আজারবাইজানি মুসলমানদের সম্পত্তিই আগুনে পুড়িয়েছে আর্মেনিয়ানরা
আজারবাইজানি মুসলমানদের সম্পত্তিই আগুনে পুড়িয়েছে আর্মেনিয়ানরা - ছবি সংগৃহীত
সাম্প্রতিক যুদ্ধে আজারবাইজানের পক্ষে সমর্থন দেয়া তুরস্ক ওই চুক্তিকে ‘আজারবাইজানের বিজয়’ বলে উল্লেখ করেছে। চুক্তির পর আজারবাইজানের নাগরিকরা আনন্দ-উল্লাসে মেতেছে। উল্টো দিকে আর্মেনিয়ায় হয়েছে বিক্ষোভ। উঠেছে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি। এমনকি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করে ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে জাতীয় নিরাপত্তা সার্ভিসের সাবেক প্রধান আর্তুর বেনেৎসিয়ানকে ১৪ নভেম্বর গ্রেফতারও করা হয়েছে। এরই মধ্যে অধিকৃত যেসব এলাকা আজারবাইজানকে ফেরত দেয়া হবে বলে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সেসব জায়গা থেকে আর্মেনীয় বংশোদ্ভূতরা দলে দলে ঘরবাড়ি ছেড়ে আর্মেনিয়ার দিকে চলে যাচ্ছে। অনেকে যাওয়ার আগে আগুন দিয়ে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে বলেও এক খবরে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি। বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার কারণ, এসব বাড়ি তারা নিজের রক্তঘামে অর্জিত অর্থ দিয়ে কেনেনি। প্রায় ৩০ বছর আগে আর্মেনিয়া যখন ওই এলাকাটি দখল করে, তখন এগুলো আজারবাইজানি মুসলমানদের সম্পত্তি ছিল। দখলের পর আর্মেনিয়া সরকার বাড়িগুলো নামমাত্র মূল্যে সেখানে আসা আর্মেনীয়দের হাতে তুলে দিয়েছিল।
এমনই এক পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, আজারবাইজান তার সমূহ বিজয়ের মুখে কেন যুদ্ধবিরতিতে রাজি হলো এবং শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করল? এ প্রশ্নের জবাব এক কথায় দেয়া সম্ভব নয়। সবাই জানেন, যুদ্ধরত দু’পক্ষের পেছনেই আরো বেশ কিছু বৈশ্বিক শক্তি নৈতিক ও বৈষয়িক সমর্থন নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এটি শুধু আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং তুরস্ক, ফ্রান্স, ইরান ও রাশিয়ার সংশ্লিষ্টতায় এটি ছিল এক জটিল লড়াই। রাশিয়া ও ফ্রান্স ছিল আর্মেনিয়ার পক্ষে। বিস্ময়কর হলেও সত্য, ‘ইসলামী বিপ্লবের দেশ’ ইরানও যুদ্ধরত মুসলিম দেশ আজারবাইজানের পক্ষে না থেকে ছিল খ্রিষ্টান আর্মেনিয়ার পক্ষে। এর কারণ ইরানের সাথে আজারবাইজানের সীমান্ত এবং কাস্পিয়ান সাগরের তেল-গ্যাস নিয়ে বিরোধ। এ দিকে রাশিয়া চায় নাগরনো-কারাবাখ নিয়ে সমস্যা জিইয়ে রাখতে। এতে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান- দুই দেশকেই তার নিয়ন্ত্রণ করতে সুবিধা হবে।
ওদিকে ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের ক্রমবর্ধমান প্রভাব খর্ব করতে চায় ফ্রান্স। নিজ নিজ স্বার্থে এই তিন দেশই আর্মেনিয়াকে অস্ত্র ও ভাড়াটে সেনা দিয়ে সহায়তা করেছে। তবে সব থেকে বেশি উচ্চকিত ছিল ফ্রান্স। কারণ বিশ্বজুড়ে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের বেশ ক’টি বিরোধপূর্ণ ইস্যুতে ফ্রান্স তুরস্কের সাথে পাল্লায় তেমন কায়দা করে উঠতে পারেনি। সম্প্রতি রাসূল সা:-এর ব্যঙ্গচিত্র ইস্যুতে ইসলামবিরোধী বক্তব্য দিয়ে বেকায়দায় পড়া ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁকে মানসিক চিকিৎসা নেয়ার পরামর্শ দিয়ে একহাত নিয়েছিলেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান। সেটিও গায়ে জ্বালার কারণ ছিল ম্যাক্রোঁর। আবার সাগরে তেল আহরণ নিয়ে গ্রিসের সাথে তুরস্কের বিরোধে ম্যাক্রোঁ খুব হম্বিতম্বি করলেও তুরস্ককে হটাতে ব্যর্থ হয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ করে, লিবিয়ায় ফ্রান্সের নীতি চরমভাবে মার খেয়েছে তুরস্কের কাছে। সব মিলিয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের প্রতি যেন একধরনের ব্যক্তিগত আক্রোশে ভুগছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট।
সেসব বিরোধের কারণেই তুরস্ক যখন আজারবাইজানের পক্ষে সমর্থন দিয়েছে, তখন অস্ত্র ও ভাড়াটে সেনা নিয়ে সরাসরি আর্মেনিয়ার পাশে দাঁড়ায় ফ্রান্স। তবে দেখা গেল, ওই সর্বশেষ সেক্টরেও গো-হারা হেরে গেল দেশটি। তা হলে দাঁড়াচ্ছে এই যে, যুদ্ধে জয় হয়েছে আজারবাইজানের, তুরস্কের ও রাশিয়ার। পরাজিত আর্মেনিয়া ও ফ্রান্স। রাশিয়ার বিজয়ের ব্যাপারে সন্দেহের কোনো কারণ নেই। চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে সে বিবদমান দুই দেশের ওপর প্রভাব অটুট রাখতে পারছে। শান্তি রক্ষার নামে সেনা বসাতে পারছে এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ করিডোরের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ বলবৎ রাখতে পারছে। সুতরাং বিজয় রাশিয়ারও। প্রকৃতপক্ষে এবারের লড়াইয়ে লাভবান হলো রাশিয়া ও তুরস্ক। রাশিয়া ধীরে ধীরে মধ্যপ্রাচ্যের সীমান্তে চলে আসছে। নাগরনো-কারাবাখে সেনা মোতায়েনের মানে হলো ইরানের মাথার ওপর অবস্থান নেয়া। আর তুরস্ক আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজের অবস্থান সংহত করছে। শুধু তা-ই নয়, নাগরনো-কারাবাখে সেনা পাঠাতে না পারলেও মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়া মাইনরে প্রভাব বৃদ্ধির দৌড়ে এখন পর্যন্ত তুরস্ক এগিয়ে রইল। নাগরনো-কারাবাখ থেকে আর্মেনিয়ার পিছু হটায় তুরস্কের বিরুদ্ধে উসমানীয় খেলাফতের আমলে আর্মেনীয় গণহত্যার বৈশ্বিক প্রচারণা এখন অনেকটাই স্তিমিত হয়ে আসবে বলেও অনেকে মনে করছেন।