ইলেট্রনিক্স যন্ত্র যেভাবে ঘুমের ক্ষতি করে
ইলেট্রনিক্স যন্ত্র যেভাবে ঘুমের ক্ষতি করে - ছবি সংগৃহীত
কম্পিউটার, মোবাইল, ওয়াই-ফাই, ব্লুটুথ ইত্যাদি থেকে সর্বক্ষণ যে বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় বিকিরণ হয় তা নিঃশব্দে ক্ষতি করে দিচ্ছে ঘুমের চক্রের। কীভাবে? লিখেছেন বিশিষ্ট মনোবিদ ডঃ অমিত চক্রবর্তী।
প্রতি রাতে আমাদের ঘুমের দরকার যে কতটা, তা দুই-একটা রাত না ঘুমোলেই দিব্যি টের পাওয়া যায়। সকালবেলায় গা ম্যাজম্যাজ, সারাদিন ঘুম-ঘুমভাব, মনঃসংযোগের অভাব এবং সঙ্গে মেজাজটা খিঁচড়ে থাকা— এইসব হলো অনিদ্রার পরিণতি। ‘অনিদ্রা’ অবশ্য অসুখ নয়, শরীর-মনের নানা ধরনের রোগের লক্ষণ। ব্যথা-বেদনার পাশাপাশি মনের ভেতরকার উৎকণ্ঠা, আতঙ্ক, রাগ, অবসাদ— এইসবও সময় সময় ঘুমের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়।
রাতের ঘুমটা কতটা দামি, সেটা অনেক সময় আমাদের মনে থাকে না বলেই রাত জেগে টিভি দেখা, ফোনে কথা বলা, শোওয়ার আগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অফিসের কাজ করা, সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যস্ত থাকা— এগুলো চলতেই থাকে।
ঘুমের ওষুধ স্থায়ী সমাধান নয় : মোটামুটি হিসেবে, ছয় থেকে ১৮ বছরের শিশু-কিশোরদের প্রতি রাতে আট থেকে দশ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী পূর্ণবয়স্ক মানুষের ঘুমের প্রয়োজন প্রতি রাতে সাত থেকে নয় ঘণ্টা। ৬০ বছরের পর শারীরিক পরিশ্রম কমে আসার কারণে ঘুমের চাহিদা খানিকটা কমে যায়। বয়স্ক লোকদের অনেকেই রাতের ঘুমের ঘাটতি দিনের বেলায় পুষিয়ে নেন। তবে যারা কাজের চাপে সেটা করে উঠতে পারেন না, তারা সচরাচর উৎকণ্ঠানাশক ওষুধের শরণাপন্ন হন। ঘুমের ওষুধ নিয়মিত খেয়ে যাওয়ার অসুবিধাটা হলো— এগুলোতে সহজেই আসক্তি আসে। ঘুমটা তখন অনেকটা নেশার মতন। যত দিন যায়, একই পরিমাণ ঘুমের জন্য ওষুধের ডোজ বাড়াতে হয়। বাধানিষেধ সত্ত্বেও বহু মানুষ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই চেনাজানা দোকান থেকে ইচ্ছেমতো ঘুমের ওষুধ কিনে খেতে থাকেন। এই ধরনের ট্র্যাংকুলাইজারের প্রভাব চলে পরের দিনেও। ঝিমধরা ভাব কাজের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তার সঙ্গে কোষ্ঠকাঠিন্য, স্মৃতিভ্রম— এসব তো থাকেই।
সঠিক জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাস জরুরি : বিছানায় শুলেই যাতে ঘুম ঠিকমতো আসে, সেটা নিশ্চিত করতে খাবারদাবারের দিকেও নজর দেওয়া দরকার। ভরা পেটে অথবা খিদে নিয়ে শুয়ে পড়লে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। সন্ধের পর থেকে জল পান কমাতে হয়। এতে রাতে বাথরুম যাওয়ার তাগিদ কমে। সন্ধের পর চা-কফি-সিগারেট বাদ দেয়াই মঙ্গল।
ক্যাফিন আর নিকোটিনের প্রভাব শরীরে বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে থাকে এবং তাতে ঘুমের রীতিমতো ব্যাঘাত ঘটে। এদিকে, অ্যালকোহল বা মদ প্রথম দিকে ঘুম-ঘুমভাব এনে দিলেও বেশি রাতে বারবার ঘুম ভাঙায়। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে কোনো নির্দিষ্ট কাজ— যেমন গা-ধোওয়া, বই পড়া অথবা গান শোনা— এইসব নিয়মিত করলে ঘুম আসার পথটা সহজ হয়। ঘুমের আগে এই কাজগুলো করা মানেই যেন মস্তিষ্ককে মনে করিয়ে দেয়া হয়, এবারে ঘুমানোর সময় হয়েছে। এক্ষেত্রে রাতে ঘুমানোর সময়টুকু ছাড়া বিছানা ব্যবহার না করাই ভালো।
বায়োলজিক্যাল ক্লক ছন্দে রাখুন : আমাদের শরীরের ভেতরে যে ঐশীঘড়িটা আছে, যা মস্তিষ্ক এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করে, সেটা চলে দিন-রাতের হিসেবে। যেটাকে বলা হয় ‘সার্কাডিয়ান ছন্দ’। হাজার-লক্ষ বছর ধরে মানুষ সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার হওয়ার পর বিশ্রাম নিয়েছে, শুতে গিয়েছে। আবার দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে উঠে কাজ শুরু করেছে। এখনকার দিনে ঠিক এমনটা সম্ভব না হলেও, ছুটির আগের রাতেও এই নিয়মটা মানতে পারলে ঘুমের ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটে কম।
যারা দিনের বেলায় বাড়ির বাইরে যথেষ্ট ঘোরাফেরা করেন, গায়ে রোদ লাগান, যাদের ঘরে দিনের মধ্যে অনেকটা সময় সূর্যের আলো ঢোকে— তাদের শরীরে ‘মেলাটোনিন’ নামে এক ধরনের রাসায়নিক বেশি পরিমাণে তৈরি হয়। এই জিনিসটাই আবার ঘুম আর জেগে থাকার মধ্যেকার ছন্দটাকে বজায় রাখে। রোদে পুড়ে যাঁরা কাজ করেন, আর যাই হোক, তাঁদের অন্তত রাতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে না।
গেজেট ও ঘুম : মেলাটোনিনের প্রসঙ্গ যখন উঠলই, তখন টিভি কম্পিউটার, মোবাইল ফোনের সঙ্গে ঘুমের সম্পর্কের কথায় আসি। আমরা যখন অন্ধকারে অথবা কম আলোয় থাকি, মেলাটোনিন তখনই কাজ শুরু করে। ঘরে আলো জ্বালিয়ে শুলে মেলাটোনিনের নিষ্ক্রিয়তার কারণে ঘুম আসে না। টেলিভিশন, কম্পিউটার-ল্যাপটপের পর্দা স্মার্টফোন থেকে যে জোরালো কৃত্রিম আলো বের হয়, তা মেলাটোনিনকে কাজ করতে সরাসরি বাধা দেয়। এখন যে ব্লু-কাট লেন্সের চল রয়েছে, তা ব্যবহার করেও ল্যাপটপ অথবা মোবাইলের কৃত্রিম আলোকে যথেষ্ট স্তিমিত করা যায় কি না সন্দেহ।
তাছাড়া কম্পিউটার, মোবাইল, ওয়াই-ফাই, ব্লুটুথ সহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিন যন্ত্র সর্বক্ষণ যে বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় বিকিরণ করে, তাও মেলাটোনিনের সক্রিয়তার পক্ষে ক্ষতিকর। মেলাটোনিন নিষ্ক্রিয় থাকলে শরীরের ভেতরকার ঘড়িটা ঠিকঠাক কাজ করে না। তার কুপ্রভাব পড়ে আমাদের আবেগ, একাগ্রতা এবং বিভিন্ন হর্মোন নিঃসরণের ওপর।
বয়স্ক মানুষের তুলনায় ছোট ছেলেমেয়েদের মস্তিষ্কের ওপর কৃত্রিম উজ্জ্বল আলো এবং বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় বিকিরণের প্রভাব অনেক বেশি স্থায়ী হয়।
বয়স্কদের তুলনায় ছোটরা মোবাইল গেম এবং উত্তেজক ভিডিও-তে বেশি আসক্ত। দিনের অনেকটা সময় উত্তেজনার মধ্যে থাকার ফলে এদের মধ্যে যে মানসিক চাপ বাড়ে, তার ফলে রাগ-অস্থিরতাও বেশি দেখা যায়। শুধু মেলাটোনিনের নিষ্ক্রিয়তাই নয়, মোবাইল, ল্যাপটপের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার শরীরের মধ্যে যে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা তৈরি করে, তার ফলেই প্রয়োজনীয় গাঢ় ঘুম থেকে এরা বঞ্চিত থাকে। ঘুমের মধ্যে চমকে ওঠা, বারবার ঘুম ভেঙে যাওয়া এইসব উপসর্গের জন্যই সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরও এদের ক্লান্তি কাটে না।
ইদানীংকালে কোনো কোনো গবেষক বলছেন, রাত ১০টা থেকে সকাল ছ’টা— ঘুমের জন্য এটাই নাকি সবচেয়ে প্রশস্ত সময়।
বিষয়টা নিয়ে মতভেদ থাকলেও, ঘুমোতে যাওয়ার অন্তত এক ঘণ্টা আগে আমাদের প্রত্যেককে টেলিভিশন, ল্যাপটপ, স্মার্টফোনকে বিদায় জানানো উচিত— তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই।
সূত্র : বর্তমান