বাইডেন আসাতে গুরুত্বপূর্ণ যেসব পরিবর্তন অনিবার্য
বাইডেন - ছবি সংগৃহীত
গত ৭ নভেম্বর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল হিসাবে জো বাইডেন অন্তত ২৭৯ ইলেক্টোরাল কলেজের আসন পেয়ে বিজয়ী হতে যাচ্ছেন জানা গেল। কিন্তু তা সত্ত্বেও নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে বিতর্ক, আপত্তি বা মামলার নিষ্পত্তি এখনো খতম হয়নি। তবে ধীরে ধীরে প্রতিটি মামলা বা ঘটনায় ট্রাম্প-ক্যাম্পের তোলা আপত্তি বা অভিযোগের কোনো ‘প্রমাণ পাওয়া যায়নি’ বলেই তা খারিজ হয়ে ক্রমে অনেক কিছুর নিষ্পত্তি হয়ে চলেছে। তবু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল প্রসঙ্গে আমেরিকার আকাশের কালো মেঘ ও অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি। এর পেছনের প্রধান কারণ সম্ভবত, খোদ ডোনাল্ড ট্রাম্পের কিছু ঘোষণা ও পাল্টা পদক্ষেপ। যেমন- তিনি নিজেই হুমকি দিয়েছেন যে- ‘তিনিই এই নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন অথচ তাদেরকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে এবং তারা হেরেছেন বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে।’ কিন্তু এসব ইস্যুতে ট্রাম্প-ক্যাম্পের আগ্রহ প্রমাণসহ অভিযোগ তুলে ধরার চেয়ে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা ছড়ানোর চেষ্টা অনেক বেশি। তিনি স্টেট ডিপার্টমেন্টের পম্পেইকে দিয়ে ঘোষণা করিয়েছেন যে, আগামী ২০ জানুয়ারির (দেশের নতুন প্রশাসনের শপথ নেয়ার দিন) পরে ট্রাম্পের সরকার কার্যক্রম চালু রাখবে। তাই নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে অজানা আশঙ্কা যা আগে কখনো আমেরিকা দেখেনি তা আগে থেকেই তাদের সমাজে ছেয়ে বসে আছে। যদিও সেটা বাড়ছে, এমনটা বলা যাবে না।
বরং ছোট ছোট পদক্ষেপে ক্রমে অভিযোগগুলো আদালতে বা নির্বাচনী কর্তাদের হাতে প্রত্যাখ্যান বা নাকচ হয়ে যাচ্ছে। ১৪ নভেম্বরের শুরুতে, ভোর রাতের হিসাবে কয়েক ঘণ্টা আগে প্রকাশিত কয়েকটা খবরের শিরোনাম এ রকম- ১. পেনসিলভানিয়ার নির্বাচনী কর্তারা নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে আদালতে ট্রাম্পের মামলার ফেডারেল বিচারককে জানিয়েছেন, যেন তিনি মামলা বাতিল ঘোষণা করে দিতে পারেন এখন- রয়টার্সের প্রকাশিত রিপোর্ট। ২.আমেরিকার নিবার্চনী কর্তারা ট্রাম্পের কারচুপির অভিযোগ বা দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন- বিবিসি ইংরেজির রিপোর্ট। তারা আরো বলেছেন, ‘এবারের ভোট ব্যবস্থায় কোনো ভোট বাতিল হয়েছে বা হারিয়ে গেছে, পরিবর্তন করা হয়েছে অথবা কোনো ধরনের কালোদাগ লেগেছে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’ বরং আমেরিকায় অনুষ্ঠিত ‘ভালো নির্বাচনগুলোর অন্যতম এবারের ভোট।’ ৩. বাইডেন অ্যারিজোনার আসনগুলোও পেয়ে নিজের ইলেক্টোরাল কলেজ আসন ২৯০ তে নিয়ে আরো পোক্ত হতে যাচ্ছেন- রয়টার্সের প্রকাশিত রিপোর্ট। ৪. এটা বিবিসি বাংলার ফ্যাক্ট চেক টিমের গবেষণা; মানে, তাদের ভাষায় ‘বিবিসির রিয়েলিটি চেক টিম’-এর ১০ নভেম্বরের রিপোর্ট। তারা বলছেন, ‘কোনো তথ্যপ্রমাণ না দিলেও যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বক্তৃতা-বিবৃতিতে বেশ কয়েকটি পোস্টের কথা উল্লেখ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার প্রচারণা শিবির।’
এভাবেই ট্রাম্পের অভিযোগের পাটাতন ক্রমে নিজ পায়ের নিচের মাটি হারিয়ে চলেছে। তবু সব অভিযোগ শেষ হয়েছে এমন নয়। এর প্রধান কারণ, আমেরিকার নির্বাচনী ব্যবস্থায় আমাদের মতো কোনো কেন্দ্রীয় বা ফেডারেল নির্বাচনী অফিস বলে কিছু নেই। ভোট নেয়া, তদারকি ও ফলাফল ঘোষণা প্রত্যেকটা রাজ্যের দায়িত্ব এবং তা তাদেরই নিজ নিজ আইনে পরিচালিত হতে হয়; যাতে আবার রাজ্যে রাজ্যে কিছু আইনগত ভিন্নতাও আছে। তাই এখন ট্রাম্পের অভিযোগগুলো নিষ্পন্ন হচ্ছে, প্রতিটি রাজ্যে এবং মূলত নির্বাচন অফিস ও আদালতে। তবু একটা ধারণা হিসেবে বলা যায়, এগুলো নিষ্পত্তি করতে আগামী ২৩ নভেম্বরের মধ্যে রাজ্যের নির্বাচনী কর্মকর্তারা ফলাফল ঘোষণার কাগজে স্বাক্ষর করা শেষ করতে পারেন। তখন এই ফলাফল ‘অফিসিয়ালি ঘোষিত ফলাফল’ বলে বিবেচিত হবে।
আর তখন ট্রাম্পের অফিস ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু করতে বাধ্য হয়ে যাবে। তা না করলে আদালত ট্রাম্পের অফিসকে অকার্যকারিতার জন্য অভিযুক্ত করতে পারবেন এবং পাল্টা করণীয় নির্দেশ জারি করতে পারেন। অর্থাৎ ক্রমে ট্রাম্পের জন্য, ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু করার বাধ্যবাধকতা কঠিন ও শক্ত হয়ে আসছে।
এভাবে অনুমান করা যায়, ট্রাম্প যতই হুমকি দিন তবু, ২০ জানুয়ারির আগেই ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু ও সম্পন্ন করতে ট্রাম্প বাধ্য হবেন। আর সবার ওপরে আমেরিকার মানুষ স্থিতিশীলতা চায়, দেশে একটা ফাংশনাল সিস্টেম দেখতে চায়; মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো হতাশাগ্রস্ত জীবনের কোনো দেউলিয়া ব্যবসায়ী প্রেসিডেন্ট হয়েছেন বলে, ‘আমি ক্ষমতা হস্তান্তর করব না’-এই দায়দায়িত্বহীন বাক্য কিংবা বিশৃঙ্খলা মানুষ দেখতে চায় না। জীবন ইতিবাচক এবং তা আশা-ভরসা নিয়েই চলে। তাই আমরা বরং এখন জো বাইডেনের বিজয়ে ও হবু বাইডেন প্রশাসনের চলার পথের নীতি-পলিসি কী হতে যাচ্ছে আলোচনা সেদিকে নিচ্ছি।
বাইডেন প্রশাসন সম্ভাব্য কেমন
প্রথমত এটা ট্রাম্পের হাতে গত চার বছরে যত ব্যত্যয় ঘটিয়েছিলেন তিনি, এর উল্টা যাত্রায় যতটা সম্ভব আগের ওবামা আমলের অভিমুখী হবেন। সাধারণভাবে যা ডেমোক্র্যাট আইডিয়াল অবস্থান মনে করা হয় তেমন অভিমুখে যাবে। তবে কিছু ক্ষেত্রে এটা আরো প্রো-পাবলিক হবে, সাধারণ জনমত যা আশা করে। যেমন- পরিবেশ ইস্যুতে ‘প্যারিস চুক্তিতে’ ফেরত যাওয়া আর হিউম্যান রাইটস ইস্যুতে অনেক কড়া অবস্থান নিয়ে আসছেন বাইডেন। তবে সব কিছুর ওপরে যা প্রধান দ্বন্দ্ব, যার নিরসন হবে মুখ্য ইস্যু- যা অনেকটা পরস্পর সংশ্লিষ্ট অনেকগুলো চাকার মধ্যে প্রথম যে চাকাটা ঘুরে বাকি সব চাকাকে ঘুরতে বাধ্য করে, এমন সেই ‘প্রাইম মুভার’ ইস্যু হলো চীনের সাথে ‘বাণিজ্য ইস্যু’ নিয়ে আলোচনা (যাকে গত চার বছর বাণিজ্যযুদ্ধ বলে ডাকা হয়েছে) তা শুরু করা। তাই ২০ জানুয়ারি বাইডেনের শপথ নেয়ার পরেই এক নম্বর প্রায়রিটি হবে এই ইস্যু।
অথচ ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের আমলেই তা তিন পর্বে মিটিয়ে ফেলার একটা পরিকল্পনা ছিল যার প্রথম পর্ব ট্রাম্পই আলোচনা ও ঐকমত্য শেষে স্বাক্ষরও সমাপ্ত করেছিলেন। কিন্তু আর অগ্রগতিতে না গিয়ে সব স্তব্ধ করে রেখেছিলেন। সেসবই এবার ফাংশনাল হতে শুরু করবে। এটাই হবে বাইডেনের প্রাইম মুভার ঘটনা। এ জন্য যে, ট্রাম্প বাণিজ্য আলোচনাকে বাণিজ্যযুদ্ধের জায়গায় নেয়াতেই আমেরিকার গ্লোবাল নেতৃত্ব যা গত ৭৫ বছর ধরে রাজত্ব করার শেষে এর পালাবদলটা মসৃণ হওয়ার বদলে তা যুদ্ধপরিস্থিতির দিকে দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে ঠেলে দেয়ার দিকে নিচ্ছিলেন ট্রাম্প। তা এখন অভিমুখ বদলাবে, এটাই দুনিয়াজুড়ে সবার আশা। এই অর্থে, বাইডেনের বিজয়ের প্রাথমিক খবর মানুষকে এক সম্ভাব্য গ্লোবাল যুদ্ধপরিস্থিতি এড়াতে এক মুক্তির সূচনা করল।
তাহলে এখন কী হতে পারে?
খুব সম্ভবত বাণিজ্য আলোচনায় আসলে যা হবে চীনের দিক থেকে দেখলে তাকে বলা যায়- এটা হবে, যত বেশি সম্ভব আমেরিকাকে বাজার ছাড় দিয়ে এর বিনিময়ে চীন নিজের গ্লোবাল নেতৃত্ব নেয়া- এই হস্তান্তর মসৃণ ও বাধাহীন করার নিশ্চয়তা ‘কিনে নেয়া’। বাণিজ্য আলোচনায় এই দেয়া-নেয়া সম্পন্ন হতে পারে। এটা আবার দুইভাবে ঘটতে পারে। এক, মুখে স্বীকার করে নিয়ে শুরু করা যে, আমরা পরস্পর এটাই বিনিময় করছি। অথবা তা হতে পারে মুখে স্বীকার না করে দুইপক্ষই মনে মনে এটা ধরে নিয়ে। তবে মুখে স্বীকার না করে নেয়ার কৌশলগত সুবিধা বেশি।
এভাবে বাণিজ্য আলোচনা নেগোসিয়েশনের আগের পথেই দ্বিতীয় পর্ব একটা চুক্তিতে পৌঁছালেই এরপর জো বাইডেন-শি জিনপিংয়ের যৌথ সামিট অনুষ্ঠিত হতে পারবে। আর দুইপক্ষের ওপরই দ্রুত এমনটা করার জন্য গ্লোবাল বাজারের চাপ থাকবে প্রচুর। কারণ করোনাকালে দ্বিতীয়বারের আক্রমণের ধাক্কাও আসন্ন। ফলে নিরন্তর মন্দা বাজারে ইতিবাচক মেসেজ পেতে সবাই আগ্রহী যাতে বাজার চাবুক খেয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
এতে বাজার ও ক্ষমতার করিডোরে কী মেসেজ যাবে?
সামগ্রিকভাবে মূল মেসেজটা হবে ইন্দো-প্যাসিফিক এবং কোয়াড উদ্যোগ ও স্ট্র্যাটেজিকে কেন্দ্র করে। ট্রাম্প মূলত মরিয়া হয়ে এটাকে একই সাথে সামরিক জোট ও বাণিজ্য জোট হিসেবে গড়ে তুলতে চাচ্ছিলেন। ট্রাম্প জানতেন এটা ৩ নভেম্বরের নির্বাচনের পরে অকেজো দিশেহারা স্থবির হয়ে যাবে, কারণ নির্বাচনে পরাজিত হয়ে গেলে তো এমনই দশা হওয়ার কথা।
চীনের সাথে বাণিজ্য আলোচনায় প্রথমপর্বের আলোচনার শেষে একবার ট্রাম্প ক্ষুব্ধ হয়ে এবং প্রকাশ্যে প্রেসের সামনে বলেছিলেন, চীন বাকি নেগোসিয়েশন আর করল না, আগালোও না- বাইডেনের ভরসায়। মানে নিজ ক্ষমতাসীন থাকার দু’বছরের মধ্যেই সে সময় ট্রাম্প বুঝাতে চেয়েছিলেন আগামীতে রিপাবলিকান প্রার্থী বাইডেন জিতে আসবে, এই ভরসায় আছে চীন। তারা তখন বেটার সুবিধা পাবে ও নেবে (ট্রাম্পের কাছে পাচ্ছে না) চিন্তা করে এখন ট্রাম্পের সাথে কম্প্রোমাইজ ডিলে যাচ্ছে না। তাই তিনি ওখানে ঘোষণা করেন, আগামীতে বাইডেনের ক্ষমতাসীন হওয়া বন্ধ করতে তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন। তাই ধীরে ধীরে চীনবিরোধী জোট- সেটা খাঁড়া করা খুবই কঠিন হলেও তিনি ইন্দো-প্যাসিফিক ও কোয়াড গড়ে এটাতে সামরিক জোট ও বাণিজ্য জোট এ দুই লক্ষ্য জুড়ে দিয়েছিলেন।
আর এখন ঠিক এ জায়গাটাতেই বাইডেন বদল ঘটাবেন। কৌশলগতভাবে ইন্দো-প্যাসিফিক ও কোয়াড উদ্যোগ ভেঙে না দিয়ে এটা কেবল বাণিজ্যের জোট এমন ধারণা সেট করে দেবেন। অর্থাৎ চীনের সাথে বাইডেন কী দেয়া-নেয়া করতে যাচ্ছেন বা করে ফেলবেন এর ছাপ-ইঙ্গিত তিনি এভাবে প্রকাশ করবেন।
স্বভাবতই, আড়াই লাখ আমেরিকানের কোভিড-১৯-এ মৃত্যু আর প্রায় ৯ কোটি বেকারের আমেরিকায় বাইডেনের চীনা ডিল বা সম্ভাব্য ‘দেয়া-নেয়া’ একটা ইতিবাচক আবহাওয়া তৈরি করবে। যেকোনো অর্থনীতিই বেকারত্ব ও মহামারী থেকে বের হয়ে আসতে চায়। কারণ ‘উহান ভাইরাস’ বলে ট্রাম্পের নিজের সব শোচনীয় ম্যানেজমেন্ট ব্যর্থতা চীনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া নির্বাচন পার হওয়ার জন্য হয়তো চলে। কিন্তু বাস্তবতা খুব কঠিন। তাই, না আমেরিকান অর্থনীতি না বেকার মানুষ এসব কথাকে এতদিন ইতিবাচক হিসেবে দেখেছে। অতএব, যদি এভাবেই আগানো হয় তবে বাইডেন-শি জিনপিংয়ের সামিট তখন আমেরিকায় এক শীতল-পরশের মতো ভূমিকা নিয়ে আসবে।
তাহলে ভারত তখন কোথায় যাবে?
সীমান্তে চীন ভারতের সব দখল করে ১৯৫৯ সালের পুরনো সীমান্তকে ভিত্তি করে বসে পড়াতে ভারতের ইন্টেলিজেন্সিয়া বিশেষত মিডিয়া ফোরফ্রন্টে যারা আছেন তারা বুঝে গেছেন, মোদি তাদের সবাইকে বেইজ্জতি করে ফেলেছেন। কিন্তু তবু তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত ইজ্জত ও নিরাপত্তা হারানোর অসহায়ত্ব একালে ফুটে উঠেছে। তারা পরিষ্কার জানেন, কেন চীন ১৯৫৯ সালের পুরনো সীমান্তকে ভিত্তি মেনে সব কেড়ে নিয়েছে, কেন ‘এলএসি’ বলে এখন কিছুই নেই। মোদির হামবড়া ভাব আর কাশ্মির দখলের দাবি- এসব অবিবেচক অবস্থাই তাদেরকে ইজ্জত ও নিরাপত্তা হারানোর অসহায়ত্ব অনুভবে ফেলে দিয়েছে, তাও তারা কমবেশি জানেন। কিন্তু তাদের সিদ্ধান্ত হলো- কথিত ‘জাতীয় স্বার্থের’ নামে মিথ্যা কথার জার্নালিজমই তাদের করতে হবে। বাইরে মনে হবে তারা মোদির পক্ষেই দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু আসলে এটা তাদের ইজ্জত ও নিরাপত্তা হারানোর অসহায়ত্ব থেকে মুক্তি বা রিলিফ দেবে বলে তারা মনে করেন।
এ কারণে আগামীতে বাইডেন-জিনপিংয়ের সামিট যতই আসন্ন হয়ে উঠবে ভারত ততোধিক অস্থির হয়ে চীনের সাথে ৫ আগস্ট ২০১৯ সালের কাশ্মিরের স্ট্যাটাস বদলের আগের চীন-ভারত সম্পর্ক যে জায়গায় ছিল সেখানে ফিরে যাওয়ার জন্য অস্থির ও মরিয়া হয়ে উঠবে। অবশ্য এই মোদির ভারত জানবে যে, বাইডেনের আমেরিকা ভারতকে আর ‘চীন ঠেকানোর’ কাজের কোনো ঠিকা দেবে না। ফলে বাংলাদেশকে ভারতের হাতে তুলে দেয়া- এরও কোনো বালাই থাকবে না।
আর মোদির সবচেয়ে বড় বাইডেন-অস্বস্তি ইতোমধ্যেই তাকে অস্থির করে তুলেছে। সে কারণে বাইডেন আসছে এই খবর পাওয়ার পর থেকে ভারতীয় মিডিয়ার সুর বদলে গেছে। তারা বলছে ‘আমেরিকার নির্বাচনে কে জিতল তাতে ভারতের কিছুই যায় আসে না।’ অর্থাৎ তারা বলতে চাইছে, আসলে হে বাইডেন সাব, আমরা ভুল করেছি; আমাদের মাফ করে দাও। আমাদের মোদি ‘হাউ ডি মোদি’ করেছিল, হিউস্টনে আর গুজরাটে। যেখানে মোদি নিজে ‘আব কি বার ট্রাম্প সরকার’ (পরের নির্বাচনে ট্রাম্পই জিতবেন) স্লোগান ধরেছিল। এটা গর্হিত কাজ, অসৌজন্যমূলক। কারণ একজন সিটিং প্রধানমন্ত্রী এভাবে পক্ষপাতিত্বপূর্ণ অবস্থান প্রকাশ্যে নিয়েছে। ফলে এখন বাইডেন-মোদি কখনো সাক্ষাৎ হলে মোদি মুখ দেখাবেন কী করে, সেই অস্বস্তি এড়াবেন কী করে? এমন ন্যূনতম হুঁশজ্ঞান নেই এমন লোকই এখন ভারতের নির্বাহী ক্ষমতার প্রধান। আর সেসব ঢাকতেই মোদি এখন মিডিয়াকে বশ করে এমন রিপোর্ট ছাপানো। বিবিসি বাংলার ট্রাম্পের নামে আগেভাগে ‘আব কি বার ট্রাম্প সরকার’ জয়ধ্বনি দিয়ে মোদি কি এখন বিড়ম্বনায়?’ এই শিরোনামের রিপোর্টটা বলে দেয়, মোদি কোন বেইজ্জতিতে আছেন। দুই সপ্তাহ আগেই যারা ট্রাম্পকেই তাদের নিরাপত্তাদাতা মনে করতেন এমন কূটনীতিক বা মিডিয়াকর্মীরা বলছেন, বাইডেনের সাথে ভারতের সম্পর্ক যেন কতকাল আগের। আসলে তামাশার বোধ হয় কোনো সীমা থাকে না!
এদিকে চীন-ভারত লাদাখ সীমান্তে সেনা প্রত্যাহার নিয়ে আলোচনা ইতোমধ্যেই হঠাৎ গতি পেয়েছে, মনে হচ্ছে।
কিন্তু বাংলাদেশে?
কিন্তু বাইডেন জেতার প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে সম্ভবত হবে সবার চেয়ে ভিন্ন। এর মূল কারণ, হিউম্যান রাইট মেনে চলার প্রশ্নে বাইডেনের কড়া অবস্থান। এটাই মোদির জন্যও সবচেয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ার কারণ হয়েছে ইতোমধ্যেই। বাইডেন আগেই তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হিসেবে কাশ্মিরে রাইট ভায়োলেশন নিয়ে সোচ্চার হবেন জানিয়ে দিয়েছিলেন। তবে সাধারণভবে এটা ছিল সবাইকে দেয়া, হেনরি কিসিঞ্জারের পরামর্শ যে, একালে চীনকে বেকায়দায় রাখতে চাইলে হিউম্যান রাইট মেনে চলার প্রশ্নে নিজ প্রশাসনের কড়া অবস্থান জরুরি। তাই ব্যবসা পাওয়ার লোভে আমেরিকার এতে ছাড় দেয়া যাবে না। এই নীতি অবশ্য ডেমোক্র্যাটরা তুলনামূলক বেশি অনুসরণ করেছেন। বাইডেনের কড়া অবস্থানের পেছনে এটাই কারণ।
আর এটাই হাসিনা সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে। অনেকে বলতে পারেন, এটাই একই সাথে চীনের উপরেও চাপ, যাতে হাসিনা-চীন ঘনিষ্ঠতা কমে। এক থিঙ্কট্যাঙ্ক কনসালট্যান্ট কুগেলমানের বরাতে বাংলাদেশের একটি পত্রিকা লিখেছে, এই ঘনিষ্ঠতা কমানো হবে বাইডেনের বাংলাদেশ অবস্থানের মূল নির্ণায়ক। কিন্তু এ কথা আসলে ‘ওভার এস্টিমেশন’। কারণ ‘বেসিক ফ্যাক্টস’ হলো- আমেরিকা বাংলাদেশে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী অবকাঠামোর- ঋণদাতা বিনিয়োগকারী একেবারেই নয়, চাইলেও তা হতে পারবে না। তাই আমেরিকার ‘চীনা ঘনিষ্ঠতা’ ছুটানোর কোনো মুরোদই নেই। ধমকিয়ে কারো মন পাওয়া যায় না, এর সম্ভাবনা নেই। সে জন্য মন পাওয়ার ‘তরিকা’ ধরতে হয়। অবশ্য বাংলাদেশে ইন্টারভেন করার মুরোদ আমেরিকার এখনো আছে এবং খুব সম্ভবত এই বাইডেন প্রশাসনই হবে বাংলাদেশে ইন্টারভেন করার শেষ ক্ষমতাধারী। আরেক বটম লাইন হলো- চীন বাংলাদেশের কাছে অবকাঠামো-ঋণদাতা বিনিয়োগকারী থাকবেই, তাতে বাংলাদেশে যেই ক্ষমতায় থাক অথবা একটা নির্বাচিত সরকার থাকুক কি না থাকুক কিংবা ওই ঋণ থেকে অর্থ সরানোর সুযোগ কারো থাকুক আর নাই থাকুক। কাজেই কুগেলমান যেভাবে কথাটা চীনকে জড়িয়ে হাজির হয়েছেন তাতে ব্যাপারটা সস্তা ভয় দেখানোর কাজ হয়েছে। ভদ্র ভাষায় বলতে হয়, এটা ‘অতিসরলীকৃত এক বুঝ’ বলা যায়।
কিন্তু বাংলাদেশে হিউম্যান রাইট মেনে চলার রেকর্ড সঠিক করার চাপ আসন্ন, এ কথা বাস্তব ও সত্য। ট্রাম্প নয়, এটা বাইডেন জিতেছে বলে, ভারত আর বাইডেনের পিঠে চেপে চলা বা আসা কোনো ‘ব্যাগেজ’ নয়। তাই সরাসরি আমেরিকান চাপই আমাদের সরকারের এক কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে আসছে। আবার রাতারাতি সরকার ভালো হয়ে যাবে, সব রেকর্ড ভালো করে ফেলবে- তা সম্ভবই নয়। বাইডেন হিউম্যান রাইট মেনে চলার জন্য সরকারকে চাপ দিলে সেটা স্থানীয় সাধারণ মানুষের একটা সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়াবে। ঠিক যে অর্থে হাসিনা সরকারের জনসমর্থন বা পাবলিক রেটিং প্রায় নেই বলে, বাইডেনের চাপের বিরুদ্ধে, ইন্টারভেনশনের বিরুদ্ধে জনমতকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হবে।
তবু ‘কী হতে যাচ্ছে’ তা নিয়ে এসব আসলে অনুমানের কথা। বাস্তবে কিভাবে ব্যাপারটা ঘটে, তা দেখতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু চ্যালেঞ্জটা বাস্তব!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com