চীনই হবে বাইডেনের প্রথম ইস্যু!
শি ও বাইডেন - ছবি সংগৃহীত
নব-নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন সম্ভাব্য কেমন হবে এই প্রশ্নটি এখন বেশ আলোচিত হচ্ছে।
প্রথমত এটা ট্রাম্পের হাতে গত চার বছরে যত ব্যত্যয় ঘটিয়েছিলেন তিনি, এর উল্টা যাত্রায় যতটা সম্ভব আগের ওবামা আমলের অভিমুখী হবেন। সাধারণভাবে যা ডেমোক্র্যাট আইডিয়াল অবস্থান মনে করা হয় তেমন অভিমুখে যাবে। তবে কিছু ক্ষেত্রে এটা আরো প্রো-পাবলিক হবে, সাধারণ জনমত যা আশা করে। যেমন- পরিবেশ ইস্যুতে ‘প্যারিস চুক্তিতে’ ফেরত যাওয়া আর হিউম্যান রাইটস ইস্যুতে অনেক কড়া অবস্থান নিয়ে আসছেন বাইডেন। তবে সব কিছুর ওপরে যা প্রধান দ্বন্দ্ব, যার নিরসন হবে মুখ্য ইস্যু- যা অনেকটা পরস্পর সংশ্লিষ্ট অনেকগুলো চাকার মধ্যে প্রথম যে চাকাটা ঘুরে বাকি সব চাকাকে ঘুরতে বাধ্য করে, এমন সেই ‘প্রাইম মুভার’ ইস্যু হলো চীনের সাথে ‘বাণিজ্য ইস্যু’ নিয়ে আলোচনা (যাকে গত চার বছর বাণিজ্যযুদ্ধ বলে ডাকা হয়েছে) তা শুরু করা। তাই ২০ জানুয়ারি বাইডেনের শপথ নেয়ার পরেই এক নম্বর প্রায়রিটি হবে এই ইস্যু।
অথচ ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের আমলেই তা তিন পর্বে মিটিয়ে ফেলার একটা পরিকল্পনা ছিল যার প্রথম পর্ব ট্রাম্পই আলোচনা ও ঐকমত্য শেষে স্বাক্ষরও সমাপ্ত করেছিলেন। কিন্তু আর অগ্রগতিতে না গিয়ে সব স্তব্ধ করে রেখেছিলেন। সেসবই এবার ফাংশনাল হতে শুরু করবে। এটাই হবে বাইডেনের প্রাইম মুভার ঘটনা। এ জন্য যে, ট্রাম্প বাণিজ্য আলোচনাকে বাণিজ্যযুদ্ধের জায়গায় নেয়াতেই আমেরিকার গ্লোবাল নেতৃত্ব যা গত ৭৫ বছর ধরে রাজত্ব করার শেষে এর পালাবদলটা মসৃণ হওয়ার বদলে তা যুদ্ধপরিস্থিতির দিকে দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে ঠেলে দেয়ার দিকে নিচ্ছিলেন ট্রাম্প। তা এখন অভিমুখ বদলাবে, এটাই দুনিয়াজুড়ে সবার আশা। এই অর্থে, বাইডেনের বিজয়ের প্রাথমিক খবর মানুষকে এক সম্ভাব্য গ্লোবাল যুদ্ধপরিস্থিতি এড়াতে এক মুক্তির সূচনা করল।
তাহলে এখন কী হতে পারে?
খুব সম্ভবত বাণিজ্য আলোচনায় আসলে যা হবে চীনের দিক থেকে দেখলে তাকে বলা যায়- এটা হবে, যত বেশি সম্ভব আমেরিকাকে বাজার ছাড় দিয়ে এর বিনিময়ে চীন নিজের গ্লোবাল নেতৃত্ব নেয়া- এই হস্তান্তর মসৃণ ও বাধাহীন করার নিশ্চয়তা ‘কিনে নেয়া’। বাণিজ্য আলোচনায় এই দেয়া-নেয়া সম্পন্ন হতে পারে। এটা আবার দুইভাবে ঘটতে পারে। এক, মুখে স্বীকার করে নিয়ে শুরু করা যে, আমরা পরস্পর এটাই বিনিময় করছি। অথবা তা হতে পারে মুখে স্বীকার না করে দুইপক্ষই মনে মনে এটা ধরে নিয়ে। তবে মুখে স্বীকার না করে নেয়ার কৌশলগত সুবিধা বেশি।
এভাবে বাণিজ্য আলোচনা নেগোসিয়েশনের আগের পথেই দ্বিতীয় পর্ব একটা চুক্তিতে পৌঁছালেই এরপর জো বাইডেন-শি জিনপিংয়ের যৌথ সামিট অনুষ্ঠিত হতে পারবে। আর দুইপক্ষের ওপরই দ্রুত এমনটা করার জন্য গ্লোবাল বাজারের চাপ থাকবে প্রচুর। কারণ করোনাকালে দ্বিতীয়বারের আক্রমণের ধাক্কাও আসন্ন। ফলে নিরন্তর মন্দা বাজারে ইতিবাচক মেসেজ পেতে সবাই আগ্রহী যাতে বাজার চাবুক খেয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
এতে বাজার ও ক্ষমতার করিডোরে কী মেসেজ যাবে?
সামগ্রিকভাবে মূল মেসেজটা হবে ইন্দো-প্যাসিফিক এবং কোয়াড উদ্যোগ ও স্ট্র্যাটেজিকে কেন্দ্র করে। ট্রাম্প মূলত মরিয়া হয়ে এটাকে একই সাথে সামরিক জোট ও বাণিজ্য জোট হিসেবে গড়ে তুলতে চাচ্ছিলেন। ট্রাম্প জানতেন এটা ৩ নভেম্বরের নির্বাচনের পরে অকেজো দিশেহারা স্থবির হয়ে যাবে, কারণ নির্বাচনে পরাজিত হয়ে গেলে তো এমনই দশা হওয়ার কথা।
চীনের সাথে বাণিজ্য আলোচনায় প্রথমপর্বের আলোচনার শেষে একবার ট্রাম্প ক্ষুব্ধ হয়ে এবং প্রকাশ্যে প্রেসের সামনে বলেছিলেন, চীন বাকি নেগোসিয়েশন আর করল না, আগালোও না- বাইডেনের ভরসায়। মানে নিজ ক্ষমতাসীন থাকার দু’বছরের মধ্যেই সে সময় ট্রাম্প বুঝাতে চেয়েছিলেন আগামীতে রিপাবলিকান প্রার্থী বাইডেন জিতে আসবে, এই ভরসায় আছে চীন। তারা তখন বেটার সুবিধা পাবে ও নেবে (ট্রাম্পের কাছে পাচ্ছে না) চিন্তা করে এখন ট্রাম্পের সাথে কম্প্রোমাইজ ডিলে যাচ্ছে না। তাই তিনি ওখানে ঘোষণা করেন, আগামীতে বাইডেনের ক্ষমতাসীন হওয়া বন্ধ করতে তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন। তাই ধীরে ধীরে চীনবিরোধী জোট- সেটা খাঁড়া করা খুবই কঠিন হলেও তিনি ইন্দো-প্যাসিফিক ও কোয়াড গড়ে এটাতে সামরিক জোট ও বাণিজ্য জোট এ দুই লক্ষ্য জুড়ে দিয়েছিলেন।
আর এখন ঠিক এ জায়গাটাতেই বাইডেন বদল ঘটাবেন। কৌশলগতভাবে ইন্দো-প্যাসিফিক ও কোয়াড উদ্যোগ ভেঙে না দিয়ে এটা কেবল বাণিজ্যের জোট এমন ধারণা সেট করে দেবেন। অর্থাৎ চীনের সাথে বাইডেন কী দেয়া-নেয়া করতে যাচ্ছেন বা করে ফেলবেন এর ছাপ-ইঙ্গিত তিনি এভাবে প্রকাশ করবেন।
স্বভাবতই, আড়াই লাখ আমেরিকানের কোভিড-১৯-এ মৃত্যু আর প্রায় ৯ কোটি বেকারের আমেরিকায় বাইডেনের চীনা ডিল বা সম্ভাব্য ‘দেয়া-নেয়া’ একটা ইতিবাচক আবহাওয়া তৈরি করবে। যেকোনো অর্থনীতিই বেকারত্ব ও মহামারী থেকে বের হয়ে আসতে চায়। কারণ ‘উহান ভাইরাস’ বলে ট্রাম্পের নিজের সব শোচনীয় ম্যানেজমেন্ট ব্যর্থতা চীনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া নির্বাচন পার হওয়ার জন্য হয়তো চলে। কিন্তু বাস্তবতা খুব কঠিন। তাই, না আমেরিকান অর্থনীতি না বেকার মানুষ এসব কথাকে এতদিন ইতিবাচক হিসেবে দেখেছে। অতএব, যদি এভাবেই আগানো হয় তবে বাইডেন-শি জিনপিংয়ের সামিট তখন আমেরিকায় এক শীতল-পরশের মতো ভূমিকা নিয়ে আসবে।