ভারতের কৃষকেরা কেন ফুঁসছে
ভারতের কৃষকেরা কেন ফুঁসছে - ছবি সংগৃহীত
ভারতের রাজধানীতে শুক্রবার নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে কৃষকদের সঙ্ঘর্ষ হয়েছে। কৃষকদের মার্চ থামাতে জলকামান ব্যবহার করা হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে, বিশেষ করে কৃষিপ্রধান পাঞ্জাব থেকে এই বিক্ষোভকারীরা রাজধানীতে জড়ো হচ্ছিল। সরকার সেপ্টেম্বরে তথাকথিত যে ‘সংস্কারের’ মাধ্যমে বাজার উদারিকরণ করেছে, সেটার ব্যাপারে কৃষকরা চরম ক্ষুব্ধ। তাদের আশঙ্কা এই সংস্কারের ফলে শেষ পর্যন্ত সরকার কৃষি খাত থেকে প্রণোদনা তুলে নেবে এবং বাজারের বিভিন্ন শক্তির কাছে অসহায় হয়ে পড়বে তারা। কর্তৃপক্ষ যদিও দাবি করেছে যে, কৃষকদের স্বার্থেই তারা এটা করেছে, কিন্তু এই বিশ্লেষণে বোঝা যাবে যে কৃষকদের স্বার্থের কথা তারা ভাবেনি, নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে তারা এটা করেছে।
বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাস মহামারী – যেটাকে এই লেখক সার্বিকভাবে ‘বিশ্বযুদ্ধ সি’ বলে থাকে – সেই মহামারীর কারণে অনেকের অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যে জন্য তারা একটা উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় ছিল। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডাব্লিউইএফ) এখন প্রকাশ্যেই তথাকথিত ‘গ্রেট রিসেটের’ কথা বলছে। এই আইডিয়াটা নিয়ে এসেছে সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ক্লাউস শোয়াব। গ্রীষ্মের মধ্যে ‘কোভিড-১৯: দ্য গ্রেট রিসেট’ নামের একটি বইও প্রকাশ করেছেন তিনি। সমালোচকরা এটাকে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ বললেও এটা আসলে তা নয়। এটা হলো বিদ্যমান বিশৃঙ্খল অবস্থাকে পুঁজি করে স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা, যে পরিকল্পনাটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বাস্তবায়ন করাটা কঠিন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও নিজস্ব ‘গ্রেট রিসেট’ পরিকল্পনা রয়েছে যেগুলো তিনি জনগণের উপর চাপিয়ে দিতে চান, এবং এটাও করা হচ্ছে করোনা বিশ্বযুদ্ধের মধ্যেই। তার কট্টর ভিশন হলো অর্থনীতির নব্যউদারীকরণ। রাশিয়ায় কমিউনিজমের পতনের পর ‘শক থেরাপির’ সময়টাতে সেখানে যে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছিল, ভারতেও একই ধরণের দুর্ভোগ সৃষ্টি হবে। ভর্তুকি কমতে কমতে বাতিল হয়ে যাবে এবং দেশের উন্নয়নকে নিয়ন্ত্রণ করবে তথাকথিত ‘বাজারের অদৃশ্য হাত’। এর মধ্যে ভারতের কৃষি খাতটা গুড়িয়ে যাবে এবং সেখানে বড় ধরণের কর্পোরেট কৃষি শক্তি জায়গা দখল করবে, এদের মধ্যে বিদেশী মালিকানার শক্তিও থাকতে পারে।
সমাজের উপর কৃষকদের যে প্রভাব রয়েছে, ক্ষমতাসীন বিজেপি সেটাকে ভয় পায়। তাই এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুরো শ্রেণীটাকেই তারা বিলুপ্ত করে দিতে চায়। তারা ভালো করেই জানে এই কৃষকরা সরকারকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে পারে এবং ভবিষ্যতে সারা দেশে বিক্ষোভ গড়ে তুলতে পারে। ভারতের অভ্যন্তরীণ অবস্থা এখন খুবই নাজুক এবং সরকার যেভাবে করোনা বিশ্বযুদ্ধ মোকাবেলা করেছে সেটি নিয়ে সবাই দারুণ অখুশি। কৃষকদের বিক্ষোভ শুরুতেই দমন করা না গেলে এটা আরও ব্যাপক হয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ জন্যেই রাজধানীতে তাদের দমাতে শক্তি প্রয়োগ করছে কর্তৃপক্ষ।
এই পর্যবেক্ষণ নতুন নয়। এই লেখক বেশ কয়েক বছর ধরে ভারতের সামাজিক আন্দোলনের উপর নজর রাখছে এবং এর আগেও এ ধরণের ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। চলতি বছরে যে নব্যউদার ‘গ্রেট রিসেট’ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তার পেছনের মূল ভিত্তি হলো মোদির প্রতিশ্রুত ‘বিগ ব্যাং সংস্কার’ তত্ত্ব। এই দুটো আসলে একই জিনিস। তবে তিনি ভালোভাবেই হিসেব করে দেখেছেন যে, কৃষকদের সংস্কারের বিষয়টি সঙ্কটকালিন সময়ে বাস্তবায়ন করা না হলে এটা ব্যাপক বিক্ষোভের জন্ম দেবে।
করোনা বিশ্বযুদ্ধ একটা দারুণ সুযোগ এনে দিয়েছে, কিন্তু কৃষকরা এতে বিভ্রান্ত হতে রাজি নয়। তাই তারা এই নীতির বিরুদ্ধে জোরালোভাবে অবস্থান নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেটা তাদের পেশাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারে। এই পদক্ষেপের ফলে কৃষকদের মধ্যে যে ব্যাপক বেকারত্ব সৃষ্টি হবে, তাতে করে বিপুল জনগোষ্ঠি তাদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য শহরমুখী হবে এবং এতে ভারতের সামাজিক কাঠামোটাই বদলে যাবে, কিন্তু সেটা মোটেই ইতিবাচক হবে না। কৃষকরা তাই জানে তারা যদি সরকারের এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করাতে না পারে, তাহলে তাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে। আর সে জন্যেই তারা এই ‘গ্রেট রিসেটের’ বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।
সূত্র : এক্সপ্রেস ট্রিবিউন