর হতে পারবে। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে এটা অবশ্যই এশিয়ার নতুন এক অর্থনৈতিক রাষ্ট্র-জোট। কিন্তু তারপরও সবাই বলছে এটা ‘চীনকেন্দ্রিক’ এক জোট। নিউইয়র্ক-ভিত্তিক গ্লোবাল মিডিয়া ব্লুমবার্গ বা আমেরিকান থিঙ্কট্যাংক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটও এটাকে চায়না-লেড মানে চীনা-নেতৃত্বের আরসিইপি এভাবে উল্লেøখ করেছে। বলা হচ্ছে, দুনিয়ার মোট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৪০ শতাংশ এই জোট সদস্যদের মাঝে হয়ে থাকে। আর দুনিয়ার মোট জিডিপি আয়ের ৩৫ শতাংশ এবং মোট ২৬ ট্রিলিয়ন ডলারের মোট জিডিপি ভ্যালুর উৎস আরসিইপির সদস্য রাষ্ট্রগুলো।
ভ্যালু এডিশন শেয়ার করে নেয়া : কিন্তু আরসিইপির গুরুত্ব, তাৎপর্য এখানে নয়। আরসিইপি ‘বিশেষ’ অন্য কারণে। এটি দুনিয়ায় এক নতুন ধরনের ‘আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের’ সূচনা করবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এর পেছনের মুখ্য ধারণাটা হচ্ছে- ‘ভ্যালু এডিশন’ শেয়ার করা। এত দিনের প্রচলিত পণ্য রফতানি বলতে মূলত যা বোঝা হতো তা হলো, যতদূর সম্ভব নিজের কাঁচামালে তবে পুরো ম্যানুফেকচারিংয়ের পর্যায়টা একই রাষ্ট্রে এভাবে সম্পন্ন করা ফিনিশড পণ্য উৎপাদন ও রফতানি করা। তাই এর মধ্যে ভ্যালু এডিশন কী জিনিস তা নজরে না এনেও তা চলেছিল। কিন্তু ভ্যালু এডিশন সেটা আবার কী?
‘ভ্যালু এডিশন’ শব্দটা শুনে তা নতুন আবার কোনো কথার কচকচানি বা অপরিচিত কোনো কঠিন ধারণা এমন নয়। বাংলাদেশের মানুষ কিন্তু ইতোমধ্যেই এর সঙ্গে পরিচিত। সেটা কিভাবে? দোকানে কোনো জিনিস কিনে আমাদের সবাইকে সেটির দামের ওপর আলগা একটা ট্যাক্স গুনতে হয়। সেটি হলো ‘ভ্যাট’। এই ট্যাক্স আমাদের সবার পরিচিত; আর ইংরেজিতে ভিএটি শব্দটা ভাঙলে হয় ‘ভ্যালু এডেড ট্যাক্স’ বা সংক্ষেপে ভ্যাট।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ১৯৯১ সাল থেকেই এটা চালু হয় এবং সারা দুনিয়াতেই এই ট্যাক্সটা আড়াই পার্সেন্ট হিসেবেই চালু হয়। কিভাবে? কারণ এটি বিশ্বব্যাংক নির্ধারিত। ফলে সবার জন্য কমন। আমাদেরও সেটি আগে দিতে হতো আড়াই পার্সেন্ট, এখন চলতি অর্থবছর থেকে সরকার জবরদস্তি সেটা পাঁচ পার্সেন্ট করেছে।
কিন্তু তা না হয় বোঝা গেল। তবু, এই ভ্যালু এটা আবার কী? ভ্যালু একটা ইংরেজি শব্দ যার আক্ষরিক বাংলা অর্থ হলো ‘মূল্য’। তবে অর্থনীতি সম্পর্কিত বিষয়ে ব্যবহার হলে এটি কোনো উৎপাদিত পণ্যের যেমন মূল্য থাকে- পণ্যমূল্য, সেই মূল্য এটা। আপাতত এই আলোচনায় শুধু অর্থনীতি সম্পর্কিত অর্থে ‘মূল্য’ বুঝব। কিন্তু সেই মূল্য বলতেই বা ঠিক কী বুঝব?
কোনো উৎপাদিত পণ্য বলতে এর দুটি অংশ থাকে- প্রাকৃতিক অংশ যা আল্লাহ দিয়েছেন এমন অর্থে পড়ে পাওয়া অংশ আর অপর অংশ যা মানুষ যোগ করেছে। যোগ করা মানে হলো মানুষের যোগ করা শ্রম। তাই মূল্য বলতে আসলে বুঝতে হবে যোগ করা শ্রমের মূল্য। কারণ বাকিটা তো প্রাকৃতিক, পড়ে পাওয়া, ফলে সেটাতে মানুষের কৃতিত্বের কিছু নেই। তাই অর্থনীতিতে ভ্যালু ধারণাটা হলো, প্রাকৃতিক জিনিসের ওপর শ্রম ঢেলে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে তোলা। তাই এবার ভ্যাট মানে হলো- কোন প্রডাক্টে যতটুকু নতুন শ্রম যোগ হয়েছে (এ জন্য ইংরেজি অ্যাডেড শব্দটা), সরকার সেই মূল্যের আড়াই পার্সেন্ট, টাক্স হিসাবে সরকার নিজে কেটে রেখে দিচ্ছে। পণ্যে অ্যাডেড ভ্যালুর আড়াই পার্সেন্ট- এটাই ভ্যাট। মূল তত্ত্ব¡কথা এখানে শেষ।
এখন আমদানি-রফতানির স্তরে এই মূল্য নিয়ে কী ঘটে সে কথা তুলব। বাংলাদেশে কোনো পণ্য আমদানি করতে গেলে যেমন একই ধরনের নাটবল্টু দু’দেশ থেকে আনতে দু’রকম ট্যাক্স দিতে হতে পারে। কেন? কারণ একটা দেশের বেলায় কাঁচামাল লোহা তার নিজের খনন-উত্তোলন করা আর পরে কারখানায় ওর ম্যানুফেকচারিং- প্রক্রিয়ার পুরোটাই আবার ওই দেশেই সম্পন্ন করা এভাবে তৈরি হওয়া প্রডাক্ট হতে পারে। সে ক্ষেত্রে এর অর্থ হলো, এখানে শতভাগ ‘ভ্যালু এডিশন’ ওই দেশেই হয়েছে। তাই এই প্রডাক্ট আমার দেশে আমদানিতে এর ওপর আমদানি ট্যাক্স অনেক কম হবে। তুলনায় অন্য যে নাটবল্টু ধরা যাক, অস্ট্রেলিয়া থেকে (আধা প্রক্রিয়াজাত) বা ইনগট অবস্থায় লোহা এনে আরেক দেশে যে বোল্ট বানানো হয়েছে- এমন যদি হয়ে থাকে তবে ওই প্রডাক্ট আমার দেশে আমদানিতে এর ওপর ট্যাক্স বেশি ধরা হবে; চাইকি অনেক দেশ তা নিজ দেশে আমদানি নিষিদ্ধ বলে বসতে পারে।
যেমন, আমাদের দেশ থেকে চীনে কোনো কিছু রফতানি করার বেলায়, ভিন্ন দেশ থেকে আমাদের আমদানি করা কোনো কাঁচামালের ওপর আমাদেরকে ৪০ শতাংশের বেশি ভ্যালু যোগ করতেই হবে। যদি তা না হয় পারিনি, এমন উৎপাদিত যেসব প্রডাক্ট তা এখন চীনে রফতানি অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। আমাদের প্রতি চীনের আমদানি নীতির বাধ্যকতার সীমা এটি, যা আমরা এখন ২৫ শতাংশ হলেও যেন রফতানির সুযোগ পাই সেই দেনদরবার করছি চীনের কাছে।
আবার ভ্যালু এডিশন কথাটা আমদানির সময় আরেক শব্দ দিয়ে ভিন্নভাবে বলা হয়। যেমন- আমরা বললাম, আমদানি করতে চাওয়া পণ্যের কান্ট্রি অব অরিজিন কী, বা কোথায়? মানে আমার রফতানির জন্য তৈরি প্রডাক্টে আমদানি কাঁচামালের উৎস কোথায় আর সেটা পণ্যমূল্যের কত অংশ? নাকি উৎপাদক ফিনিশড প্রডাক্ট দেশে আমদানি কাঁচামালের ওপর আমার ভ্যালু এডিশন অংশ অনেক বেশি হয়েছে বলে (কাঁচামাল আমার দেশের না বাইরের তা আর গুরুত্বপূর্ণ নয়)। অতএব আমার রফতানি পণ্যের ভ্যালু অ্যাড করা অংশে আমার অবদান প্রবল হলে আর কাঁচামালে আমার কান্ট্রি অব অরিজিন অংশ কত এটা উপেক্ষা করতে হবে, চাপা পড়ে যাবে। কোনো দেশের আমদানি নীতিতে ‘কান্ট্রি অব অরিজিন’ কথাগুলো এভাবে পাঠ করা হয়।
এবার আসি নতুন রাষ্ট্র-জোট আরসিইপিতে। কেন এটাকে ‘বিশেষ’ বলছি? গ্লোবাল নেতৃত্বের পালাবদলের সময়কাল চলছে এই সময়ে। আর এখানেই পুরনো গ্লোবাল নেতা আমেরিকার চেয়ে হবু নতুন চীনা নেতৃত্ব কিছু জায়গায় একেবারেই আলাদা ও বেটার। তাই এই ‘বিশেষ’ শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে। আমেরিকান নেতৃত্বের আমলটা মূল বৈশিষ্ট্য হলো- সেটা এক গভীরভাবে অসম সম্পর্ক; ওরাই শুধু আমাকে বেচবে আর আমি খালি কিনে যাবো, প্রচলিত এই নিয়মটাই বজায় ছিল যা এবার বদলাবে, তুলনামূলক ভালো হবে।
কারণ এবার সবাই সবার কাছে প্রডাক্ট বেচবে নিজের ভ্যালু অ্যাড করার পর, তাতে সেটি ফিনিশড প্রডাক্ট নাও হতে পারে। আবার সবাই অন্যের ভ্যালু অ্যাড করাটা তার কাছ থেকে কিনবে। এতে শেষ শুধু যা দাঁড়াবে তা হলো- সবাই নিজ সামর্থ্য-যোগ্যতা মতো নিজের ভ্যালু অ্যাড করা অংশটা যোগ করতে থাকবে। এতে শেষে একটাই শর্ত কাজ করবে, যে বা যারা আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় দক্ষভাবে কোনো প্রডাক্ট বানাবে (সবচেয়ে কম শ্রমে সবচেয়ে ভালো গুণের প্রডাক্ট বলে। আর বাকি ওই প্রডাক্ট বানানো থেকে সরে গিয়ে যেটা যে অন্যের চেয়ে ভালো পারে সে দিকে সরে যাবে) ওই পণ্যের বেলায় সবাই তাদের থেকেই কিনবে। এতে সবাই কম দামে ভালো পণ্য কেনার সুযোগ পাবো।
কিন্তু, এতে আরসিইপি বিশেষ কী হয়ে গেছে বলা হবে কেন? কারণ, বলা হয়েছে, এই ১৫ রাষ্ট্রের আরসিইপিভুক্ত কেউ কারো দেশে রফতানি করতে গেলে কান্ট্রি অব অরিজিন বলতে আমরা ১৫ দেশ কেউ হলেই আর তৃতীয় আরসিইপি দেশে রফতানিতে আর কোনো বাধা দেয়া হবে না।
অর্থাৎ একটা প্রডাক্ট কিন্তু তা এই ১৫ দেশের জোটেরই হয়তো পাঁচ দেশে পাঁচ অংশ তৈরি মানে ভ্যালু অ্যাড হলো। এতে এই শেয়ার করা মোট ভ্যালু অ্যাডেড হয়ে সেই ফিনিশড প্রডাক্ট এবার অবাধে যেকোনো আরসিইপিভুক্ত দেশে রফতানি হতে পারবে, কোনো কান্ট্রি অব অরিজিনের প্রশ্ন তোলা হবে না। কারণ, আরসিইপি দেশের কেউ না কেউ এর অরিজিন। তত্ত্বগত ভাষায় এটাই ‘শেয়ারড ভ্যালু এডিশন প্রডাক্ট’ বা শেয়ার্ড সাপ্লাই চেন প্রডাক্ট বলা হয়।
এই ‘শেয়ার্ড সাপ্লাই চেন প্রডাক্ট’ এভাবে আমদানি-রফতানির এক নতুন যুগ বা গ্লোবাল প্রডাকশনের এই নতুন যুগ নিঃসন্দেহে আসন্ন দুনিয়াকে বদলে দেবে। চীন প্রায়ই একে ‘উইন-উইন’ অবস্থার যুগ বলে থাকে। অর্থাৎ গত ৭৫ বছরের আমেরিকান নেতৃত্বের গ্লোবাল সিস্টেম এখন চীন বদলে দেবে। এসব জায়গায় হবু চীনা নেতৃত্বের গ্লোবাল সিস্টেমে তা আমূলে বদলে যাবে। আগের দাতা-গ্রহীতা বা ‘অসম পণ্য বিনিময়ের সম্পর্ক’ যুগের সবটা না হলেও অনেকটাই এতে বদলে যাবে। এটাই হবু চীনা নেতৃত্বের ‘বিশেষ’ তাৎপর্য।
ঠিক যেমন ১৯৪৫ সালের আগের ব্রিটিশ কলোনি সূর্যটা আমেরিকা ডুবিয়ে দিয়েছিল। এরপর আমেরিকার নেতৃত্বের এক নয়া গ্লোবাল সিস্টেম এনেছিল। যার সার কথাটা হলো, এবার আর কেউ কারো কলোনি থাকবে না। কলোনি ব্যবস্থা উঠে যাবে। আর এর বদলে আমেরিকান নেতৃত্বের নয়া গ্লোবাল ব্যবস্থায় কলোনিমুক্ত স্বাধীন দেশ হিসেবেই আমেরিকার সাথে গ্লোবাল বাণিজ্য সম্পর্কে জড়িত হবে, বিনিয়োগ লোন নেবে, খাতক হবে। এতদূর পর্যন্ত এটা কলোনি ব্যবস্থার চেয়ে তুলনামূলক অবশ্যই ভালো। কিন্তু এর কালো দিকটা হলো, আমেরিকার নেতৃত্বে গ্লোবাল ব্যবস্থাটা মারাত্মক উঁচু-নিচু এক দাতা-গ্রহীতা বা ‘অসম পণ্য-বিনিময়ের সম্পর্কের’। এক কথায় যেটা হলো, ওরা (পশ্চিম) শুধু ওদের প্রডাক্ট সিঙ্গাপুরে (পশ্চিমা দেশের পাইকারি দোকানের চকবাজার হলো সিঙ্গাপুর) এনে সেখান থেকে আমাদের মতো দেশে শুধু রফতানি করবে, তারা একলাই শুধু বেচবে। এটা আমূলে বদল এখন শুরু হবে। এটাই নিঃসন্দেহে এক চীনা স্বপ্ন। নতুন দুনিয়ার চীন। চীন সেটাকে ‘জিনপিংয়ের স্বপ্ন’- এই ব্র্যান্ড নেম দিয়ে বলছে।
কিন্তু একটা সাবধানতা। কোনো রাষ্ট্রই আদর্শ রাষ্ট্র নয়, হতেই পারে না। বরং বাস্তবে যা পাওয়া যায় সেগুলোই বাস্তবের রাষ্ট্র অর্থাৎ দোষে-গুণে আর সীমাবদ্ধতায় ভরা এসব রাষ্ট্র। অতএব বাস্তব রাষ্ট্র হিসেবে চীন যা আরসিইপি জোটকে করে দেখাতে চায় বলে জানাচ্ছে এটা তার কামনা মাত্র। এর কতটা বাস্তবায়নযোগ্য, এ ছাড়া চীন কতটা তা বাস্তব করে তুলতে পারবে আর কতটা সে যোগ্য সেটার প্রমাণ দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
শেষে আরসিইপি নিয়ে গ্লোবাল মিডিয়া ব্লুমবার্গের ভাষায় কিছু কথা। লন্ডন-বেসড অক্সফোর্ড ইকোনমিক্স নামে এক কনসাল্টিং কোম্পানির কথা এনেছে তারা। গ্লোবাল ইকোনমিক ইস্যুতে ওই কোম্পানি তার ক্লায়েন্টদের ফোরকাস্ট বা পরামর্শ দিয়ে থাকে। এদেরই এক ডিপার্টমেন্টাল হেড প্রিয়াংকা কিশোর ব্লুমবার্গকে ইমেল মন্তব্যে জানিয়েছে- ‘আরসিইপিভুক্ত দেশের মধ্যে কমন রুলস অব অরিজিনের কারণে মূলত এই ট্রেড-ব্লক খুবই আকর্ষণীয় হবে, পরস্পরের অর্ধপ্রক্রিয়াজাত কাঁচামাল সাপ্লাইয়ের উৎস হবে এবং আমদানিকারক হিসেবেও হাজির হবে।’
এভাবে আরেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, ‘এতে আরসিইপিভুক্ত দেশের পরস্পরের মধ্যে রফতানিতে বাধাগুলো কমিয়ে আনতে সাহায্য করবে, রাস্তা দেখাবে বিশেষত এই করোনা অর্থনীতির গতিহীনতার আমলে অর্থনীতিতে গতি ফেরাবে।’ এ ছাড়া, সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনির ফেলো অমিতেন্দু পালিতের মন্তব্য- তিনি মনে করেন, ‘এতে বাণিজ্য করার যে ব্যয় তা কমে আসবে যা হবে এক বিরাট সুবিধা, আর তা সবাই পাবে। আর এটা চালু হলেই এদের নিজেদের মধ্যে ৯২ শতাংশ ক্ষেত্রে বাণিজ্য পণ্যের শুল্ক উঠে যাবে। এটা ভারত যেমন জাপান বা দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ফ্রি ট্রেড চুক্তি করে অর্জন করেছে এর চেয়ে অনেক বেশি লাভজনক হবে।’
আধুনিক রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল জাতি-রাষ্ট্র রূপে আর কলোনি দখলের সাথে সম্পর্ক রেখে। এছাড়া তখন ওর অনুষঙ্গ অর্থনৈতিক ধারণা ছিল, জাতিবাদী-অর্থনীতি। মানে নিজ বাজার সংরক্ষণবাদী- কাউরে ঢুকতে দিও না। কিন্তু অন্যের বাজারের বেলায় সেখানে ভিন্ন বা উল্টা নিয়ম। যেভাবে পারো অন্য যে কারো বাজারে ঢুকে পড়ো, তাকে বাজার সংরক্ষণ করতে দিও না- ওর বাজারে ঢুকে পড়ো, যেকোনো জবরদস্তি করো। আরএসএস- মোদি যার সম্ভবত সবচেয়ে আদর্শ উদাহরণ। আর ৭৫ বছরের গ্লোবাল নেতৃত্ব দেয়া আমেরিকার শেষ চার বছরে ট্রাম্প- তিনিও গ্লোবাল নেতাগিরি ত্যাগ করে জাতিবাদী হতে চেয়েছিলেন, যেন হয়েছিলেন মোদির অনুসারী। সারা জীবন অন্যের বাজার ভেঙে ঢুকে পড়া আমেরিকা এতে হয়ে যায় ‘নিজ বাজার সংরক্ষণবাদী’।
সার কথাটা হলো, শুধু নিজের জন্য বাজার সংরক্ষণ মূলত সেকালের কলোনি ক্যাপিটালিজমেরই অনুষঙ্গ। যেটা একালে কারো জন্য সুবিধার হয়নি। তবু অনেকে হতে চায়। তারা রাষ্ট্রের অর্থনীতি চালায় আমদানি বাধা দিয়ে, ব্যাপক ট্যাক্স বসিয়ে আর এভাবে শুল্ক সংগ্রহ করে। কিন্তু উৎপাদন বাড়ানো, নতুন কাজ সৃষ্টি, কম শ্রমঘণ্টা লাগিয়ে দক্ষভাবে পণ্য উৎপাদন করে পণ্য সবার নাগালে আনা- ইত্যাদি করে মানুষের আয়ের ওপর ট্যাক্স বসিয়েও বিকল্পভাবে রাষ্ট্রের অর্থনীতি চালানোও সম্ভব। এতে যে কাজের সংস্থান করা সহজ তা তারা বুঝতে চায় না। বাংলাদেশের শাসকরা মূলত আমদানি শুল্ক সংগ্রহ করে দেশ চালানো সহজ গণ্য করেছে বলেই আরসিইপিতে ঢুকতে পারেনি বা কেউ তাকে ডাকেনি।
সব শেষে জানাই, আরসিইপি প্রসঙ্গে এটি শুধু একটি দিক নিয়ে লেখা। এর আরো বহু দিক নিয়েই লেখার আছে। আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু আছে। আমার সীমিত সক্ষমতায় তা নিয়ে আগামীতে আবার ফিরে দেখা হবে হয়তো!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com