ভারতকে নিয়ে খেলছে চীন!
ভারতকে নিয়ে খেলছে চীন! - ছবি সংগৃহীত
চীন তার ভারত কৌশল নিয়ে যেমনটা চেয়েছিল, এপ্রিল থেকে সবকিছু সেভাবেই ঘটছে। বেইজিংয়ের অনুমান অনুসারেই পরিস্থিতির বিবর্তন ঘটছে।
অন্যভাবে বললে চীন ভারতকে যেভাবে দেখতে চায়, ভারত সেটাই করছে।
অস্বচ্ছ সরকার ব্যবস্থার কারণে বোঝার উপায় নেই যে চীনের দীর্ঘমেয়াদি কৌশল কি আর স্বল্পমেয়াদি পদ্ধতিটাই বা কি। এই পর্যালোচনার জন্য চীনের রাষ্ট্রীয় মিডিয়ার উপর নির্ভর করতে হয়। এর বাইরে চীনা থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক আর চীনা মিডিয়ায় প্রকাশিত মতামতের উপরও নির্ভর করা যেতে পারে।
তবে, ভারতের ব্যাপারে চীনের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলটা যেন অনেকটাই পরিস্কার।
বেইজিং ভারতকে এখন আর প্রতিযোগী মনে করে না, কারণ ভারতের অর্থনীতি আর সামরিক সক্ষমতা চীনের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। তবে বেইজিং ভারতকে ভবিষ্যতের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখে। সে কারণে ভবিষ্যতে ভারত যাতে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে না পারে, সে জন্য বাধা তৈরি করছে চীন।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের বিশ্লেষণ অনুসারে ২০৫০ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে না চীনের, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে ভারতের সাথে। যেমন, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের হিসেবে ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে। তবে, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্ক সম্প্রতি তাদের অনুমান সংশোধন করে বলেছে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হবে ভারত।
২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী দেখে অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন ভারতের কৌশলবিদ আর নীতি নির্ধারকরা। কিন্তু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এই গতি ঠিক রাখার জন্য দরকারি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন।
এ কারণেই ভারতের কৌশলবিদরা দাবি করেছেন যে, তারা একটা ভিন্ন যুগের সাথে মোকাবেলা করছেন, যেখানে বিশ্ব ব্যবস্থার শৃঙ্খলা নতুন করে রচিত হচ্ছে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্করের সম্প্রতি প্রকাশিত বইয়ের এখানে সেখানে এ বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। বইয়ের নাম দ্য ইন্ডিয়ান ওয়ে: স্ট্র্যাটেজিস ফর অ্যান আনসার্টেইন ওয়ার্ল্ড।
ভারতের নীতি নির্ধারকদের একটা প্রবণতা রয়েছে, তারা তাদের প্রকৃত অর্থনৈতিক, সামরিক এবং কূটনীতিক সামর্থের চেয়ে বেশি ভাবতে পছন্দ করেন।
ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিতর্কিত ভূখণ্ড নিয়ে সরকার অন্য কোন দেশকে ছাড় দিতে পারে না। সেটা করলে পরের নির্বাচনে তারা ভোট হারাবে।
ভারতীয় মনস্তত্বের এই দুটো দুর্বলতাই বেইজিং ভালোমতো জানে বলে মনে হয়।
চীন সীমান্ত ইস্যুর সমাধান চাক বা সেটা দীর্ঘায়িত করতে চাক, আসলে তারা তাদের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত উদ্দেশ্য পূরণের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। আর মনে হচ্ছে বেইজিং এমন একটা ভারত চায় যেটা খুব দুর্বলও হবে না বা খুব শক্তিশালীও হবে না।
জয়শঙ্করের মতে, পশ্চিমাদের জন্যেও একই কথা প্রযোজ্য: দুর্বল ভারত পশ্চিমাদের স্বার্থ মেটাবে না, আবার অর্থনৈতিক ও কৌশলগতভাবে শক্তিশালী ভারতকে দিয়েও তাদের স্বার্থ হাসিল হবে না। এক বছর আগে আটলান্টিক কাউন্সিলে দেয়া বক্তৃতায় ‘গোল্ডিলক্স নীতিমালা’ উল্লেখ করেছিলেন জয়শঙ্কর। এই জায়গাটাতেই একটা প্রতিষ্ঠিত পরাশক্তি চেষ্টা করে যাতে পরাশক্তি হতে ইচ্ছুক মাঝামাঝি জায়গায় থাকে – তারা যাতে খুব শক্তিশালী বা খুব দুর্বল হয়ে না পড়ে।
স্বাভাবিকভাবেই চীন চায় এই মুহূর্তে এশিয়ায় এবং ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী তারা নেতা হবে এবং ভারত তাদের অনুসারী হবে।
জয়শঙ্কর সঠিকভাবেই তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বহু যুদ্ধে লড়েছে এবং একটিতেও জিততে পারেনি। অন্যদিকে, একটি যুদ্ধে না জড়িয়েও চীন সব ফ্রন্টে জিতে চলেছে।
একইভাবে ভারতেও কোন ফ্রন্টেই যুদ্ধ না করে সব ফ্রন্টে জিততে চায় চীন।
বেইজিং চায় ভারতের সাথে সীমান্ত বিবাদ মিটে যাক আবার তাদের কৌশলগত সুবিধার জায়গাটাও যাতে নিশ্চিত হয়। সেটা দ্রুত না হলে চীন লাদাখে অচলাবস্থা দীর্ঘায়িত করবে। কিন্তু ভারত যদি এই কৌশলকে দুর্বলতা ভেবে চীনের উপর হামলা করে, বেইজিং তাহলে প্রবলভাবে জবাব দেবে।
তাহলে চীন সীমান্তে ভারতকে চাপ দিয়ে কি অর্জন করতে চায়, যেটা তারা বিগত আট মাস ধরে করে আসছে?
প্রথমত, চীন ভারতকে একটা ব্যয়বহুল কৌশলগত প্রতিযোগিতায় ঠেলে দিতে চায়।
উদাহরণস্বরূপ, চীন তাদের বহরে বিমানবাহী রণতরী যুক্ত করেছে। এর জবাবে ভারতও অন্য দেশ থেকে ব্যয়বহুল বিমানবাহী রণতরী কিনতে উদ্বুদ্ধ হবে, এবং নিজেদের আর্থিক সক্ষমতা বা প্রয়োজনের বিষয়টি তারা ভাববে না।
কিন্তু চীন নিজেদের রণতরী তৈরির সক্ষমতা তৈরি করেছে, অন্যদিকে ভারতকে এটা অন্য দেশ থেকে কিনতে হবে। ভারত যদি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ইউএসএস গেরাল্ড আর ফোর্ড-শ্রেণীর রণতরী কিনতে চায়, তাহলে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে।
ভারতের বর্তমান প্রতিরক্ষা বাজেট ৭৩.৬৫ বিলিয়ন ডলার। সেখানে চীনের সাথে প্রতিযোগিতায় গিয়ে দুটো বিমানবাহী রণতরী কিনতে গেলে তাদের পুরো প্রতিরক্ষা বাজেটের এক তৃতীয়াংশই চলে যাবে। অন্যদিকে, চীনের নিজস্ব জাহাজ নির্মাণ শিল্প নিজস্বভাবে এটা তৈরি করবে এবং সেখানে তাদের কর্মসংস্থানও তৈরি হবে।
চীন একই সাথে বিভিন্ন পাল্লার মিসাইলও পরীক্ষা করবে এবং এর মাধ্যমে ভারতকে ডিফেন্স সিস্টেম কিনতে বাধ্য করবে।
দ্বিতীয়ত, চীন চায় ভারত তাদের সাথে সামরিক সক্ষমতার দিক থেকে প্রতিযোগিতা করুক। চীন তাদের ১৪তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় শপথ নিয়েছে যে, তাদের সামরিক বাহিনীর তারা আধুনিকায়ন করবে। তারা পিপলস লিবারেশান আর্মিকে বিশ্বমানের করতে চায়। চীন পিএলএকে বিশ্বমানে নিয়ে যাওয়ার পর ভারতও তাদের সামরিক বাহিনীকে আধুনিকায়নের চাপে পড়বে।
চীনের সাথে প্রতিযোগিতার জন্য ভারত তাদের সামরিক বাহিনীর আকার বাড়াতে বাধ্য হবে। এতে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় ব্যাপক বেড়ে যাবে।
তৃতীয়ত, ভারতীয় বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী ও পদাতিক বাহিনীর আধুনিকায়নের জন্য নয়াদিল্লী বিপুল আর্থিক সম্পদ সামরিক ও সরঞ্জামের পেছনে অপচয় করবে।
চতুর্থত, উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলোর কারণে ভারতকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, এবং দারিদ্র বিমোচন বাদ দিয়ে সীমান্ত সুরক্ষার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
চীন মনে হচ্ছে এটা বুঝেছে যে, ভারত অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ ও দারিদ্র বিমোচনকে অগ্রাধিকার দিতে পারবে না। তার বদলে জমিতে ট্যাঙ্ক, আকাশে বিমান আর সাগরে বহর কেনার দিকে মনোযোগ দেবে তারা।
চীন চায় ভারত তার অর্থনৈতিক অগ্রাধিকার থেকে সরে যাক। ভারত যাতে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার না দেয়, সেটা ঠেকাতে চায় চীন। একই সাথে তারা চায় ভারত যাতে তাদের নীতি নির্ধারণ এবং পরিকল্পনার ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত না নেয়।
এটা ভারতকে উদ্দের্শহীন করবে এবং ভবিষ্যতের জন্য গন্তব্যবিহীন করে তুলবে।
সূত্র : এশিয়া টাইমস