যুদ্ধসাজে নরেন্দ্র মোদি
যুদ্ধসাজে নরেন্দ্র মোদি - ছবি : সংগৃহীত
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ১৩ নভেম্বর পাকিস্তান সীমান্তের রাজস্থানের জয়সালমারে সৈনিকদের সাথে দিওয়ালি উৎসব উদযাপন করেছেন। গত কয়েকটি দিওয়ালির মতো এবারো তিনি সেনাবাহিনীর পোশাক পরে সৈনিকদের উদ্দেশে বক্তৃতা করেন এমনভাবে যাতে মনে হতে পারে যে তিনি সামরিক কমান্ডার।
মনে করা যেতে পারে, লৌহমানব মোদি হিসেবে ইমেজ বৃদ্ধির জন্য সেনাবাহিনীর পোশাক পরার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে তার। তবে বিষয়টি যদি এর চেয়েও বেশি দূর চলে যায়, তখনই উদ্বেগের সৃষ্টি হয়।
মোদির মুখপত্রগুলো, ভারতীয় মিডিয়া, এই ইমেজ বাড়ানোতে সহায়তা করে থাকে যে মোদি যদি থাকেন, তবে সবই সম্ভব। ২০১৪ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতা ও নীতিগত সিদ্ধান্তে হিতে বিপরীত হওয়া সত্ত্বেও তিনি লৌহমানবের ইমেজটি ধরে রাখতে পেরেছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে মোদির ঘনিষ্ঠতাও বিদেশে তার শক্তিশালী ইমেজ বিকাশে সহায়ক হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে ভারত সফরের সময় মোদিকে ট্রাম্প লৌহমানব ও কঠিন ব্যক্তি হিসেবে চিত্রিত করেছেন।
ট্রাম্প বলেছেন, মোদি খুব ধার্মিক ও শান্ত মানুষ। তবে তিনি আসলে খুবই খুব শক্তিশালী মানুষ, খুবই কঠিন। আমি তাকে কাজে দেখেছি।
মোদিকে ২০১৬ সালে পাকিস্তানে সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানায় সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হানার পর থেকে ভারতীয় ভূখণ্ড রক্ষা করতে সক্ষম শক্তিশালী রাজনীবিদ বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
মে মাস থেকে এই ইমেজ আরো বিকশিত হয় লাদাখে চীনা সামরিক চাপের বিরদ্ধে তার দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোর কারণে।
সর্বোপরি ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থকেই তার লৌহমানব ইমেজ বাড়ানোর জন্য মোদি কোনো কিছুই করা বাকি রাখেননি।
তার এসব কৌশলের একটি হলো সেনাবাহিনীর জওয়ানদের সাথে দিওয়ালি উদযাপন।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সাল পর্যন্ত ভারতীয় সৈনিকদের সাথে দিওয়ালি উদযাপনের সময় মোদি বেসামরিক পোশাক পরতেন। ২০১৭ সাল থেকে তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর যুদ্ধ পোশাকে আবির্ভূত হচ্ছেন।
তার আগে ভারতের একেবারে প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহেরলাল নেহরু থেকে শুরু করে কোনো প্রধানমন্ত্রীই, এমনকি বিজেপির অটল বিহারি বাজপেয়িও, প্রকাশ্যে সেনাবাহিনীর পোশাক পরেননি।
বেশির ভাগ উদার গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচিত নেতা সামরিক কমান্ডার হওয়া সত্ত্বেও কখনো সামরিক পোশাকে উপস্থিত হন না। আপনি কি কখনো মার্কিন বা ফরাসি প্রেসিডেন্টকে সামরিক পোশাকে প্রকাশ্যে দেখেছেন?
একইভাবে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোনো প্রধানমন্ত্রীও বিশ্বের কোথাও সামরিক পোশাকে উপস্থিত হন না। এমনকি সামরিক বাহিনীতে আগে কাজ করা রাজনৈতিক নেতারাও এ কাজ করেন না। সব দেশের জন্যই এটি সাধারণ রীতি। কিন্তু ভারতে এই নিয়ম খাটে না। অথচ সামরিক বাহিনীতে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা নেই মোদির।
ভারতে রাষ্ট্রপতি হলেন সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীল সর্বোচ্চ কমান্ডার। রাষ্ট্রপতির সামরিক পোশাক পরার অধিকার আছে।
ভারতে বেসামরিক সরকারের নেতা প্রধানমন্ত্রী। তবে সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রণ বেসামরিক সরকারের হাতেই। মন্ত্রিসভাই সামরিক বাহিনীর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত। ফলে প্রধানমন্ত্রীর হাতে সামরিক বাহিনীর সিদ্ধান্ত্রগ্রহণের ক্ষমতা থাকে।
ভারতের পদক্রম হলো : রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, প্রতিরক্ষাসচিব, চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ, তিন বাহিনীর প্রধান যথাক্রমে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী।
অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ ও তিন বাহিনীর প্রধানের অনেক ওপরে।
তবে ভারতীয় সামরিক বাহিনীকে সরাসরি নির্দেশ দেয়ার কোনো ক্ষমতা নেই প্রধানমন্ত্রীর। এই নির্দেশ দেবে মন্ত্রিসভা এবং নির্দেশে সই করবেন রাষ্ট্রপতি।
আর এ কারণেই ভারতের বেসামরিক নেতা বা প্রশাসকেরা দীর্ঘ দিন ধরেই সামরিক পোশাক পরতেন না।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী সাধারণত সেনাবাহিনীর কোনো অনুষ্ঠানে সামরিক বাহিনীর পোশাক পরে উপস্থিত থাকেন না।
মোদি যে সামরিক পোশাক পরেন, তাতে কোনো পদবি থাকে না।তিনি দেশে ও বিদেশে এই পোশাক পরে কী বার্তা দিতে চান, তা বিবেচনার দাবি রাখে। দুটি সম্ভাবনা থাকতে পারে এখানে।
অভ্যন্তরীণভাবে মোদি সরকার তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। অতি সম্প্রতি তিনি কোভিড-১৯ মহামারি দূর করতে পারেননি। একইসাথে ভারতের অর্থনীতি গত ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে।
আবার ভারতীয় সেনাবাহিনী লাদাখে চীনা বাহিনীর বিরুদ্ধে মুখোমুখি অবস্থায় রয়েছে আট মাস ধরে।
এই প্রেক্ষাপটে সামরিক পোশাক পরা মানে তার ভয়াবহ ব্যর্থতা থেকে জনগণের দৃষ্টি আড়াল করতে তার লৌহমানব ভাবমূর্তি ছড়িয়ে দেয়াই লক্ষ্য।
মোদি যদি চীন ও পাকিস্তানের কাছে লৌহমানবের ইমেজ ছড়িয়ে দিতে চান, তবে তাতে উদ্বেগের কিছু নেই।
কিন্তু তার যদি সামরিক স্বৈরাচারের ভূমিকা পালনের উচ্চাভিলাষ থাকে, তবে তা বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের জন্য বড় ধরনের হুমকি হতে পারে।
তবে মোদির যদি সামরিক স্বৈরাচার হওয়ার কোনোই উচ্চাভিলাষ না থাকে, তা সত্ত্বেও তিনি তার রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য দীর্ঘ দিন ধরে চলা রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ সামরিক প্রতিষ্ঠানকে তিনি অপব্যবহার করছেন।
সূত্র : এশিয়া টাইমস