পরিতৃপ্ত ঘুমের জন্য যা করবেন
পরিতৃপ্ত ঘুম - ছবি সংগৃহীত
ডা. দেবাঞ্জন পানকেউ কেউ ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেন। আবার কারো কারো স্বপ্ন একটাই— একটানা, নিশ্ছিদ্র, নিশ্চিন্তে, শান্তির ঘুম! সুস্থ শরীর লাভের জন্য একজন প্রাপ্তবয়স্কের আট ঘণ্টা ঘুম আবশ্যিক এবং উপযোগী।
অসংখ্য গবেষণায় দেখা গেছে, জাগ্রত অবস্থায় সারাদিন ধরে আমাদের ব্রেনের মধ্যে নানা ক্ষতিকারক রাসায়নিক বর্জ্য পদার্থ জমা হয়। এই বর্জ্য বের করে দেয়ার কাজটি হয় ঘুমের সময়। ব্যাপারটা অনেকটা হোটেলের হাউজ ক্লিনিং-এর মতো। আমরা যখন হোটেল রুমের বাইরে বের হই, হাউজ ক্লিনিং-এর কর্মচারী হোটেলের ঘরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করে দেয়। আমরা ঘুরে এসে হোটেলের ঘর পরিষ্কার দেখে অবাক হয়ে যাই! এইভাবে ঘুমন্ত অবস্থায় কোষে সাফাইয়ের কাজ হয় বলেই শরীর সুস্থ থাকে। ঘুমের সঙ্গে আরও বহু শারীরিক লাভের বিষয় জড়িয়ে আছে।
ঘুমের উপকারিতা
একাধিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঘুম ঠিকঠাক হলে মন ভালো থাকে। তরতাজা লাগে।
ভালো ঘুমে হার্টও ভালো থাকে।
রক্তে ইনসুলিনের ক্ষরণ ভালো হয়। সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকায় ডায়াবেটিস প্রতিরোধ হয়। স্থূলত্বের ঝুঁকি কমে।
যাদের ঘুম কম হয়, তাদের স্ট্রেস বা দুশ্চিন্তা সামলানোর ক্ষমতা কম থাকে। ছোটখাট বিপদেও বড্ড দুশ্চিন্তায় ভোগেন তাঁরা। আর কোনো ব্যক্তি সবসময় দুশ্চিন্তায় ভুগলে তার শরীরে কর্টিজল হর্মোনের ক্ষরণও বেশিমাত্রায় হতে থাকে।
কর্টিজলের মাত্রা বাড়লে, হার্টের সমস্যা, স্ট্রোক ও স্থূলত্বের সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে।
নিয়মিত ঘুম কম হলে দেখা দিতে পারে মানসিক সমস্যা ও অবসাদ। আগেকার মানসিক সমস্যা আরও বাড়াবাড়ি জায়গায় যেতে পারে।
গভীর ঘুম কী?
ঘুমের নানা পর্যায় থাকে— ‘এনরেম’ বা নন র্যাপিড আই মুভমেন্ট এবং ‘রেম’ অথবা র্যাপিড আই মুভমেন্ট।
এন রেম : এন রেম-এর রয়েছে তিনটি পর্যায়। প্রথম পর্যায় স্থায়ী হয় ১০ মিনিটের কম সময় ধরে। এই পর্যায়ে যে কারও ঘুম চট করে ভাঙিয়ে দেয়া যায়।
দ্বিতীয় পর্যায় স্থায়ী হয় ৩০ থেকে ৬০ মিনিট। তৃতীয় স্টেজ স্থায়ী হয় ২০ থেকে ৪০ মিনিট। দ্বিতীয় পর্যায় থেকে ঘুম ক্রমশ গাঢ় হতে শুরু করে এবং ডেল্টা ওয়েভ (মস্তিষ্কের এক ধরনের তরঙ্গ) আসতে শুরু করে। তৃতীয় পর্যায়ে গিয়ে ডেল্টা ওয়েভ খুব ঘনঘন আসতে থাকে। এই সময় ঘুমের ইইজি করলে এক ধরনের গ্রাফ মিলবে। এই গ্রাফ যে বিশেষ রীতি মেনে চলে, তাকেই ‘স্লো স্লিপ ওয়েভ প্যাটার্ন’ বলে।
তরতাজা থাকার জন্য ঘুমের মধ্যে ধীর গতির তরঙ্গ আসা খুব জরুরি। অর্থাৎ সকালবেলা উঠে খুব সতেজ লাগলে বুঝতে হবে রাতে ঘুমের তৃতীয় পর্যায় পর্যন্ত আমরা পৌঁছেছিলাম।
রেম : এক্ষেত্রে অক্ষিগোলক খুব দ্রুত ঘোরাঘুরি করে। এই পর্যায়ে আমরা স্বপ্ন দেখি। ব্রেনও খুব সক্রিয় থাকে। মস্তিষ্কের অন্দরে থাকা আবেগের কেন্দ্র বা অ্যামিগডালাও সজাগ হতে শুরু করে। সারাদিনের নানা ঘটনা থেকে তৈরি হওয়া বোধগুলো স্বপ্নের আকারে চোখের সামনে ফুটে ওঠে। অথচ অদ্ভুত ব্যাপার হলো, রেম পর্যায়ে মস্তিষ্ক নিজে সজাগ থাকলেও, দেহের অঙ্গগুলোকে অবশ করে রাখে। এই কারণেই কোনো ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর আমরা হুড়মুড় করে উঠলেও দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারি না! রাতে যখন ঘুমোই, তখন এই এন-রেম এবং রেম বারবার ঘুরেফিরে আসতে থাকে। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে রেম খুব বেশি হয়। বড়দের ক্ষেত্রে এন-রেম।
ভালো ঘুম হচ্ছে না বুঝবেন কীভাবে?
ঘুমের সমস্যা মোটামুটি তিন ধরনের হয়—
• অনেকেই আছেন, রাত ১০টাতেই বিছানা দখল করেন। অথচ কিছুতেই ঘুম আসে না। বিছানাতে এপাশ-ওপাশ করতে থাকেন। এই ধরনের সমস্যার সঙ্গে অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার বা দুশ্চিন্তার যোগ রয়েছে।
• মাঝরাতে বারবার ঘুম ভেঙে যায় অনেকের। অনেকের আবার ঘুমের মধ্যে পা নড়ে। এই সমস্যাকে পিরিওডিক লিম্ব মুভমেন্ট বলে।
• কিছু লোকের খুব সকালে বা প্রায়ই ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে যায়। দেখা গেছে, খুব সকালে ঘুম ভাঙার সঙ্গে ডিপ্রেশনের যোগ রয়েছে।
কতক্ষণ ঘুম দরকার?
প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ঘুম হওয়া দরকার মোটামুটি আট ঘণ্টা।
ভালো ঘুমের জন্য যা যা দরকার
• শুধু ঘুমের জন্যই বিছানা ব্যবহার করতে হবে। বিছানায় বসে কোনোভাবেই টিভি বা মোবাইলে চোখ রাখা চলবে না। চলবে না পড়াশোনা করাও।
• প্রত্যেক দিন রাতে নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমোতে যাওয়া ও সকালে নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে ওঠা অভ্যেস করতে হবে। এটা শুরু করতে পারলেই মস্তিষ্ক নিজের মতো করে ঠিক করে নেবে কখন চোখে ঘুম নেমে আসা দরকার আর কখন জাগা প্রয়োজন।
• দিনের বেলা ৩০ থেকে ৪০ মিনিট ঘুমোনো বা ন্যাপ নেওয়া শরীরের পক্ষে খারাপ নয়। তার থেকে বেশি ঘুমোনো এড়িয়ে চলাই ভালো। সেক্ষেত্রে ‘রেস্টোরেটিভ স্লিপ সাইকেল’ বা নন রেম এবং রেম স্লিপ-এর চক্র বিঘ্নিত হয়।
• রাতে ঘুমোতে যাওয়ার এক ঘণ্টা আগে থেকে ঘরের উজ্জ্বল আলো বন্ধ করে মৃদু আলো জ্বেলে ঘুমের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। মৃদু আলোয় মেলাটোনিন বা ঘুমের সহায়ক হর্মোনের ক্ষরণ ভালো হয়। উজ্জ্বল আলোয় হয় ঠিক বিপরীত।
• কফি নয় : কফি দুপুরের পর থেকে না খাওয়াই ভালো। দেখা গেছে, যতটা পরিমাণে কফি খাওয়া হয়, শরীরে তার মাত্রা অর্ধেক হতে সময় লাগে চার ঘণ্টা! অর্থাৎ বেলা দু’টার সময় কেউ ২০০ মিলিগ্রাম কফি খেলে সন্ধ্যা ছ’টার সময় শরীরে কফির মাত্রা হবে ১০০ মিলিগ্রাম! এরপর রাত দশটার সময় খুব কম করে হলেও ৫০ মিলিগ্রাম কফি বেঁচে থাকবে। আর সবাই জানে কফি খুবই উত্তেজক পানীয়। ফলে কফি খেলে ঘুমের দফারফা হতে বাধ্য। তাই কফিপানের আদর্শ সময় হচ্ছে সকালবেলা।
মদ্যপানে ‘না’ : মদ্যপানের অভ্যেসও ঘুম নষ্ট করে। অ্যালকোহল দু’ভাবে ঘুম নষ্ট করে। প্রথমত, বারবার ঘুম ভাঙায়। দ্বিতীয়ত, খুব সকালে ঘুম থেকে তুলে দেয়! এছাড়া রেস্টোরেটিভ স্লিপ সাইকেল ঘেঁটে দেয় অ্যালকোহল।
চিন্তা সরান : ঘুমের আগে সমস্তরকম সমস্যা নিয়ে মনের মধ্যে আলোচনা করা যাবে না। মন থেকে চিন্তা দূর করার জন্য খুব নরম সিনেমার সেরা দৃশ্যগুলো মনে করার চেষ্টা করুন। অথবা প্রিয় ভ্রমণের জায়গাটির সম্পর্কে ভাবুন। সেই পাহাড়ি ঝর্ণার পাশে একা একা মনে শুয়ে পড়ুন অথবা কল্পনা করুন পুরীর সমুদ্রের ধারে বসে আছেন নির্জনে। ঢেউ গুনছেন। ঘুম আসবেই।
* প্রোগ্রেসিভ মাসল রিল্যাক্সেশনও অভ্যেস করতে পারেন। শুয়ে শুয়ে
* পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিভিন্ন পেশিগুলি দ্রুত সংকুচিত করুন ও
* খুব ধীরে ধীরে প্রসারিত করুন।
* অথবা শ্বাসের ওঠানামার সঙ্গে
* পেটের ওঠানামা প্রত্যক্ষ করুন। প্রাণধারণের এমন অত্যাশ্চর্য প্রক্রিয়াগুলি দেখে অবাক হন। দেখবেন * দুশ্চিন্তা সরে গিয়ে চোখে ঘুম নেমে আসবে।
• বিছানায় শুয়ে একেবারেই ঘুম
না আসলে ছটফট করবেন না। তাহলে একই ঘটনা রোজ ঘটবে। মস্তিষ্ক, বিছানা আর ঘুম একে অপরের সঙ্গে মানিয়ে গুছিয়ে চলে। তাই বারবার এপাশওপাশ না করে বিছানা থেকে উঠে যান। জানালার কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকুন। শীতল বাতাস মনের গ্লানি ধুয়ে দেবে। দেখবেন ধীরে ধীরে ঘুম আসছে।
সূত্র : বর্তমান