ট্রাম্পের পতনে কার লাভ, কার ক্ষতি?

হামিদ মীর | Nov 21, 2020 05:50 pm
ট্রাম্প

ট্রাম্প - ছবি সংগৃহীত

 

তিনি প্রগলভ, রাগী, জেদি, আত্মম্ভরী, ঝগড়াটে ও উগ্র, তবে নিজ সমর্থকদের কাছে হিরো। এমন এক হিরো, যিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ‘বিশ্বাসঘাতক প্রতারক’ অভিহিত করেছেন এবং ঘৃণা-বিদ্বেষকে স্বীয় রাজনীতির ভিত বানিয়েছেন। আপনাদের বোঝার কথা বিদ্বেষের রাজনীতি করা এই ব্যক্তির নাম ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি চলতি মাসের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। ট্রাম্প আমেরিকার ইতিহাসের প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের ওপর কমপক্ষে পঁচিশবার বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণার মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করেছেন। কিন্তু কোনো একটি অভিযোগও প্রমাণ করতে পারেননি। প্রথম বছর তিনি মার্কিন টিভি চ্যানেল সিএনএনের বিরুদ্ধে ‘ফেক নিউজ’ ছড়ানোর অভিযোগ আরোপ করেন এবং এই চ্যানেল বয়কটের আবেদন জানান। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের নিয়মতান্ত্রিক ফল সামনে আসার আগেই ট্রাম্প তার জয়ের ঘোষণা করেন এবং এ ঘোষণা এ বছরের সবচেয়ে বড় ফেক নিউজে পরিণত হয়। এই হঠকারী ট্রাম্প, যিনি অন্যের ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে তার সম্মান নিয়ে টানাহেঁচড়া করেছেন, আজ নিজেই সারা বিশ্বে ফেক নিউজের নিদর্শনে পরিণত হয়েছেন।

ট্রাম্প শুধু একজন ব্যক্তির নাম নয়, বরং এটি একটি রীতিনীতির নাম। আজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমরা ট্রাম্পের মতো রাজনীতিবিদকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বিরাজমান দেখতে পাই, যারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর কোনো প্রমাণ ছাড়াই প্রতারণার অভিযোগ আনেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে দাবানোর চেষ্টা করেন, ধর্ম-বর্ণ-ভাষার বৈষম্যের ভিত্তিতে সংখ্যালঘুদের অধিকার হরণ এবং নিজের সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করেন।

ট্রাম্পের পরাজয় দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের কয়েকটি দেশে ডানপন্থীদের স্বার্থান্ধ রাজনীতির পতনের সূচনা। এ ধরনের রাজনীতিবিদ নেতা শুধু মিথ্যা ওয়াদা করেন। জনগণকে জুলুম, অবিচার ও ঊর্ধ্বমূল্য থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখান এবং শাসক হওয়ার পর নিজেরা জালিম হয়ে যান। তারা দরিদ্রদের ওপর ঊর্ধ্বমূল্য চাপিয়ে দেন; অতঃপর অযোগ্যতা ও দুর্নীতিকে আড়াল করার জন্য বিরোধী পক্ষের ওপর দুর্নীতির অভিযোগ আরোপ করেন। যখন অন্যদের ওপর আরোপিত দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয় না, তখন ট্রাম্পের মতো নেতাদের শেষ আশ্রয়স্থল হয় দেশপ্রেম। তখন তারা অনেক বড় ‘দেশপ্রেমিক’ হয়ে যান এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ‘দেশের শত্র“’ অভিহিত করতে থাকেন। ট্রাম্প তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ওবামাকে শুধু এ জন্য বিশ্বাসঘাতক অভিহিত করেছেন যে, তিনি তার বিরোধী দলের ছিলেন এবং তার বর্ণ ছিল ভিন্ন।

ট্রাম্প অভিযোগ করেছেন, ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ওবামা আমার বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করিয়েছেন এবং এটা ‘বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর’। ওবামা প্রেসিডেন্ট হয়ে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের এক করেছেন। আর ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হয়ে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করেন। ট্রাম্প শুধু শ্বেতাঙ্গদেরকে নিজের শক্তি বানানোর চেষ্টা করেছেন। যে কেউ ট্রাম্পের সমালোচনা করেছেন, তিনিই ‘দেশের শত্র“’ অভিহিত হয়েছেন। ট্রাম্প নিউ ইয়র্ক টাইমস ও ওয়াশিংটন পোস্টের মতো পত্রিকার বিরুদ্ধেও বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আরোপ করেছেন। তার দেখাদেখি কয়েকটি গণতান্ত্রিক দেশের ডানপন্থী সরকারও মিডিয়াকে দাবানোর চেষ্টা শুরু করে দেয়। কিন্তু মিডিয়াকে উপদেশ গ্রহণের নিদর্শন বানানোর প্রচেষ্টাকারী ট্রাম্প আজ নিজেই উপদেশ গ্রহণের নিদর্শনে পরিণত হয়েছেন।

স্মরণ করুন, ট্রাম্প ২০১৫ সালে লন্ডনের মেয়র সাদেক খানের ব্যক্তিত্বের ওপর আক্রমণ শুরু করেছিলেন। ট্রাম্প তার প্রথম নির্বাচনী অভিযানে ঘোষণা করেছিলেন, তিনি মুসলমানদের আমেরিকায় প্রবেশ বন্ধ করে দেবেন।’ সাদেক খান এই বক্তব্যের নিন্দা প্রকাশ করেছিলেন। তাই ট্রাম্প সাদেক খানকে কয়েকবার অযোগ্য বলে অভিহিত করে বলেন, লন্ডনের এক নতুন মেয়র প্রয়োজন। সাদেক খান ট্রাম্পের পছন্দের মানুষ ছিলেন না, কারণ তিনি মুসলমান। বিদ্বেষ ও গোঁড়ামিকে ভিত্তি করে রাজনীতি করা ট্রাম্পের সাদেক খানকে ভালো লাগত না। কিন্তু যেখানে ট্রাম্পের নিজের স্বার্থ, সেখানে তিনি মুসলমান হলেও বাদশাহদের সাথে নাচতেও গর্ব অনুভব করতেন। ট্রাম্পের এ ‘ইউটার্ন’ তাকে পরাজয় থেকে রক্ষা করতে পারেনি। আর ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ, খ্রিষ্টান-মুসলমান, বৃদ্ধ-যুবক সবাই মিলে ট্রাম্পকে পরাজিত করেছেন।

এটা একজন ব্যক্তির নয়, বরং দৃষ্টিভঙ্গির পরাজয়। বিশ্বের বেশির ভাগ গণতান্ত্রিক দেশে যুবক নেতা প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। কিন্তু আমেরিকা ৭৮ বছর বয়স্ক জো বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট বানিয়ে এ বার্তা দিয়েছে যে, তাদের একজন এমন চিন্তাশীল ও অভিজ্ঞ নেতার প্রয়োজন, যিনি আমেরিকাকে এক করতে রাখতে পারেন। জো বাইডেন আদর্শিক বা অনেক বড় বিপ্লবী নেতা নন। ত্রিশ বছর বয়সে প্রথমবার সিনেটর হন এবং আটাত্তর বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট হলেন। তার জয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলা হ্যারিস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, যার কারণে জো বাইডেনকে আফ্রিকান বংশোদ্ভূত ও এশিয়ান মার্কিনিরা বিশাল সংখ্যায় ভোট দেন। ট্রাম্প মার্কিন সমাজে এতটাই বিদ্বেষ ও শঙ্কা ছড়িয়ে রেখেছিলেন যে, বিজয়ের ঘোষণায় বাইডেনের সমর্থকরা অতি আবেগের কারণে কাঁদতে থাকেন। তাদের মনে হয়েছে, আমেরিকা দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা অর্জন করল।

জো বাইডেনের বিজয়ে মজলুম কাশ্মিরিরাও আনন্দিত। কেননা তারা মনে করেন, ৫ আগস্ট, ২০১৯ সালে কাশ্মিরের যে পতন হয়েছে, তাতে নরেন্দ্র মোদি ট্রাম্পের নীরব সমর্থন লাভ করেছিলেন। জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিস ৫ আগস্ট, ২০১৯-এর পর কাশ্মিরিদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানের নিন্দা করেছিলেন। ওবামার শাসনকালে জো বাইডেন ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি নওয়াজ শরিফ, আসিফ জারদারি ও পারভেজ ইলাহিকে বেশ ভালো করে জানেন। জারদারি তো তার শাসনকালে বাইডেনকে হেলাল-ই-পাকিস্তান উপাধিও প্রদান করেছিলেন। ৭ নভেম্বর আসিফ জারদারি ও নওয়াজ শরিফের মাঝে ফোনে কথাবার্তা হয়েছে। সেখানে পারভেজ ইলাহির কথাও আসে। পরের দিন তারা সবাই বাইডেনকে অভিনন্দন বার্তাও প্রেরণ করেন।

অপর দিকে ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করার ঘোষণা দেন। তার অভিযোগ, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। হতে পারে তিনি কনটেইনারে দাঁড়িয়ে যাবেন এবং আন্দোলনের ঘোষণা দেবেন। তবে হোয়াইট হাউজ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর তার জন্য মিথ্যা বলা কঠিন। তিনি যা কিছুই মিথ্যা বলবেন, টুইটারসহ সব মার্কিন টিভি চ্যানেল বিশ্বকে জানিয়ে দেবে, ট্রাম্প মিথ্যাবাদী। মিথ্যা বিশ্বকে বিভক্ত ও অনিরাপদ করে দিয়েছে।’ সময় এসেছে, বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলে মিডিয়া ট্রাম্পের মতো মিথ্যাবাদী ও আত্মম্ভরীদের সামনে বুক টান করে দাঁড়িয়ে যাবে এবং তাদের মিথ্যার মুখোশ উন্মোচন করে জনগণকে এমন অশিষ্টাচারীদের থেকে মুক্তি দেবে।

লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট, প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)
পাকিস্তানের দৈনিক জংয়ে ০৯ নভেম্বর প্রকশিত। উর্দু থেকে ভাষান্তর করেছেন ইমতিয়াজ বিন মাহতাব

ahmadimtiajdr@gmail.com

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us