মিয়ানমারের সাবমেরিন : টার্গেট বাংলাদেশ!
মিয়ানমারের সাবমেরিন - ছবি : সংগৃহীত
বঙ্গোপসাগর হলো ভারত মহাসাগরের উত্তর-পূর্ব অংশ। এর পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিকে ভারত, উত্তর দিকে বাংলাদেশ, পূর্ব দিকে মিয়ানমার, ভারতের আন্দামান ও নিকোবর এবং মিয়ানমারের কোকো আইল্যান্ড।
এর দক্ষিণ সীমা হলো শ্রীলঙ্কা ও সুমাত্রার (ইন্দোনেশিয়া) সর্ব উত্তর-পশ্চিম পয়েন্টের মধ্যকার রেখা। বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়া হলো অববাহিকার দেশ।
অববাহিকার সব দেশের নৌবাহিনী রয়েছে। ভারত ছাড়া এসব দেশের নৌবাহিনীর অস্ত্রভাণ্ডারের উৎস বিভিন্ন দেশ। আর ভারত নিজেই অস্ত্র তৈরী করে, তারা অস্ত্র রফতানিও করে। এসব দেশ তাদের অস্ত্রের একটি বড় অংশ আনে চীন থেকে। অস্ত্র বিক্রি একটি বাণিজ্যিক উদ্যোগ হলেও এর সাথে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও থাকে। চীন ও ভারতের যথাক্রমে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কাছে সাম্প্রতিক সাবমেরিন বিক্রি ছাড়া বঙ্গোপাসাগরভুক্ত কোনো দেশেই অস্ত্র বিক্রি স্পটলাইটে আসেনি। বঙ্গোপসাগরে সাবমেরিন পরিচালনা করা নতুন কিছু নয়। ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার সাবমেরিন পরিচালনার অর্ধ শতকের বেশি দিনের অভিজ্ঞতা রয়ছে। তবে কোনো দেশের সাবমেরিন বহরই ভারতের সাথে তুলনীয় নয়।
যেকোনো মূল্যায়নেই সাবমেরিন হলো কৌশলগত অস্ত্র। এগুলো প্রতিযোগী পক্ষগুলোর ওপর প্রবল মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি নৌবাহিনীর সাবমেরিন গাজীর ভয়ে ভারতীয় বিমানবাহী রণতরী বিক্রান্ত লুকিয়ে ছিল। তবে ৪-৫ ডিসেম্বর সাবমেরিনটি রহস্যজনক কারণে হারিয়ে যায় কিংবা ভারতীয় নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরের বিশাখাপত্তম উপকূলে সেটিকে ডুবিয়ে দেয়। তারপর প্রকাশ্যে আসে বিক্রান্ত। হরমুজ প্রণালীর উভয় প্রান্তে একটি করে সাবমেরিনই যেকোনো সঙ্ঘাতে পরিস্থিতি জটিল করে ফেলতে পারে।
বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে সর্বশেষ দেশ হিসেবে সাবমেরিন ক্লাবে যোগ দিয়েছে মিয়ানমার। ভারত ২০১৯ সালের জুলাই মাসে কিলো-ক্লাস সাবমেরিন আইএনএস সিন্ধুবীর সরবরাহ করার জন্য মিয়ানমারের সাথে চুক্তি করে। ভারত ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মিয়ানমার নৌবাহিনীর কাছে সাবমেরিনটি হস্তান্তর করে, মিয়ানমারের সাবমেরিন ক্রুদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে। মিয়ানমার ইউএমএস মিন ইয়ে থিয়েনখাথু নামে সাবমেরিনটিকে কমিশন করে। মিয়ানমার নৌবাহিনী গত ১২-১৫ অক্টোবর ফ্লিট এক্সারসাইজ বন্দুলা ২০২০ পরিচালনা করে। ১২টি জাহাজ, ওই সাবমেরিন ও এলপিডি ইউএমএস মোত্তামা এতে অংশ নেয়। ভারতের সাবমেরিন বিক্রিকে মিয়ানমারে চীনের সাথে টেক্কা দিতে বড় সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বাংলাদশ ২০১৭ সালে সাবমেরিন ক্লাবে যোগ দেয় চীন থেকে দুট ০৩৫জি (মিং ক্লাস) সাবমেরিন সংগ্রহ করে। বাংলাদেশের সাবমেরিন সংগ্রহে ভারত উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের সাবমেরিন কেনার প্রয়োজন কেন, সে প্রশ্নও সৃষ্টি হয়। ভারতের এক ধরনের উদ্বেগের ভিত্তি ছিল এই যে চীনা সাবমেরিন ভারতের দোরগোড়ায় ওঁৎ পেতে থাকবে। আরেকটি মূল্যায়নে বলা হয়, সাবমেরিনে থাকা সহজাত মনোস্তাত্তিক চাপ। সম্ভবত চাপ কাটাতে বাংলাদেশ উপকূলে ২০টি ভারতীয় সার্ভেল্যান্স রাডার স্টেশন স্থাপনের চুক্তি করে ভারত।
বাংলাদেশ সাবমেরিন সংগ্রহ করার কারণেই কি মিয়ানমার তা করেছে? এর সোজাসাপ্টা জবাব ‘না’।
মিয়ানমার অনেক আগে থেকেই সাবমেরিন পাওয়ার স্বপ্ন দেখছিল। দেশটির কমান্ডার ইন চিফ জানিয়েছেন, ২০০০-এর দশকের প্রথম দিকে তিনটি সাবমেরিনের একটি বহর সংগ্রহ করার পরিকল্পনা ছিল। আর সাবমেরিন বার্থ নির্মাণ ও ও ওয়ার্কশপ অবকাঠামো নির্মাণকাজ এটি সংগ্রহ করার আগেই সম্পন্ন হয়। কয়েক ব্যাচে ভারত, পাকিস্তান ও রাশিয়া প্রশিক্ষণ দেয় মিয়ানমারের সাবমেরিন ক্রুদের। রাশিয়া, চীন ও ভারতের কাছ থেকে সাবমেরিন ক্রয়ের বিষয়টি বিবেচনা করে মিয়ানমার। অবশেষে ভারতই চুক্তিটি নিশ্চিত করতে পারে। ভারত সাবমেরিনটি নতুন করে সাজিয়ে গুছিয়ে দেয়, এর আয়ষ্কাল ২০৩০ সাল পর্যন্ত নিশ্চিত করে। আর ওই সালের মধ্যেই মিয়ানমার তার বহরের তিনটি সাবমেরিন সংগ্রহ করা সম্পন্ন করতে পারবে। খুব সম্ভবত সেগুলো সেকেন্ড-হ্যান্ড হবে না।
বাংলাদেশের সাবমেরিন সংগ্রহ করার বিরোধিতা করেছে ভারত। কিন্তু তাহলে তারা মিয়ানমারের কাছে সাবমেরিন বিক্রি করল কেন? বাংলাদেশের সাবমেরিন প্রতিরোধ করতে ভারত এ কাজ করেছ? এর পরিষ্কার কোনো জবাব পাওয়া যায় না। সম্ভবত জবাব হবে ‘না’। তবে এটা নিশ্চিত যে ‘চীন ভীতি ফ্যাক্টর’ ও মিয়ানমারে চীনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ভারতের সাবমেরিন বিক্রির পেছনে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে।
কয়েক বিলিয়ন ডলারের বেসামরিক ও সামরিক অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে গভীরভাবে জড়িত রয়েছে চীন। মিয়ানমারে চনের বৃহত্তম সামরিক বিনিয়াগ প্রকল্পটির মূল্য ১.২ বিলিয়ন ডলারের : থিলাওয়ায় নেভাল শিপিয়ার্ড নির্মাণ। মিয়ানমারের বৃহত্তম সরবরাহকারী হলো চীন। মিয়ানমারে চীনা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রভাব নিয়ে অনেক দিন ধরেই অস্বস্তিতে রয়েছে ভারত। মিয়ানমারে ভারত বেসামরিক অবকাঠামো প্রকল্প, সামরিক বিক্রি ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সমর্থন দিতে আগ্রহী। অন্যদিকে চীন ও ভারতের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার মাধ্যমে চীনা প্রভাব নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় মিয়ানমার। মিয়ানমারকে ওই সুযোগ দিতে খুবই আগ্রহী মিয়ানমার। পূর্ব সীমান্তে বিদ্রোহ দমনেও মিয়ানমারকে প্রয়োজন ভারতের। মিয়ানমারের কাছ থেকে সমর্থন পেয়ে ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে বিদ্রোহ দমনে সফলতা পেয়েছে ভারত।
১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিক থেকে মিয়ানমার থেকে চীনের কথিত বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চগুলো নজরদারি করা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে ভারত এবং মিয়ানমার উপকূলকে চীনের দ্বিতীয় উপকূল হিসেবে অভিহিত করছে। সাবমেরিন বিক্রি এবং ২০১৯ সালে শেনা টর্পেডো সরবরাহ করার মাধ্যমে ভারত এখন মিয়ানমার উপকূলের একটি অঙশ নিরাপদ রাখার আশা করতে পারে। অবশ্য, ভারতের সামনে এখনো চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। চীন যদি ভবিষ্যতে মিয়ানমারের কেনা সাবমেরিনটি জব্দ করে কিংবা মিয়ানমার যদি রাশিয়ার কাছ থেকে নতুন সাবমেরিন কেনে (পুরনো সাবমেরিন কেনার সম্ভাবনা খুবই কম), তবে কী ঘটবে?
ইন্দো-চীন প্রতিযোগিতা কি মিয়ানমারকে কৌশলগত সুবিধা দিচ্ছে নাকি মিয়ানমারের কৌশলগত অবস্থঅন দেশটিতে ভারত ও চীনের প্রতিযোগিতা টেনে এনেছে? বস্তুত, এটি দুইভাবে কাজ করে। চীন ও ভারত উভয়ের কাছে মিয়ানমার গুরুত্বপূর্ণ এবং বিপরীতটিও সত্য। চীনকে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের কৌশলগত করিডোর দিয়ে মালাক্কা প্রণালীর ওপর থেকে নির্ভরতা কমানোর সুযোগ করে দিতে পারে মিয়ানমার। ১৯৮৮ থেকে ২০১০ পর্যন্ত নিঃসঙ্গতার সময়সহ কয়েক দশক ধরে চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র মিয়ানমার। চীন দেশটির সামরিক জান্তা এবং বেসামরিক জনসাধারণের ওপর এর নৃশংস অপরাধের রক্ষক। অন্যদিকে ভারত আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক সমালোচনা থেকে আড়াল করে রাখছে মিয়ানমারকে।
অনেক কারণেই চীনের ওপর নির্ভরশীল মিয়ানমার। বিশেষ করে অব্যাহতভাবে মানবিধকার লঙ্ঘন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অভিযোগে আন্তর্জাতিক সমালোচনা ও অবরোধ থেকে রক্ষা করছে চীন। ভারত গণতন্ত্রের অনুশীলনকারী হলেও গণহত্যামূলক অপরাধে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দেশটির সাথে তার সম্পর্ককে ঝুঁকির মুখে ফেলতে চায় না। চীন ও ভারত উভয়েই মিয়ানমারের অর্থনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতা-সৃষ্টিকারী সহযোগিতার সুবিধা গ্রহণের জন্য প্রতিযোগিতা করছ। ২০৩০ সাল নাগাদ তিনটি সাবমেরিনের বহর নির্মাণের মিয়ানমারের পরিকল্পনাটি মিয়ানমার উপকূলকে চীন ও ভারতের জন্য আরো বেশি প্রতিযোগিতামূলক করে ফেলবে, যার প্রভাব বঙ্গোপসাগরেও ছড়িয়ে পড়বে।
লেখক : কমোডর (অবসরপ্রাপ্ত); বাংলাদেশ নৌবাহিনী।
সূত্র : এসএএম