জুলিয়ানি কি ট্রাম্পকে ক্ষমতায় রাখতে পারবেন?
ডোনাল্ড ট্রাম্প - ছবি : সংগৃহীত
অবাক করার বিষয়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এত দিনেও নির্বাচনে পরাজয় স্বীকার করেননি। যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ দিনের ঐতিহ্য হচ্ছে, বিজয়ী প্রার্থীকে পরাজিত প্রার্থীর অভিনন্দন জানানো। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই ঐতিহ্যের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন। উল্টো বলেছেন, নির্বাচনে তিনিই বিজয়ী হয়েছেন। ৪ নভেম্বর হোয়াইট হাউজে প্রেস ব্রিফিংয়ে নিজেই নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করে দেন। এরপর একের পর এক টুইটে ট্রাম্প ‘নির্বাচনে আমিই বিজয়ী’ বলে প্রচার করেছেন। জো বাইডেনের কাছে পরাস্ত হয়েছেন, অথচ ট্রাম্প কিছুতেই তা মানতে রাজি নন। গত ১৬ নভেম্বর রোববার একবার টুইটে তিনি নির্বাচনে পরাজয় স্বীকার করেন এই বলে যে, ‘নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে বলেই বাইডেন জিতেছেন।’ এর পরই আবার টুইট করেছেন, ‘হার মানার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, আমরাই জয়লাভ করব।’ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কোনো প্রমাণ ছাড়াই ভোট জালিয়াতি ও চুরির অভিযোগ তোলেন। তিনি ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে অসাংবিধানিক আখ্যায়িত করে মামলা করার হুমকি দিলেন। তিনি দাবি করেন, লিগ্যাল ভোটে তিনিই জয়লাভ করেছেন।
পোস্টাল ভোটকে তিনি বলছেন ‘অবৈধ’ ভোট। পোস্টাল ভোট বাতিলেরও তিনি বারবার দাবি জানান। কয়েকটি রাজ্যে আবার ভোট গণনারও দাবি করেন। তিনি নেমে পড়েন আইনি লড়াইয়ে। মিশিগান, উইসকনসিন, জর্জিয়া ও পেনসিলভানিয়ায় ভোট গণনা বন্ধ এবং পোস্টাল ভোট বাতিলের জন্য মামলা করেছিলেন। কিন্তু আদালতে সেসব মামলা খারিজ হয়ে যায়। কারচুপি নিয়ে ট্রাম্প তার অভিযোগের সপক্ষে একটি প্রমাণও তুলে ধরেতে পারেননি। তার পরও ট্রাম্পের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন রাজ্যে তদন্ত করা হয়, ভোট পুনঃগণনা করা হয়। তদন্ত ও পুনঃগণনা শেষে নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী কর্মকর্তা তথা হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অর্থাৎ সাইবার সিকিউরিটি এজেন্সি (সিআইএসএ) স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, এই নভেম্বরের নির্বাচন ‘যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে সুরক্ষিত নির্বাচন’। তারা এ কথাও জানিয়ে দেন, ‘এ নির্বাচনে কোনো ভোট মুছে যাওয়া, বাতিল হওয়া বা অন্য কোনো ধরনের জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’
ট্রাম্পের আইনি লড়াইয়ে টিম থেকে অন্যান্য আইনজীবী যখন সুবিধা হবে না ভেবে সটকে পড়তে থাকেন, ঠিক তখন প্রধান কৌঁসুলি হিসেবে ট্রাম্পকে উদ্ধার করতে আসেন নিউ ইয়র্কের সাবেক মেয়র রুডি জুলিয়ানি। তিনি একজন আইনজীবী। তবে আইন অঙ্গনে তিন দশক ধরে ছিলেন অনুপস্থিত। ট্রাম্পের জন্য ফেডারেল মামলায় প্রায় তিন দশক পর তিনি আদালতে উপস্থিত হন। ৯/১১ এর টুইন টাওয়ার হামলার সময় তিনি নিউ ইয়র্কের মেয়র ছিলেন।
এ সময় তার সাহসী ভূমিকায় নিউ ইয়র্ক শহর আবার জেগে ওঠে। তিনি এ জন্য ‘আমেরিকার মেয়র’ নামে উপাধি পান। কিন্তু সেই জুলিয়ানি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভিত্তিহীন অভিযোগ আমলে নিয়ে তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয়বার হোয়াইট হাউজে রাখার জন্য ট্রাম্পের আইনসংক্রান্ত প্রধান পরামর্শদাতা হলেন। তিনি দাবি করেন নির্বাচনে ‘কারচুপির প্রমাণ’ আছে তার কাছে। তিনি জানান, কানাডা থেকে ভোট গণনার যে মেশিন আনা হয়েছে তাতে এমন সফটওয়্যার দেয়া হয়েছে যাতে বাইডেনের পক্ষে ভোট চুরি করা হয়েছে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, জুলিয়ানির দায়ের করা সব মামলাও খারিজ হয়ে যায়। কারণ, আদালতে কোনো প্রমাণ তিনি দেখাতে পারেননি। এ মামলার জন্য তাকে প্রতিদিন রিপাবলিকান শিবির তথা ট্রাম্পকে দিতে হচ্ছে ২০ হাজার ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গনে মুখরোচক আলোচনা, শেষ মুহূর্তে ট্রাম্পের কাছ থেকে রুডি জুলিয়ানির মোটা অঙ্কের কিছু টাকা হাতিয়ে নেয়া ছাড়া লাভের লাভ আর কিছু হবে না।
কিন্তু তারপরও ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের ফল পাল্টানোর জন্য ভিন্ন পথে হাঁটছেন। সর্বশেষ তিনি মিশিগানের আইন পরিষদের রিপাবলিকান নেতৃত্বকে হোয়াইট হাউজে ডেকে এনে চাপ দেন তারা যাতে বাইডেনের ফল অগ্রাহ্য করে এমন ইলেকটর বাছাই করেন যারা ট্রাম্পকে সমর্থন দেবেন। এই অবাস্তব প্রস্তাবে তারা নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন। এর আগে পেনসিলভানিয়া রাজ্যের ভোট গণনা স্থগিত রেখে, রাজ্য আইনসভাকে ইলেকটোরাল কলেজ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আদালতে আবেদন করা হয়। তদুপরি, উইসকনসিন রাজ্যের জনবহুল এলাকাগুলোতে ভোট পুনঃগণনার জন্য ৩০ লাখ ডলার ফি জমা দেয়া হয়। রাজ্যগুলোর ভোটের ফলাফল সার্টিফাই না করার জন্য ট্রাম্পের পক্ষে আবেদন জানানো হলো।
যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি প্রতিষ্ঠান দ্য জেনারেল সার্ভিসেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিএসএ) সব রাজ্যের ভোটের ফলাফল সই করার পরই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখন পর্যন্ত এ ঘোষণা আটকে রেখেছেন। এমন ঘোষণা দেয়ার পরই ক্ষমতার পালাবদল বা ট্রানজিশনের কাজ শুরু হয়। ট্রানজিশনের জন্য ফেডারেল অর্থ উন্মুক্ত হয় এবং নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থা থেকে ব্রিফিং দেয়া হয়। জিএসএ এখন পর্যন্ত সব রাজ্যের ফলাফল সার্টিফাই না করায় ট্রানজিশন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবে ৮ ডিসেম্বরের মধ্যে জিএসএকে ফলাফল সার্টিফাই করতে হবে, এটাই নির্দেশনা রয়েছে।
সর্বশেষ খবর হচ্ছে, জর্জিয়ায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বড় ধাক্কা খেয়েছেন। সেখানে হাতে ভোট গণনাও সম্পন্ন হয়েছে। রাজ্যজুড়ে নিরীক্ষা শেষে নির্বাচন কমিশন জো বাইডেনকে সরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেছে। পেনসিলভানিয়ায় ট্রাম্পের পক্ষে করা সর্বশেষ মামলাও বাতিল হয়ে গেছে। অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘খেলা শেষ’। এরই মধ্যে তিনি হোয়াইট হাউজে তার সহযোগী উপদেষ্টাদের কাছে স্বীকার করেছেন, নির্বাচনে তিনি পরাজিত হয়েছেন। ট্রাম্পের আনুষ্ঠানিক পরাজয় স্বীকার করা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ট্রাম্পের যে মনমানসিকতা তিনি আদৌ নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানাবেন কি না, কেউই এর সঠিক পূর্বাভাস দিতে পারছেন না।