কিসিঞ্জারের শঙ্কা : চীন-আমেরিকা বিশ্বযুদ্ধ!
কিসিঞ্জারের শঙ্কা : চীন-আমেরিকা বিশ্বযুদ্ধ! - ছবি সংগৃহীত
হোয়াইট হাউসে আগামী সপ্তাহগুলোতে ক্ষমতার হাত বদল করার প্রস্তুতি প্রক্রিয়াতেই হেনরি কিসিঞ্জার আমেরিকা ও চীনের মধ্যে নতুন কৌশলগত বোঝাপড়ার অনুপস্থিতিতে “প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সাথে তুলনাযোগ্য এক বিপর্যয়” সম্পর্কে সতর্ক করেছেন।
১৯৭০ এর দশকে মাও সেতুংয়ের চীনের সাথে রিচার্ড নিক্সন প্রশাসনের ঐতিহাসিক সম্পর্ক তৈরির কারিগর এই প্রাজ্ঞ আমেরিকান কূটনীতিক অপেক্ষমান জোসেফ বাইডেন প্রশাসনের প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের তুলনায় “আরো বৈচিত্রপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি” গ্রহণের আহ্বান জানান।
ট্রাম্পের চীন নীতির অনুচ্চ কণ্ঠে সমালোচনা করে ৯৭ বছরের প্রবীণ এই পররাষ্ট্র কৌশলবিদ জোর দিয়ে বলেছেন যে বর্তমানের মতো “আলোচনার লড়াকু ধরনের পদ্ধতির” প্রয়োগ “অনির্দিষ্টকালের জন্য” করা যাবে না। তবে “বিশ্ব অর্থনীতির ভারসাম্যহীন বিবর্তন সম্পর্কে আমেরিকানদের গভীর উদ্বেগ’’-এর উপর জোর দেয়া বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ”
বিগত চার বছরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দীর্ঘ দিনের বাণিজ্য যুদ্ধ, চীনা নাগরিক ও সংস্থাগুলোর উপর অভিবাসন ও বিনিয়োগ নিষেধাজ্ঞা, চীনের পেরিফেরিতে মার্কিন বর্ধিত নৌ-উপস্থিতি এবং উস্কানিমূলকভাবে কোভিড -১১ মহামারীকে ‘চীনা ভাইরাস’ বলে উল্লেখ করে বেইজিংয়ের সাথে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলেছেন।
নির্বাচনের পরাজয় মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানানো ডোনাল্ড ট্রাম্প মেয়াদের বাকি সপ্তাহগুলোতে চীনের সাথে উত্তেজনা বাড়াতে পারেন এটি বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, পেন্টাগনের শীর্ষ পদে ট্রাম্পের অনুগত ও কট্টরপন্থীদের শেষ সময়ের নিয়োগের পাশাপাশি চীনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞাগুলো ট্রাম্পের আরও কঠোর পথ নেবারই লক্ষণ।
বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন যে ট্রাম্প প্রশাসনের শেষ মুহূর্তের কাজগুলো তার উত্তরসূরী বাইডেনের কর্মপ্রক্রিয়াকে এমনভাবে পূর্ববিন্যাস করতে পারে যাতে চীনের সাথে কার্যকরী সম্পর্ক পুনরুদ্ধার
করার জন্য পরবর্তীকালে আইনীভাবে খুব বেশি কিছু করার না থাকে। অধিকন্তু, ট্রাম্পের নেয়া পদক্ষেপগুলো বছরের পর বছর ধরে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে বিষাক্ত করতে পারে যা নাটকীয়ভাবে দুই মহাশক্তির মধ্যে বড় ধরনের এক সংঘাতের সম্ভাবনাকেও বাড়িয়ে তুলেছে।
ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন উল্যোট গণমাধ্যমকে বলেছেন, “যদি বেইজিং পথ পরিবর্তন না করে এবং বিশ্ব মঞ্চে একজন দায়িত্বশীল খেলোয়াড় না হয় তবে ভবিষ্যতের মার্কিন রাষ্ট্রপতিরা দেখবেন ট্রাম্প যে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়ে গেছেন তা ঘুরিয়ে দেয়া রাজনৈতিকভাবে আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়াবে।”
এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ চীনা লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) সংযোগ রয়েছে বলে মনে করা চীনা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা বাড়ানোর জন্য প্রস্তুত রয়েছে। প্রতিরক্ষা বিভাগ এখন সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ভারপ্রাপ্ত প্রতিরক্ষা সচিব ক্রিস্টোফার মিলারের মতো চীন বিরোধি ব্যক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।
ট্রাম্প প্রশাসন মানবাধিকার সম্পর্কিত ইস্যুতে জোরপূর্বক শ্রম ব্যবহারের পাশাপাশি হংকং এবং জিনজিয়াংয়ের জাতিগত উইঘুরদের শিবিরে বন্দী করার মানবাধিকার দমনের মতো বিষয়ের সাথে জড়িত চীনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞার সুযোগ খতিয়ে দেখছে।
চীনও লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। গত মাসে দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ গুয়াংডংয়ের পিএলএর একটি সামরিক ঘাঁটিতে এক উচ্চ পর্যায়ের পরিদর্শনকালে, চীনা রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং দেশটির সেনাবাহিনীকে “যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য সকলের (তাদের) মানসিক প্রস্তুতি এবং শক্তি অর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন।”
এর আগে চীনকে “উত্তাল পরিবর্তনের সময়” এবং অস্তিত্বহীন ঝুঁকির বিষয়ে সতর্ক করার পরে শি পিএলএর সৈন্যদের “উচ্চ সতর্কতা বজায় রাখতে” বলেছিলেন এবং তাদের “নিরঙ্কুশভাবে অনুগত, খাঁটি এবং নির্ভরযোগ্য” হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বলে রাষ্ট্রীয় মিডিয়া রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
ঐতিহাসিকভাবে বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে “কৌশলগত সহানুভূতির” পক্ষপাতি একজন ব্যক্তি হিসাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি জোসেফ বাইডেনও গত এক বছরে চীনের প্রতি ক্রমবর্ধমান কঠোর অবস্থান নিয়েছেন।
নব নির্বাচিত আমেরিকান নেতা শি’কে “ঠগ” বলে সমালোচনা করেছেন, ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট শাসনকে “একনায়কতন্ত্র” বলে উল্লেখ করেছেন এবং চীনা অঞ্চলগুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে “দ্রুত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার” কথা বলে সতর্ক করেছেন।
বাইডেন গত বসন্তে ফরেন অ্যাফেয়ার্স সাময়িকীতে এক লেখায় বলেছিলেন, “আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের চীন সম্পর্কে কঠোর হওয়া দরকার।” সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে, বাইডেন ও তার শীর্ষ পরামর্শদাতারা সামুদ্রিক
ও আঞ্চলিক বিরোধ নিয়ে বেইজিংয়ের সাথে সংঘাতে জড়িত তাইওয়ানকে সমর্থন করার পাশাপাশি জাপান এবং ফিলিপাইনের মতো আঞ্চলিক মিত্রদের প্রতি আমেরিকান প্রতিশ্রুতিও পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
এই দুই পরাশক্তির মধ্যে ক্রমবর্ধমান ও বিপজ্জনক গতিশীলতার বিষয়টি লক্ষ্য করে হেনরি কিসিঞ্জার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, “আমেরিকা ও চীন এখন দ্বন্দ্বের দিকে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে আর তারা তাদের কূটনীতিকে যুদ্ধংদেহি রূপ দিচ্ছে।”
হেনরি কিসঞ্জার বলেন, “বিপদটি হলো যে কিছু সঙ্কট এমনভাবে দেখা দেবে যা রেটরিক বা বক্তব্যকে ছাড়িয়ে প্রকৃত সামরিক সঙ্ঘাতের দিকে নিয়ে যাবে”। তিনি একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন যার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির বিশ্বস্ত পরামর্শদাতারা উত্তেজনার বিষ্ফোরণ ঘটার আগে যোগাযোগের মাধ্যমে তা প্রশমনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।
কেমব্রিজের ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার মুনরো ক্লার্ক প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত সম্পর্কে তাঁর ক্লাসিক বিবরণ ‘দ্য স্লিপওয়াকার্স ’-এ উল্লেখ করেছিলেন, “উভয় পক্ষই ধারণা করেছিলেন যে সাফল্য অর্জনে ‘ধোঁয়াশা সৃষ্টি
বা প্রতারিত করাই’ যথেষ্ট হবে। কিন্তু কোনো খেলোয়াড়ই ভাবেননি যে লক্ষ্য অর্জনে পুরো পথ পাড়ি দিতে হবে। মর্মন্তুদ জীবনঘাতী খেলাটি শেষ পর্যন্ত শুরু হয়ে গিয়েছিল। যদিও বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে কারোই যুদ্ধ প্রত্যাশিত বা কাঙ্ক্ষিত ছিল না। ১৯১৪-এর নায়করা ছিলেন ঘুমের অভিযাত্রী, তাদের নজরদারি ছিল- কিন্তু অদৃশ্যে, স্বপ্নঘুম দ্বারা তাড়িত ছিলেন তারা, পৃথিবীতে যে ভয়াবহতা তারা আনতে চলছিলেন তার বাস্তবতা সম্পর্কে তারা ছিলেন অন্ধ।”
বার্বারা তুচমান ১৯১৪ সালের আগস্টের ‘দ্য গানস অফ আগস্ট’-এ উল্লেখ করেছেন, ‘যে বছরটি দীর্ঘ এক বিশ্বব্যাপী সঙ্ঘাতের সূচনা দেখেছিল, সেই সময়ের সাম্রাজ্যগুলো বিপর্যয়কর যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ব্যাপারে ছিল ঘুমের ঘুরে, যেহেতু সঙ্কটের মাঝখানে কিছুই ঠিক ততটা স্পষ্ট বা নিশ্চিত ছিল না, ফলে এক ধরনের অন্ধকারের মধ্যে সব কিছু ঘটে গেছে।”
ক্লার্কের পর্যবেক্ষণ হলো, স্নায়ু যুদ্ধের সমাপ্তির সময়টির অবস্থা ১৯১৪ সালের ইউরোপের সাথে তুলনা করার মতো। কারণ বড় শক্তিগুলোর অবস্থা এখন আরো জটিল ও অপ্রত্যাশিত, যার মধ্যে চীনের উত্থান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আপেক্ষিক পতনও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
বাইডেন প্রশাসন, ম্যানেজ করার মতো পর্যায়ে উত্তেজনা ‘প্রশমিত’ করার জন্য কিসিঞ্জারের পরামর্শ গ্রহণ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। ট্রাম্প-উদ্যোগ এবং চলমান বাণিজ্য ও প্রযুক্তি যুদ্ধের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন, কোভিড -১৯ ভ্যাকসিন ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের বিষয়ে চীনের সাথে সহযোগিতাসহ আরো বিভিন্ন বিষয়ে অধিকতর “বৈচিত্রময়” দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে তার পছন্দের ব্যাপারে ধারাবাহিকভাবে ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছেন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বাইডেন।
এমনকি দক্ষিণ চীন সাগর বিরোধ ও তাইওয়ানের মতো বিতর্কিত বিষয়েও, বাইডেন চীনের সাথে অপ্রয়োজনীয় ও বিপজ্জনক সংঘর্ষ এড়াতে “নরমভাবে কথা বলবেন আর একটি বড় লাঠি বহন করবেন” বলে আশা করা হচ্ছে। তবে কিসিঞ্জারের পর্যবেক্ষণ হলো, “আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও চীন কখনো এ জাতীয় মাত্রায় পরস্পরের সাথে মুখোমুখি হয়নি যেখানে পরস্পর সমানতালেই একে অন্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছে”। তিনি বলেন, “এটিই প্রথম অভিজ্ঞতা। আর আমাদের অবশ্যই এ অবস্থার বড় বিরোধে পরিণত হওয়াটাকে এড়াতে হবে এবং আশা করছি এ ব্যাপারে কিছু সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা চালানো হবে”।
এশিয়া উইকে প্রকাশিত রিচার্ড জাভাদ হায়দারিয়ান লেখা অবলম্বনে মাসুম খলিলী