আরসিইপি : চীনের অবিশ্বাস্য চমক
শি - ছবি সংগৃহীত
আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ ও চীন প্রতিরোধী সামরিক জোট গঠনের মহা-উদ্যোগের মধ্যেই শিন জিং পিংয়ের চীন আসিয়ান দেশগুলো এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সাথে এক মহা-অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যবলয় তৈরির চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এ ধরনের একটি বাণিজ্য জোট তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের শেষ ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। আর ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর অন্য কয়েকটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগ থেকে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়েছেন সেভাবেই এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বাণিজ্য উদ্যোগ টিপিপি থেকে ওয়াশিংটনকে সরিয়ে নেন। বেইজিং তখন থেকেই বিকল্প এই বাণিজ্যবলয় কার্যকর করার উদ্যোগকে চাঙ্গা করতে শুরু করে। শুরুতে ভারত এই জোটের উদ্যোগ আয়োজনের সাথে থাকলেও হ্যানয়ে স্বাক্ষরিত ভিডিও সম্মেলনে দিল্লি থাকেনি। একই সাথে অংশীদার হয়নি বাংলাদেশ বা অন্য কোনো সার্ক দেশও।
বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্য জোট
চীন এবং অন্য ১৪টি দেশ গত রোববার বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্য ব্লক স্থাপনে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মত হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় ১০ দেশের সংস্থা আসিয়ান ছাড়াও এর মধ্যে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কর্মকর্তারা বলেছেন যে ভারতের জন্য এই চুক্তিটির দরজা উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। বলা হচ্ছে, আরসিইপি এমন একটি ব্যবস্থা যা পুরো অঞ্চলের ২২০ কোটি মানুষের উপকারে লাগবে।
আঞ্চলিক সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব-আরসিইপির মূল উদ্যোগ নিয়েছিল আসিয়ান ২০০২ সালে। চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডকে তাতে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বড় মিত্র ভারত আলোচনার শেষ মুহূর্তে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এই চুক্তি সম্পর্কে চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং মন্তব্য করেন যে, আরসিইপি হলো বহুপাক্ষিকতা ও অবাধ বাণিজ্যের জয়। বৈঠকে অংশ নেয়া অন্যান্য দেশের নেতারাও এই জাতীয় মন্তব্য করেন। তবে কিছু পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম চীনকে আরসিইপির সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হিসেবে বর্ণনা করে উল্লেখ করে যে, এশিয়ায় চীনের প্রভাব প্রসারিত করা এর উদ্দেশ্য।
চীনা সরকারি মুখপত্র গ্লোবাল টাইমসে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘পুরো অঞ্চলটির জন্য আরসিইপির সমৃদ্ধি ও গঠনমূলকতা উপেক্ষা করে একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বের সাথে চীনের মিথস্ক্রিয়াকে তারা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে। এই লোকগুলোর মূল্য ব্যবস্থা এবং বিচার করার ক্ষমতা নিয়ে সমস্যা রয়েছে। চীনের বিরুদ্ধে তাদের কুসংস্কারগুলো এত গভীর যে চীন যখনই কোনো বিষয়ে জড়িত হয় তখন তাদের মন বিভ্রান্ত হয়। চীন যদি এবার কথিত বিজয় লাভ করে, তবে এটি আরসিইপির অন্য সদস্যদের জন্যও হবে বিজয়ের পরিস্থিতি। কারণ এই দেশগুলো গত আট বছরের আলোচনার সময় তাদের নিজস্ব সুবিধার জন্য প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে। সব দেশই কেবল এই চুক্তিতে বিজয়ী হতে পারে। এটিই চীনের উন্নয়নের মৌলিক উপায়। চীন শুরু থেকেই একটি জয়ের এবং সবার জন্য উন্নয়নের পদ্ধতি খুঁজছিল এবং স্নো বল ঘূর্ণায়মানের মতো বিশ্বজুড়ে প্রচুর সাধারণ স্বার্থ জড়ো করেছে বেইজিং। চীন সর্বদা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার চীন-সতর্ক মিত্রদের কার্যকর ও পারস্পরিক উপকারী উপায়ে সহযোগিতা করতে সক্ষম হয়েছে।’
এখন যেহেতু ট্রাম্পের বিরোধী জো বাইডেনকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে, তাই এই অঞ্চলটি বাণিজ্য এবং অন্যান্য ইস্যুতে মার্কিন নীতি কিভাবে বিকশিত হবে তা দেখার জন্য অনেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। এক সময় আসিয়ানের চীনকে যুক্ত করে নেয়া মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ওবামা প্রশাসন ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেটিকে বাইডেন প্রশাসন আবার ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা নিতে পারেন বলেও উল্লেখ করা হচ্ছে। টিপিপি চুক্তি ছিল অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনাই, কানাডা, চিলি, জাপান, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, পেরু, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম এবং সংযুক্তদের মধ্যে প্রস্তাবিত বাণিজ্য চুক্তি। ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানুয়ারি ২০১৭ সালে টিপিপি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। পরে চুক্তিটি প্রয়োজনীয় অনুমোদনের অভাবে আর কার্যকর হয়নি। অন্য দেশগুলো ট্রান্স-প্যাসিফিক অংশীদারিত্বের জন্য একটি নতুন বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা করে যা টিপিপির বেশির ভাগ বিধানকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ এ কার্যকর হয়।
বেইজিংয়ের ঠাণ্ডা মাথার বাজিমাৎ
এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের এই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিটি এমন এক সময় স্বাক্ষরিত হলো যখন আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আলোচিত চার বছর শাসনের সমাপ্তি ঘটতে চলেছে। নির্বাচনের ফল না মানার ব্যাপারে ট্রাম্পের বিদ্রোহাত্মক জোরালো আওয়াজ এখন ক্ষীণকায় হয়ে আসতে শুরু করেছে। তার মানে হলো জো বাইডেনের ডেমোক্র্যাট শাসন শুরু হতে চলেছে আগামী জানুয়ারি মাস থেকে। ট্রাম্প যদি ক্ষমতায় থেকে যেতেন তাহলে চীনের বিরুদ্ধে যে বাণিজ্য যুদ্ধ তিনি শুরু করেছিলেন সেটিকে আরো জোরালোভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতেন বলে একটি ধারণা ছিল। এই বাণিজ্যযুদ্ধ তথা চীনা পণ্যের ওপর অধিক শুল্ক আরোপ করে নিজস্ব বাজার সংরক্ষণ, বিনিয়োগ প্রত্যাহার, চীনা প্রতিষ্ঠানের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ, চীনা গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ভেঙে দেয়ার নামে চীনা নাগরিকদের ওপর ক্র্যাকডাউনে এক হিসাবে চীনের ৬০০ বিলিয়ন ডলারের মতো ক্ষতি হয়েছে।
একই সাথে বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছে চীনে বিনিয়োগকারী শীর্ষস্থানীয় আমেরিকান কোম্পানিগুলোও। তাদের ক্ষতির আনুমানিক অঙ্ক কত জানা যায়নি, তবে সেটি শেয়ারবাজারে দরপতন, পণ্যের বাজার হারানো, বেইজিংয়ের পাল্টা পদক্ষেপ এবং বিনিয়োগের ধারাবাহিকতা হারানোর সম্মিলিত প্রভাবে শত শত বিলিয়ন ডলার হবে বলে অনুমান করা যায়। একই সাথে চীনের সস্তা পণ্য আমেরিকার বাজারে প্রবেশ করতে না পারায় দেশটির নাগরিকদের করোনা মন্দার মধ্যেও অধিক টাকা খরচ করতে হয়েছে।
এসবের প্রভাব আমেরিকান সমাজ ও অর্থনীতিতে দৃশ্যমান যে কতখানি হয়েছে তা বুঝা যায় দেশটির নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভোট বিপর্যয়ে। ঐতিহ্যগতভাবে যারা রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর নির্বাচনী তহবিলে বিপুল অঙ্ক চাঁদা দিতেন তারা বাইডেন শিবিরকে এবার চাঁদায় চাঁদায় ভরিয়ে দিয়েছেন। করোনা সুনামির এ মন্দা দিনেও বাইডেনের নির্বাচনী তহবিলে রেকর্ড পরিমাণে অর্থের প্রাচুর্য ঘটেছে। ফলে ডেমোক্র্যাটরা এবার যতটা সুপরিকল্পিতভাবে নির্বাচনী আয়োজন সমাপ্ত করতে পেরেছেন সেভাবে দল ক্ষমতা থেকে করা নির্বাচনের সময়ও হয়ে ওঠেনি। আর চীনের সস্তা পণ্যের প্রতিরোধ আমেরিকান নি¤œবিত্তদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে সেটি মিশিগান প্যানসেলভানিয়া জর্জিয়ার মতো সুইং স্ট্রেটে বাইডেনের জয়েই পরিষ্কার হয়েছে।
ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাব যে কেবল আমেরিকান কোম্পানি ও ভোক্তাদের ওপর পড়েছে তাই নয় একই সাথে এশিয়ায় মার্কিন মিত্র দেশগুলোতেও পড়েছে। এক দিকে আমেরিকান মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির অকাল মৃত্যুতে মার্কিন বাজারসুবিধা থেকে এসব দেশ বঞ্চিত হয়েছে অন্য দিকে চীনা বিনিয়োগ বাজারে ঢোকা বা থাকার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপের প্রভাব চীননির্ভর আসিয়ান এবং জাপান অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডের মতো এশীয় দেশগুলোতেও পড়েছে। আর ওয়াশিংটনের ট্রাম্প প্রশাসনের সর্বাত্মক বৈরিতার মুখে ছাড় দিয়ে চীন এই বাণিজ্যবলয় তৈরির উদ্যোগটিকে সমর্থন দিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়েছে।
এই প্রসঙ্গে গ্লোবাল টাইমসের বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। পত্রিকাটি বলেছে, ‘আগ্রহের বিশ্বব্যাপী ক্ষেত্রগুলোর মানচিত্র আর প্রভাবের ভিত্তিতে আঁকা হয় না। সার্বভৌমত্ব এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সমৃদ্ধি এবং প্রসারণ দেশগুলোর পক্ষে বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলে স্বার্থের নতুন উৎস অনুসন্ধান করা সম্ভব করে তোলে। নিরাপত্তার হুমকির সাধারণ হ্রাসের সাথে সাথে অর্থনৈতিক স্বার্থগুলো আরো বিশিষ্ট হয়ে ওঠে এবং সব দেশ তাদের জাতীয় স্বার্থে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিকাশকে অগ্রাধিকার দেয়। কমপক্ষে, সুরক্ষার স্বার্থে অর্থনীতিকে ত্যাগ করা একটি বাস্তববাদী নীতি হিসাবে ন্যায়সঙ্গত হওয়া ক্রমবর্ধমানভাবেই কঠিন। কিছু মার্কিন এবং পাশ্চাত্য অভিজাত চীনকে একটি ‘সম্প্রসারণবাদী সাম্রাজ্য’ হিসেবে মনে করে এবং এর অংশ হিসেবে যেকোনো দেশ বা অঞ্চলের সাথে চীনের প্রসারিত সহযোগিতাকে দেখে থাকে। প্রকৃতপক্ষে, তারা চীন, সময় এবং সেই সাথে বিশ্বকে বুঝতে ভুল করে ফেলেছে।
চীনের গোপন শক্তি
প্রসঙ্গত একটি বিষয় অনেক সময় আমাদের বিবেচনার বাইরে থেকে যায় সেটি হলো বিশ্বের শক্তি নির্বিশেষে সব দেশের দৃশ্যমান অর্থনীতির পাশাপাশি একটি অদৃশ্যমান অর্থনীতি থাকে। মুক্তবাজার ও উদারনৈতিক দেশগুলোতে অদৃশ্যমান অর্থনীতির অবয়ব ততটা বড় হয় না যতটা নিয়ন্ত্রিত বা আধা নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির দেশগুলোর হয়। চীন হলো শেষোক্ত শ্রেণীর এমন একটি দেশ যার তিন থেকে চার ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগযোগ্য নগদ অর্থ রয়েছে। চীনের দৃশ্যমান অর্থনীতির যে আকার আমরা আনুষ্ঠানিক সূত্র থেকে পাই তার তুলনায় দৃশ্যমান অদৃশ্যমান দুই অর্থনীতির আকার সংযুক্ত করা হলে এখনই বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হবে চীন। এ ছাড়া বিশ্ব এখন যেভাবে হাইব্রিড প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছে তাতে রেয়ার আর্থ বা বিরল ধাতবের ব্যবহার সামরিক বেসামরিক উভয় শিল্পে ব্যাপকভাবে বাড়ছে। আর বিশ্বের ৮০ শতাংশ বিরল ধাতবের সরবরাহকারী দেশ হলো চীন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ‘আমেরিকা ফাস্ট’ স্লোগান দিয়ে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদেরকে অভিবাসী আমেরিকানদের বিরুদ্ধে যেভাবে জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলেন সেভাবে চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্যযুদ্ধকে দেশে বা দেশের বাইরে কোথাও কাজে লাগাতে পারেননি। দেশে কাজে লাগাতে পারেননি কম আয়ের আমেরিকানরা সস্তা পণ্যপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তারা এটাকে সমর্থন করেনি আর অতিধনী কোম্পানিগুলো তাদের বিনিয়োগ ও পণ্যবাজার হারিয়েছে চীনের সাথে বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে। অন্য দিকে এশিয়ার মার্কিন মিত্র দেশগুলো ‘আমেরিকাই আগে’ নীতির মধ্যে সামরিক ও অর্থনৈতিক উভয় ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। টিপিপি বাতিল করার সিদ্ধান্ত ছিল তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।
ট্রাম্পের হঠকারিতার মূল্য গুনবেন বাইডেন?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর চুক্তির ধারাবাহিকতায় জাপান বড় কোনো প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তৈরি না করে আমেরিকান প্রতিরক্ষা নিশ্চয়তার আশ্রয়ে থেকেছে। ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই বলেন যে নিরাপত্তা ছায়ার জন্য মিত্র দেশগুলোকে আমেরিকানদের মূল্য শোধ করতে হবে। এই অবস্থায় জাপান ভেতরে ভেতরে চীনের সাথে বিনিয়োগ ও নিরাপত্তার ব্যাপারে এক ধরনের সমঝোতায় চলে গেছে। অস্ট্রেলিয়াও ট্রাম্পের চাপে পড়ে যতই ‘কোয়াড’ জোটভুক্ত হোক না কেন আমেরিকার কথায় চলতে গিয়ে অর্থনীতিকে চীনা বয়কটের বিপদে ফেলতে চায়নি। আর চীনের সাথে দক্ষিণ চীনসাগর নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিরোধের মধ্যে থাকা ভিয়েতনামও চীনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক বাণিজ্যযুদ্ধে নিজের বিপদ দেখতে পেয়েছে। মালয়েশিয়া ইন্দোনেশিয়া ফিলিপাইন থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলোও বাস্তবতার বাইরে যেতে পারেনি। তাদের সামনে করোনা-উত্তর অর্থনৈতিক বৈরিতাকে সামাল দিতে চীনা নগদ অর্থ বিনিয়োগের মূল্য অনেক বেশি মনে হয়েছে।
টিপিপি থেকে সরে আসার বিপ্লবী বা হঠকারী ঘোষণা দেয়ার সময় বারাক ওবামা নিজেও এর পরিণতি সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে আমেরিকান থিংকট্যাংকগুলোর বক্তব্যকে ডেমোক্র্যাট ভাবনার প্রতিধ্বনি হিসেবে চিহ্নিত করে ট্রাম্প প্রশাসন উড়িয়ে দিয়েছিলেন। ট্যাম্পের বিদায়ের সময় ফুরিয়ে আসার আগেই সেই দৃশ্যপটটিই সামনে চলে এলো যার আশঙ্কা ওবামা-বাইডেনরা করেছিলেন।
জো বাইডেনকে ঠাণ্ডা মাথার পরিণত বয়স ও চিন্তার মানুষ হিসেবে সবাই জানেন। তিনি এশিয়ান মিত্রদের আস্থা ফেরাতে কতটা কী করতে পারবেন বলা মুশকিল। আর বাণিজ্যবলয় তৈরির মতো উদ্যোগ রাতারাতি পরিণতি পায় না। বাইডেন বিকল্প কোনো কিছু নিয়ে হয়তো আসবেন। অথবা টিপিপিতে যোগ দিয়ে এর আগের অবয়বকে ফিরিয়ে আনবেন। কিন্তু সময়টাতো নদীর চলমান পানির মতো। একবার নদীর স্রোত লোনা দরিয়ার সাথে মিশে গেলে সেটিকে আর ফেরানো যায় না। তবুও দেখতে হবে দায়িত্ব নেয়ার পর জোশেফ বাইডেন কী করেন। তবে চীনের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ যুদ্ধে তিনি যে মাত্রাতেই হোক না কেন ক্ষান্ত যে দেবেন তা বুঝা যাচ্ছে। নতুন ১৫ জাতির বাণিজ্যচুক্তির পর সেটি সম্ভবও হবে না।
মোদির আশার গুড়ে বালি!
চীনের বিশেষ সমর্থনে যে মহা বাণিজ্যবলয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে তার সাথে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নেই। ভারত এই উদ্যোগ থেকে সরে আসার কারণে সম্ভবত দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোকে এই মুহূর্তে এর অংশ করার ব্যাপারে বেইজিং তাড়াহুড়া করেনি। তবে চীনবিরোধী বিনিয়োগ ও বাণিজ্যযুদ্ধের যে আশায় দলে দলে বিশ্ব পুঁজির মালিকরা ভারতে এসে বিনিয়োগ করতে লাইন দেবেন বলে প্রত্যাশা মোদি করেছিলেন সেই আশার গুড়ে বালি পড়ার আশঙ্কাই প্রবল মনে হচ্ছে। ভারতের দুই ‘কোয়াড’ অংশীদার জাপান ও অস্ট্রেলিয়া নতুন বাণিজ্যবলয়ের দুই প্রধান স্তম্ভ। তারা চীন থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে কেন ভারত বা বাংলাদেশে বড় বিনিয়োগ করতে যাবেন? এ কারণে ঢাকায় জাপানের রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তার দেশ চীন থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার নয়, নতুন বিনিয়োগ করতে চায় ভারত বা বাংলাদেশে। তবে ১০ পয়সার লাভ ছেড়ে ২ পয়সা লাভের জন্য জাপান চীন ছেড়ে ভারতে বিনিয়োগ করতে যাবে এমনটি মনে হয় না।
খবর কী বাংলাদেশের?
নতুন স্বপ্নভঙ্গের দৃশ্যপট বাংলাদেশের অ-মুক্ত সমাজ ও মিডিয়ায় খুব একটা আলোচনায় না এলেও ভারতে ঠিকই আলোচনা হচ্ছে। সেখানে বলা হচ্ছে আশার বাণী শোনাতে শোনাতে ভারতের অর্থনীতি ঋণাত্মক বিকাশপর্বে ঢুকে পড়েছে। এর পরও অর্থমন্ত্রী বড় একটি উল্লম্ফনের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। ট্রাম্পের বিদায়ের সাথে সাথে ভারতে বৈশ্বিক বিনিয়োগ সুনামিও উবে যাবে বলে আশঙ্কা অনেক ভারতীয় বিশ্লেষকের। কেউ কেউ এমনও বলছেন দিল্লি ৩০ শতাংশ বিশ্ব জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম এই বাণিজ্যবলয়ে প্রবেশের চিন্তাভাবনা এখনো পরিত্যাগ করেনি। সেটি হলে আসিয়ানের পাশাপাশি সার্ক দেশগুলোও এই বাণিজ্যবলয়ের অংশ হবে। আর এটি পরিণত হবে বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষের মুক্ত বাণিজ্যের (নতুন বিনিয়োগেরও) একটি বলয়। দক্ষিণ এশিয়ার যুদ্ধ উত্তেজনাও এতে কমবে।
এই ধরনের বিপুল এক এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আয়োজন যখন চলছে তখন বাংলাদেশের একজন কোটিপতি ঠিকাদার ব্যবসায়ীর নিজ প্রতিবন্ধী সন্তানকে দড়িতে ঝুলিয়ে হত্যার পর নিজেও ফাঁসিতে আত্মহত্যার খবর বের হয়েছে। সামষ্টিক সূচকে বাংলাদেশ রয়ে গেছে বিশ্বের সর্বাধিক অর্থনৈতিক বিকাশের একটি দেশ হিসেবে এই করোনাকালেও। অথচ হত্যা, আত্মহত্যা, খুন, গুম ও ব্যাংক ডাকাতির খবর আনুষ্ঠানিক অনানুষ্ঠানিক গণমাধ্যমের নিত্য সংবাদ। এই অবস্থায় এশীয় বৃহত্তম বাণিজ্য উদ্যোগ থেকে ছিটকে পড়ে করোনার টিকার ভাবনায় অস্থির রাষ্ট্রের নীতিপ্রণেতারা।
সময় চলে গেলে হা-হুতাশে কাজ হয় না। নতুন সুযোগ কবে আসবে অথবা আদৌ আসবে কি না তার কোনো গ্যারান্টি আর থাকে না। ভারতের জন্য অপেক্ষা না করে এশীয় বাণিজ্য জোটে অংশ নেয়ার বিষয় ভাবা উচিত বাংলাদেশেরও।
mrkmmb@gmail.com