আর্মেনিয়ার চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের পরিণতি
যুদ্ধ - ছবি সংগৃহীত
আর্মেনিয়ার চাপিয়ে দেয়া সেই যুদ্ধে অন্তত ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। তবে আন্তর্জাতিক বিশ্ব সেই জবরদখলের স্বীকৃতি দেয়নি; বরং জাতিসঙ্ঘের চারটি প্রস্তাবে ভূখণ্ডটি আজারবাইজানের বলে স্বীকৃতি দিয়ে সেখানে পূর্বাবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য বলা হয়। ১৯৯৪ সালে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি অর্জিত হয়। কিন্তু আর্মেনিয়া দখল ছাড়েনি। আজারবাইজানও দাবি ছেড়ে দেয়নি এবং যেকোনো সময় যুদ্ধবিরতি নাকচ করে দিয়ে ফের যুদ্ধ শুরুর মতো একটি অবস্থান ধরে রেখেছিল। গত ২৭ অক্টোবর সেই ১৯৯৪ সালের যুদ্ধবিরতিই ভেঙে পড়ে।
ছয় সপ্তাহের যুদ্ধে আজারবাইজান এবার চমক দেখিয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে তারা ২৬ বছর আগে হারানো ভূখণ্ডের প্রায় ২০-২২ শতাংশ পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। পুরো যুদ্ধটাই যেন আজারবাইজানের অনুকূলে ছিল। হয়তো শেষ পর্যন্ত আজেরি বাহিনী পুরো নাগরনো-কারাবাখ মুক্ত করে নিতেও পারত। কিন্তু আজারবাইজান যখন চূড়ান্ত বিজয়ের পথে তখনই রাশিয়া যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে মাঠে হাজির হয়। আজেরি সেনারা ওই অঞ্চলের কৌশলগত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর শুশা দখলে নেয়ার পরই রাশিয়া হস্তক্ষেপ করে এবং দু’পক্ষকে দ্রুত আলোচনার টেবিলে নিয়ে গিয়ে সমঝোতায় রাজি করায়। ফলে হঠাৎ করেই যেমন শুরু হয়েছিল তেমনই সহসাই থেমেও যায় যুদ্ধ। ছয় সপ্তাহের যুদ্ধেই উভয়পক্ষে অন্তত চার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে বলে জানা যায়।
গত ১০ নভেম্বর রাশিয়ার প্রস্তাবিত ৯ দফা শান্তিচুক্তিতে রাজি হয় আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান। চুক্তিতে সই করেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ ও আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান।
চুক্তি অনুযায়ী নাগরনো-কারাবাখ নিয়ে চলমান যুদ্ধ বন্ধ এবং সঙ্ঘাতপূর্ণ ওই অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি শান্তির পথ খুঁজে বের করতে রাজি হয়েছে উভয়পক্ষ। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ১০ নভেম্বর মস্কোর সময় মধ্যরাত থেকে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। চুক্তি মোতাবেক, দুই দেশের সেনারা বর্তমানে যে অবস্থানে রয়েছে সেখানেই থাকবে। অর্থাৎ সাম্প্রতিক যুদ্ধে আর্মেনিয়ার কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণে নেয়া শুশা শহর ও অন্যান্য এলাকায় আজারবাইজান অবস্থান করবে। চুক্তিমতে আর্মেনিয়া আগামী ২০ নভেম্বর আঘদাম জেলা আজারবাইজানের কাছে ফেরত দেবে। এ ছাড়াও আর্মেনিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকা কালবাজার জেলা আগামী ১৫ নভেম্বর ও লাচিন জেলা আগামী ১ ডিসেম্বর আজারবাইজানের কাছে হস্তান্তর করবে আর্মেনিয়া। আগে শুশা শহরের ভেতর দিয়ে নাগরনো-কারাবাখের সাথে যোগাযোগ করত আর্মেনিয়া। এখন তারা পাঁচ কিলোমিটার প্রশস্ত লাচিন করিডোর দিয়ে যোগাযোগ রক্ষা করবে। মূল ভূমি থেকে দূরে, আজারবাইজানের নাখচিভান স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে যাতায়াত করতে নিজেদের ভূমি ব্যবহার করার অনুমতি দেবে আর্মেনিয়া। যোগাযোগ অবকাঠামো তৈরিতেও কাজ করবে দেশটি।
বিরোধপূর্ণ অঞ্চলে শান্তিরক্ষার দায়িত্বে থাকবে রাশিয়ার দুই হাজার সেনা সদস্য। তারা দুই দেশের নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর অবস্থান নেবে। এ ছাড়াও আর্মেনিয়ার সাথে সংযোগ রক্ষাকারী লাচিন করিডোরের নিরাপত্তা দেবে রুশ সেনারা। আজারবাইজান চাইছে রাশিয়ার সেনাদের সাথে তুরস্কের সেনারাও অবস্থান করবে। এ বিষয়ে রাশিয়া সম্ভবত রাজি হবে না।
যাই হোক, চুক্তিতে বলা হয়েছে- কোনো পক্ষ চুক্তি থেকে সরে না গেলে এই স্থিতাবস্থা আগামী পাঁচ বছর চলবে। পাঁচ বছর পর চুক্তি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বলবৎ হবে। অবশ্য এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য ভবিষ্যতে কী উদ্যোগ নেয়া হবে, চুক্তিতে সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
সাম্প্রতিক যুদ্ধে আজারবাইজানের পক্ষে সমর্থন দেয়া তুরস্ক ওই চুক্তিকে ‘আজারবাইজানের বিজয়’ বলে উল্লেখ করেছে। চুক্তির পর আজারবাইজানের নাগরিকরা আনন্দ-উল্লাসে মেতেছে। উল্টো দিকে আর্মেনিয়ায় হয়েছে বিক্ষোভ। উঠেছে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি। এমনকি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করে ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে জাতীয় নিরাপত্তা সার্ভিসের সাবেক প্রধান আর্তুর বেনেৎসিয়ানকে ১৪ নভেম্বর গ্রেফতারও করা হয়েছে। এরই মধ্যে অধিকৃত যেসব এলাকা আজারবাইজানকে ফেরত দেয়া হবে বলে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সেসব জায়গা থেকে আর্মেনীয় বংশোদ্ভূতরা দলে দলে ঘরবাড়ি ছেড়ে আর্মেনিয়ার দিকে চলে যাচ্ছে। অনেকে যাওয়ার আগে আগুন দিয়ে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে বলেও এক খবরে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি।
বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার কারণ, এসব বাড়ি তারা নিজের রক্তঘামে অর্জিত অর্থ দিয়ে কেনেনি। প্রায় ৩০ বছর আগে আর্মেনিয়া যখন ওই এলাকাটি দখল করে, তখন এগুলো আজারবাইজানি মুসলমানদের সম্পত্তি ছিল। দখলের পর আর্মেনিয়া সরকার বাড়িগুলো নামমাত্র মূল্যে সেখানে আসা আর্মেনীয়দের হাতে তুলে দিয়েছিল।