বাইডেনের আমলে ইরান-পাকিস্তান উত্তেজনা বাড়বে?

রুপার্ট স্টোন | Nov 25, 2020 04:22 pm
বাইডেনের আমলে ইরান-পাকিস্তান উত্তেজনা বাড়বে?

বাইডেনের আমলে ইরান-পাকিস্তান উত্তেজনা বাড়বে? - ছবি সংগৃহীত

 

জো বাইডেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভের পরপরই ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ দু’দিনের সফরে পাকিস্তান যান। পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্ক উষ্ণ। তবে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রে তাদের সম্পর্ক সেই তুলনায় অনেক কম।

এর জন্য আংশিকভাবে দায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি জয়েন্ট কম্প্রেহেনসিভ প্লান ফর অ্যাকশন (জেসিপিওএ) নামে পরিচিত ইরানের পরমাণু চুক্তি থেকে বের হয়ে গেছেন, ইরানের ওপর কঠোর অবরোধ আরোপ করেছেন। কিন্তু ট্রাম্প শিগগিরই বিদায় নেচ্ছেন, তার স্থলাভিষিক্ত হতে যাচ্ছেন জো বাইডেন।তিনি জেসিপিওএতে আবার প্রবেশের কথা বলেছেন।

জারিফ ও তার পাকিস্তানি প্রতিপক্ষ বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের উপায় নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাত্ত্বিকভাবে অবরোধ প্রত্যাহার করা হলে তাদের লক্ষ্য বাস্তবায়নে সহায়ক হবে। তবে বাইডেনের আমলে ইরান-পাকিস্তান সম্পর্ক ব্যাপকভাবে উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে সংশয় আছে।
প্রথম কারণ হলো,বাইডেন যে জেসিপিওএতে যোগ দেবেন, তা সুনিশ্চিত নয়। বর্তমান ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি আগামী বছর দায়িত্ব ত্যাগ করছেন। রাজনৈতিক উদারপন্থী হিসেবে তিনিই ওই চুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন।এদিকে ইরানি সংস্কারকরা জনপ্রিয়তা হারাচ্ছেন। ফলে রুহানির স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন কোনো আমেরিকানবিরোধী কট্টরপন্থী।

অধিকন্তু, ইরান চুক্তিটি এখন ইরানিদের মধ্যে বেশ অজনপ্রিয়। তারা এ চুক্তি থেকে প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক সুবিধা পায়নি।ইরান চুক্তির শর্তাবলী মেনে চলা সত্ত্বেও ট্রাম্প একতরফাভাবে জেসিপিওএ বাতিল করায় এবং করোনাভাইরাস মহামারির সময়ও কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ অব্যাহত রাখায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আস্থা বেশ কমে গেছে।

তাছাড়া এমন আশঙ্কাও আছে যে দায়িত্ব ত্যাগ করার আগে ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্র আরো চাপ সৃষ্টি করবে, আরো উস্কানি দেবে। তিনি নির্বাচনের পরপরই ইরানি পরমাণু স্থাপনাগুলোর ওপর হামলা চালানোর কথা বিবেচনা করেছিলেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এ ধরনের কৌশল সামরিক সঙ্ঘাত উস্কে দিতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের জেসিপিওএতে ফিরে যাওয়া জটিল করে ফেলতে পারে।

তাছাড়া ট্রাম্প দৃশ্যত জানুয়ারিতে বিদায়ের আগে অবরোধের বন্যা বইয়ে দিতে পারেন। এর জবাবে পরমাণু তৎপরতা জোরদার করে ইরানও জেসিপিও আরো বেশি করে লঙ্ঘন করে ফেলতে পারে। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র তেলের ওপর ছাড় বাতিল করলে তেহরান চুক্তিটি লঙ্ঘন করতে শুরু করে। এসব পদক্ষেপ বর্তমানে পরিবর্তনযোগ্য হলেও অব্যাহত লঙ্ঘন চুক্তিটি নষ্ট করে দিতে পারে।

এমনকি জেডিপিওএ টিকে গেলেও একে আবার ফিরিয়ে আনা হবে বেশ কঠিন কাজ। বাইডেন ইরানের প্রতিরক্ষা ক্ষমতা হ্রাস করার বিনিময়ে চুক্তিতে ফিরে যাওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু তা ইরানিরা মেনে নেবে না।তাছাড়া অবরোধ পুনর্বহালের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে ইরান। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তা গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে।

তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক অংশীদারদের বিষয়ও রয়েছে। বিশেষ করে ইসরাইল, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ওই চুক্তির বিরোধী ছিল তারাও চুক্তিটি পুনর্বহালের বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করবে। তাছাড়া বাইডেন প্রশাসনের কাছে ইরান অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত দেশ হবে না। তাদের কাছে এখন করোনাভাইরাস ও অর্থনৈতিক সঙ্কটই বেশি গুরুত্ব পাবে।

তবে ইতিবাচক দিক হলো, ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ২০১৫ সালের চেয়ে এখন অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ জেসিপিওএর পেছনে। দলের প্রায় সব প্রেসিডেন্ট প্রার্থীই চুক্তিটিতে ফিরে যাওয়ার কথা বলেছে। অবশ্য সিনেট এখনো রিপাবলিকানদের হাতেই রয়েছে। ফলে তারা বাইডেনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
পরবর্তী প্রেসিডেন্টকে মাইনফিল্ড দিয়ে চলা সহজ করার জন্য বিশ্লেষকেরা পর্যায়ক্রমে পরমাণু চুক্তিতে ফিরে যাওয়ার পথ বলে দিয়েছেন। তাদের মতে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালের মধ্যে ধীরে ধীরে ওই চুক্তিতে ফিরে যেতে পারে। উল্লেখ্য, ওই সময়ই রুহানি সরে যাবেন। তারপর তারা ক্ষেপণাস্ত্র ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে বৃহত্তর আলোচনায় অগ্রসর হতে পারে।

অবশ্য জেসিপিওএতে ফিরে যাওয়াই সর্বরোগের ওষুধ নয়।এই চুক্তিতে ফিরে গেলে ইরানের সাথে তৃতীয় পক্ষের ব্যবসা করার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা রয়েছে, তা বাতিল হবে। এটা আমেরিকান কোম্পানিগুলোর সাথে ইরানের ব্যবসা করা বা ডলার দিয়ে বাণিজ্য করার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হবে না।
এ কারণেই পরমাণু চুক্তি সই হওয়ার পরও ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য খুব বেশি ছিল না। ২০১৫ সালে দুই দেশ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ২০২১ সালের মধ্যে দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু তারা এর কাছাকাছিও যেতে পারেনি। ফলে জেসিপিওএ অবরোধ প্রত্যাহার হলেও তা থেকে পাকিস্তান উপকৃত হতে পারে সামান্যই।

আরো কিছু কারণেও দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য সীমিত হয়ে আছে। এসবের একটি হলো দুই দেশের মধ্যে পরিবহন কানেকটিভিটির স্বল্পতা। তাছাড়া করোনাভাইরাস জনিত সমস্যাও বাণিজ্য সম্প্রসারণ সহজ করছে না।

আরেকটি বাধা আসতে পারে ইরানের শত্রু সৌদি আরবের কাছ থেকে। এই দেশের সাথে পাকিস্তানের ঘনিষ্ট অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ক রয়েছে। দেশটি পাকিস্তানের ওপর বেশ প্রভাবও বিস্তার করে। সৌদি চাপের কারণেই ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যকার গ্যাপ পাইপলাইন প্রকল্পটি অনেক দিন ধরে বিলম্বিত হচ্ছে।
আরো খারাপ বিষয় হলো, পাকিস্তানের চির-প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত সম্ভবত জেসিপিওএ ফিরে যাওয়ার ফলে তুলনামূলকভাবে বেশি লাভবান হবে। ইরান থেকে ভারত বিপুল পরিমাণে তেল আমদানি করত। তাছাড়া চাবাহার বন্দর প্রকল্পেও বিনিয়োগ করেছিল ভারত। এসব চুক্তি স্থগিত হয়ে এলেও আবার চাঙ্গা হতে পারে।

ভারত ও ইরানের সাথে ঘনিষ্ঠতর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হলে কাশ্মিরিদের প্রতি তেহরানের সমর্থন হ্রাস পেতে পারে। সাম্প্রতিক সমযে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ও অন্যান্য কর্মকর্তা কাশ্মির প্রশ্নে পাকিস্তানি অবস্থানের প্রতি অনেক বেশি সহায়ক ছিল। কিন্তু ভারতের সাথে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক বৃদ্ধি পেলে কাশ্মির প্রশ্নে সুর নমনীয় করে ফেলতে পারে ইরান।

ইসলামাবাদে জারিফের সফরের ফল কী হয়েছে, তা জানা যায়নি। আগেরবার দ্বিপক্ষীয় সফরে চাবাহারকে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপিইসি) সাথে যুক্ত করার কথা থাকলেও এবার তা উল্লেখ থাকেনি।
জেসিপিওএ আবার সামনে আসার ইরান এখন আর ভারতকে ক্ষেপাবে না।তেহরান বেশ সতর্ক থাকবে।
আবার জেসিপিওএ পুনঃপ্রতিষ্ঠা হলে ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনাও বাড়তে পারে। অবরোধ প্রত্যাহার হলে ভারত ইরানি বাজারে প্রবেশ করার চেষ্টা করবে। এতে করে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারত গুপ্তচরবৃত্তি চালানোর কাজও শুরু করতে পারে।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে ধরা পড়া ভারতীয় গুপ্তচর কূলভূষণ যাদব ইরান হয়েই পাকিস্তানে প্রবেশ করেছিল। এর পর থেকেই পাকিস্তানে ইরানি গোপন অভিযান বাড়ছেই।
আফগানিস্তানও হতে পারে আরেকটি ফ্ল্যাশপয়েন্ট। ১৯৯০-এর দশক থেকে আফগানিস্তানে দুই দেশ পরস্পর বিরোধী অবস্থানে রয়েছে। তালেবানকে সমর্থন করছে পাকিস্তান। কিন্তু তালেবানের বিরোধী গ্রুপ নর্দার্ন অ্যালায়েন্সকে সমর্থন করছে ইরান। অবশ্য এখন শান্তিপ্রক্রিয়ায় তালেবানকে সমর্থন করছে ইরান। কিন্তু তারা আফগানিস্তানে এমন সরকার চায়, যাতে তালেবানের একচ্ছত্র প্রাধান্য থাকবে না। এখানেও পাকিস্তানের সাথে তাদের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে পারে।

সবমিলিয়ে বলা যায়, বাইডেনের আমলে ইরান-পাকিস্তান সম্পর্ক কিছুটা উন্নতি হলেও বড় ধরনের পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

সূত্র : ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us