বেইজিংয়ের ঠাণ্ডা মাথার বাজিমাৎ
বেইজিংয়ের ঠাণ্ডা মাথার বাজিমাৎ - ছবি সংগৃহীত
এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের এই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিটি এমন এক সময় স্বাক্ষরিত হলো যখন আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আলোচিত চার বছর শাসনের সমাপ্তি ঘটতে চলেছে। নির্বাচনের ফল না মানার ব্যাপারে ট্রাম্পের বিদ্রোহাত্মক জোরালো আওয়াজ এখন ক্ষীণকায় হয়ে আসতে শুরু করেছে। তার মানে হলো জো বাইডেনের ডেমোক্র্যাট শাসন শুরু হতে চলেছে আগামী জানুয়ারি মাস থেকে। ট্রাম্প যদি ক্ষমতায় থেকে যেতেন তাহলে চীনের বিরুদ্ধে যে বাণিজ্য যুদ্ধ তিনি শুরু করেছিলেন সেটিকে আরো জোরালোভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতেন বলে একটি ধারণা ছিল। এই বাণিজ্যযুদ্ধ তথা চীনা পণ্যের ওপর অধিক শুল্ক আরোপ করে নিজস্ব বাজার সংরক্ষণ, বিনিয়োগ প্রত্যাহার, চীনা প্রতিষ্ঠানের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ, চীনা গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ভেঙে দেয়ার নামে চীনা নাগরিকদের ওপর ক্র্যাকডাউনে এক হিসাবে চীনের ৬০০ বিলিয়ন ডলারের মতো ক্ষতি হয়েছে।
একই সাথে বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছে চীনে বিনিয়োগকারী শীর্ষস্থানীয় আমেরিকান কোম্পানিগুলোও। তাদের ক্ষতির আনুমানিক অঙ্ক কত জানা যায়নি, তবে সেটি শেয়ারবাজারে দরপতন, পণ্যের বাজার হারানো, বেইজিংয়ের পাল্টা পদক্ষেপ এবং বিনিয়োগের ধারাবাহিকতা হারানোর সম্মিলিত প্রভাবে শত শত বিলিয়ন ডলার হবে বলে অনুমান করা যায়। একই সাথে চীনের সস্তা পণ্য আমেরিকার বাজারে প্রবেশ করতে না পারায় দেশটির নাগরিকদের করোনা মন্দার মধ্যেও অধিক টাকা খরচ করতে হয়েছে।
এসবের প্রভাব আমেরিকান সমাজ ও অর্থনীতিতে দৃশ্যমান যে কতখানি হয়েছে তা বুঝা যায় দেশটির নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভোট বিপর্যয়ে। ঐতিহ্যগতভাবে যারা রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর নির্বাচনী তহবিলে বিপুল অঙ্ক চাঁদা দিতেন তারা বাইডেন শিবিরকে এবার চাঁদায় চাঁদায় ভরিয়ে দিয়েছেন। করোনা সুনামির এ মন্দা দিনেও বাইডেনের নির্বাচনী তহবিলে রেকর্ড পরিমাণে অর্থের প্রাচুর্য ঘটেছে। ফলে ডেমোক্র্যাটরা এবার যতটা সুপরিকল্পিতভাবে নির্বাচনী আয়োজন সমাপ্ত করতে পেরেছেন সেভাবে দল ক্ষমতা থেকে করা নির্বাচনের সময়ও হয়ে ওঠেনি। আর চীনের সস্তা পণ্যের প্রতিরোধ আমেরিকান নি¤œবিত্তদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে সেটি মিশিগান প্যানসেলভানিয়া জর্জিয়ার মতো সুইং স্ট্রেটে বাইডেনের জয়েই পরিষ্কার হয়েছে।
ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাব যে কেবল আমেরিকান কোম্পানি ও ভোক্তাদের ওপর পড়েছে তাই নয় একই সাথে এশিয়ায় মার্কিন মিত্র দেশগুলোতেও পড়েছে। এক দিকে আমেরিকান মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির অকাল মৃত্যুতে মার্কিন বাজারসুবিধা থেকে এসব দেশ বঞ্চিত হয়েছে অন্য দিকে চীনা বিনিয়োগ বাজারে ঢোকা বা থাকার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপের প্রভাব চীননির্ভর আসিয়ান এবং জাপান অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডের মতো এশীয় দেশগুলোতেও পড়েছে। আর ওয়াশিংটনের ট্রাম্প প্রশাসনের সর্বাত্মক বৈরিতার মুখে ছাড় দিয়ে চীন এই বাণিজ্যবলয় তৈরির উদ্যোগটিকে সমর্থন দিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়েছে।
এই প্রসঙ্গে গ্লোবাল টাইমসের বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। পত্রিকাটি বলেছে, ‘আগ্রহের বিশ্বব্যাপী ক্ষেত্রগুলোর মানচিত্র আর প্রভাবের ভিত্তিতে আঁকা হয় না। সার্বভৌমত্ব এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সমৃদ্ধি এবং প্রসারণ দেশগুলোর পক্ষে বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলে স্বার্থের নতুন উৎস অনুসন্ধান করা সম্ভব করে তোলে। নিরাপত্তার হুমকির সাধারণ হ্রাসের সাথে সাথে অর্থনৈতিক স্বার্থগুলো আরো বিশিষ্ট হয়ে ওঠে এবং সব দেশ তাদের জাতীয় স্বার্থে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিকাশকে অগ্রাধিকার দেয়। কমপক্ষে, সুরক্ষার স্বার্থে অর্থনীতিকে ত্যাগ করা একটি বাস্তববাদী নীতি হিসাবে ন্যায়সঙ্গত হওয়া ক্রমবর্ধমানভাবেই কঠিন। কিছু মার্কিন এবং পাশ্চাত্য অভিজাত চীনকে একটি ‘সম্প্রসারণবাদী সাম্রাজ্য’ হিসেবে মনে করে এবং এর অংশ হিসেবে যেকোনো দেশ বা অঞ্চলের সাথে চীনের প্রসারিত সহযোগিতাকে দেখে থাকে। প্রকৃতপক্ষে, তারা চীন, সময় এবং সেই সাথে বিশ্বকে বুঝতে ভুল করে ফেলেছে।
চীনের গোপন শক্তি
প্রসঙ্গত একটি বিষয় অনেক সময় আমাদের বিবেচনার বাইরে থেকে যায় সেটি হলো বিশ্বের শক্তি নির্বিশেষে সব দেশের দৃশ্যমান অর্থনীতির পাশাপাশি একটি অদৃশ্যমান অর্থনীতি থাকে। মুক্তবাজার ও উদারনৈতিক দেশগুলোতে অদৃশ্যমান অর্থনীতির অবয়ব ততটা বড় হয় না যতটা নিয়ন্ত্রিত বা আধা নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির দেশগুলোর হয়। চীন হলো শেষোক্ত শ্রেণীর এমন একটি দেশ যার তিন থেকে চার ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগযোগ্য নগদ অর্থ রয়েছে। চীনের দৃশ্যমান অর্থনীতির যে আকার আমরা আনুষ্ঠানিক সূত্র থেকে পাই তার তুলনায় দৃশ্যমান অদৃশ্যমান দুই অর্থনীতির আকার সংযুক্ত করা হলে এখনই বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হবে চীন। এ ছাড়া বিশ্ব এখন যেভাবে হাইব্রিড প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছে তাতে রেয়ার আর্থ বা বিরল ধাতবের ব্যবহার সামরিক বেসামরিক উভয় শিল্পে ব্যাপকভাবে বাড়ছে। আর বিশ্বের ৮০ শতাংশ বিরল ধাতবের সরবরাহকারী দেশ হলো চীন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ‘আমেরিকা ফাস্ট’ স্লোগান দিয়ে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদেরকে অভিবাসী আমেরিকানদের বিরুদ্ধে যেভাবে জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলেন সেভাবে চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্যযুদ্ধকে দেশে বা দেশের বাইরে কোথাও কাজে লাগাতে পারেননি। দেশে কাজে লাগাতে পারেননি কম আয়ের আমেরিকানরা সস্তা পণ্যপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তারা এটাকে সমর্থন করেনি আর অতিধনী কোম্পানিগুলো তাদের বিনিয়োগ ও পণ্যবাজার হারিয়েছে চীনের সাথে বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে। অন্য দিকে এশিয়ার মার্কিন মিত্র দেশগুলো ‘আমেরিকাই আগে’ নীতির মধ্যে সামরিক ও অর্থনৈতিক উভয় ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। টিপিপি বাতিল করার সিদ্ধান্ত ছিল তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।
ট্রাম্পের হঠকারিতার মূল্য গুনবেন বাইডেন?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর চুক্তির ধারাবাহিকতায় জাপান বড় কোনো প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তৈরি না করে আমেরিকান প্রতিরক্ষা নিশ্চয়তার আশ্রয়ে থেকেছে। ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই বলেন যে নিরাপত্তা ছায়ার জন্য মিত্র দেশগুলোকে আমেরিকানদের মূল্য শোধ করতে হবে। এই অবস্থায় জাপান ভেতরে ভেতরে চীনের সাথে বিনিয়োগ ও নিরাপত্তার ব্যাপারে এক ধরনের সমঝোতায় চলে গেছে। অস্ট্রেলিয়াও ট্রাম্পের চাপে পড়ে যতই ‘কোয়াড’ জোটভুক্ত হোক না কেন আমেরিকার কথায় চলতে গিয়ে অর্থনীতিকে চীনা বয়কটের বিপদে ফেলতে চায়নি। আর চীনের সাথে দক্ষিণ চীনসাগর নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিরোধের মধ্যে থাকা ভিয়েতনামও চীনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক বাণিজ্যযুদ্ধে নিজের বিপদ দেখতে পেয়েছে। মালয়েশিয়া ইন্দোনেশিয়া ফিলিপাইন থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলোও বাস্তবতার বাইরে যেতে পারেনি। তাদের সামনে করোনা-উত্তর অর্থনৈতিক বৈরিতাকে সামাল দিতে চীনা নগদ অর্থ বিনিয়োগের মূল্য অনেক বেশি মনে হয়েছে।
টিপিপি থেকে সরে আসার বিপ্লবী বা হঠকারী ঘোষণা দেয়ার সময় বারাক ওবামা নিজেও এর পরিণতি সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে আমেরিকান থিংকট্যাংকগুলোর বক্তব্যকে ডেমোক্র্যাট ভাবনার প্রতিধ্বনি হিসেবে চিহ্নিত করে ট্রাম্প প্রশাসন উড়িয়ে দিয়েছিলেন। ট্যাম্পের বিদায়ের সময় ফুরিয়ে আসার আগেই সেই দৃশ্যপটটিই সামনে চলে এলো যার আশঙ্কা ওবামা-বাইডেনরা করেছিলেন।
জো বাইডেনকে ঠাণ্ডা মাথার পরিণত বয়স ও চিন্তার মানুষ হিসেবে সবাই জানেন। তিনি এশিয়ান মিত্রদের আস্থা ফেরাতে কতটা কী করতে পারবেন বলা মুশকিল। আর বাণিজ্যবলয় তৈরির মতো উদ্যোগ রাতারাতি পরিণতি পায় না। বাইডেন বিকল্প কোনো কিছু নিয়ে হয়তো আসবেন। অথবা টিপিপিতে যোগ দিয়ে এর আগের অবয়বকে ফিরিয়ে আনবেন। কিন্তু সময়টাতো নদীর চলমান পানির মতো। একবার নদীর স্রোত লোনা দরিয়ার সাথে মিশে গেলে সেটিকে আর ফেরানো যায় না। তবুও দেখতে হবে দায়িত্ব নেয়ার পর জোশেফ বাইডেন কী করেন। তবে চীনের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ যুদ্ধে তিনি যে মাত্রাতেই হোক না কেন ক্ষান্ত যে দেবেন তা বুঝা যাচ্ছে। নতুন ১৫ জাতির বাণিজ্যচুক্তির পর সেটি সম্ভবও হবে না।