সু চি কি রোহিঙ্গাদের জন্য কিছু করবেন?
সু চি - ছবি : সংগৃহীত
আং সাং সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) সদ্য সমাপ্ত মিয়ানমারের জাতীয় নির্বাচনে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করেছে। সরকারি ফলাফল এখনো ঘোষণা করা না হলেও স্বাধীন ভোট গণনা গ্রুপ ইয়া মালের মতে, এনএলডি পার্লামেন্টে ৩৯৬টি আসনে জিতেছে। উল্লেখ্য, সরকার গঠন করার জন্য দরকার হয় ৩২২ আসনের।
রাজ্য ও জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে ১,১১৯ আসনে ৯১টি দলের ৫,৬৪৩ জন প্রার্থী ছিলেন। নতুন করে ক্ষমতায় এসে সু চি কিছু সংস্কারমূলক কাজ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। কিন্তু তা দেশটির ওপর সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ দুর্বল করবে না, এবং আরো বড় কথা হলো, তাতে রোহিঙ্গাদের দুর্দশার লাঘব হবে না।
ঐতিহাসিকভাবে মিয়ানমার ১৯৬২ সাল থেকে সামরিক শাসনে রয়েছে।তারপর ২০১৫ সালে দেশটিতে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়। অবশ্য এরপরও ২০০৮ সালে প্রণীত সামরিক বাহিনীর সংবিধানের কারণে সেনাবাহিনী শক্তিশালী অবস্থানেই থেকে যায। এই সংবিধানের আওতায় আইন পরিষদের ২৫ ভাগ আসন সামরিক বাহিনীর জন্য নির্ধারিত। তাছাড়া প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও সীমান্ত রক্ষা মন্ত্রণালয়ও তাদের হাতে থাকছে। সামরিক বাহিনীর হাতে সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে জরুরি অবস্থা জারি করে জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা পরিষদ গঠনের ক্ষমতাও আছে।
রোহিঙ্গা সঙ্কট
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে গভীরভাবে প্রোথিত রয়েছে। দেশটিতে জাতিগত শান্তি ও ঐক্যের কথা বলা হলেও ২০১৫ সালের নির্বাচনের সময় সু চি একজন মুসলিম প্রার্থীও বাছাই করেননি তার দলের জন্য। নির্বাচনে জয়ের পর ২০১৬ সালে সামরিক অভিযানের ফলে উদ্বাস্তু হওয়া শত শত রোহিঙ্গা সম্পর্কে নীরবতা অবলম্বন করেন। এই দমন অভিযান চালানো হয় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর ‘বিদ্রোহী সন্ত্রাসীদের’ হাতে ৯ মিয়ানমারিজ সীমান্ত রক্ষী নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে।
সর্বশেষ রোহিঙ্গা সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে সামরিক বাহিনী ও রোহিঙ্গা উগ্রবাদী গ্রুপের মধ্যকার সঙ্ঘাতের ফলে। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) হামলার ফলে মিয়ানমারের ১২ সৈন্য ও কর্মকর্তা নিহত হয়। আর বিদ্রোহীদের নিহত হয় ৮০ জন।
এর পরপরই প্রায় তিন হাজার রোহিঙ্গা বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়, সৈন্যরা নারী ও মেয়েদের গণধর্ষণ করে, নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পেতে নাগরিকেরা পালিয়ে যেতে থাকে। ২০১৭ সালের আগস্টে পরপরই অন্তত ছয় লাখ ৫৬ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে যায়।
রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত জাতিগত শুদ্ধি অভিযান ও গণহত্যা বসনিয়া, দারফুর ও রুয়ান্ডার মতো হলেও সু চি কিন্তু সামরিক বাহিনীর পক্ষই অবলম্বন করছেন।
বর্তমানে প্রায় ১.৯ মিলিয়ন রোহিঙ্গা নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত রয়েছে। সাত লাখ ২৩ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা আরাকানে (রাখাইন) তাদের বাড়িঘর ছেড়ে বাংলাদেশে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের আগমনের ফলে বাংলাদেশের কক্সবাজার পরিণত হয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম উদ্বাস্তু শিবিরে।
নির্বাচনী এজেন্ডা
এনএলডি ২০২০ সালের নির্বাচনের জন্য ৩৪ পৃষ্ঠার ইস্তেহার প্রকাশ করে। এতে প্রধান নির্বাচনী এজেন্ডা ছিল তিনটি : জাতিগত উদ্বেগ দূল করে অভ্যন্তরীণ শান্তি নিশ্চিত করা; সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ফেডারেল ইউনিয়ন নিশ্চিত করার জন্য সংবিধান সংস্কার; এবং টেকসই উন্নয়ন। এনএলডি সাংবিধানিক সংশোধনী এনে পার্লামেন্টে সামরিক বাহিনীর আসন ২০২০ সালে ১৫ ভাগ, ২০২৫ সালে ১০ ভাগ ও ২০৩০ সাল নাগাদ ৫ ভাগে নামিয়ে আনতে চাচ্ছে। চলতি বছরের প্রথম দিকে সু চি এই সংশোধনী পাস করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি।
২০১৫ সালের ভোটার তালিকায় প্রায় ২০০ লোকের নাম ছিল। কিন্তু ২০২০ সালে একজনও ছিল না। এর কারণ হলো নিরাপত্তাগত কারণে সামরিক বাহিনী এবার রাখাইন রাজ্যসহ ৫টি টাউনশিপে নির্বাচনের বিপক্ষে অভিমত প্রকাশ করেছিল। রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার না থাকা সত্ত্বেও যে ছয় রোহিঙ্গাকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছিল, তাদের অন্যতম আয়ে উইন বলেন, নির্বাচনের আগে আরো রোহিঙ্গাকে নাগরিকত্ব না দেয়া হলে বিজয়ের আশা নেই।
গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো, ২০১০ সালের আগে পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের সাময়িক কাডর্ ছিল। এটি ব্যবহার করে তারা ভোট দিতে পারত। ২০১০ সালে রোহিঙ্গা দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল, তবে কেউ জয়ী হতে পারেনি। ২০১৫ সালে তাদের ভোটাধিকার হরণ করা হয়।
মিয়ানমারের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব যতক্ষণ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের প্রতি দৃঢ়ভাবে না দাঁড়াবে, ততক্ষণ তাদের দুর্দশা অব্যাহত থাকবে। যারা এখনো মিয়ানমারে রয়ে গেছে, তারা আরো বেশি সহিংসতার মুখে পড়বে, যারা দেশ থেকে পালিয়ে গেছে, তারা উদ্বাস্তু হিসেবেই থেকে যাবে।
সূত্র : দি ওয়্যার