মহানবী সা:-এর সিরাত : ব্যবসা-বাণিজ্য
মহানবী সা:-এর সিরাত : ব্যবসা-বাণিজ্য - ছবি সংগৃহীত
যে জীবন মানুষকে অভিভূত করে; যে জীবন বিধাতার নিকট আত্মসমর্পণের একটি অলৌকিক পরিচয় বহন করে এবং যে জীবন সব মানবের কল্যাণে সর্বসময়ের জন্য নিয়োজিত, সেই জীবনের একটি মনোজ্ঞ আলেখ্য আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মদ সা:।
আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মদ সা: সম্পর্কে যে কয়টি গ্রন্থ বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছে, তার মধ্যে কবি গোলাম মোস্তফা রচিত ‘বিশ্বনবী’ অত্যন্ত সুপাঠ্য। বিশ্বনবী রচনার পর বহু বছর পরে সৈয়দ আলী আহসান ১৯৯৪ সালে ‘মহানবী’ নামে একটি গবেষণামূলক, তথ্যবহুল গ্রন্থ জাতিকে উপহার দেন। তাছাড়া মহানবী সা: উপর বিভিন্ন ভাষায় লিখিত অনেক গ্রন্থ বিভিন্ন গুণী ব্যক্তিগণ বাংলায় অনুবাদ করেছেন।
বিশ্বনবী গ্রন্থের ‘প্রতিশ্রুত পয়গম্বর’ শীর্ষক নিবন্ধে কবি গোলাম মোস্তফা উল্লেখ করেন-‘হজরত মুহাম্মদ সা: প্রতিশ্রুত পয়গম্বর অর্থাৎ আল্লাহ যে তাঁকে দুনিয়ায় পাঠাবেন, একথা পূর্বে নির্ধারিত হইয়াছিল। প্রত্যেক শিল্পই প্রথমে শিল্পীর ধ্যানে জন্ম লাভ করে, তার অনেক পরে বাহিরে প্রকাশ পায়। হজরত মুহাম্মদ সা: সম্পর্কে একথা সত্য। তিনি ছিলেন সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু। কাজেই তাঁর জ্যোতিমূর্তি আল্লাহর ধ্যানে প্রথমে সঞ্চারিত হইয়াছিল। এই জ্যোতিমূর্তিই নূরে মুহাম্মদি। সর্বপ্রথম তাই আল্লাহ সৃষ্টি করিয়াছিলেন মুহাম্মদ সা:-এর নূর। একটি হাদিসে তাই এসেছে- ‘আউওয়ালা মা খালাকাল্লাহু নুরী’। অর্থাৎ : (হজরত মুহাম্মদ সা: বলেছেন) সর্বপ্রথমেই আল্লাহ যা সৃষ্টি করেন তা আমার নূর। কাজেই, এ কথা অনায়াসে বলা যায় যে, হজরত মুহাম্মদ সা: তাঁর জন্মের অনেক আগেই জন্মিয়াছিলেন। সারা সৃষ্টি তাঁর নূরে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। চাঁদে চাঁদে, তারায় তারায়, গ্রহে গ্রহে, লোকে লোকে, তাঁর ধ্যান-মূর্তি তাঁর অস্পষ্ট ছায়া মিলিয়াছিল। বিশ্ব প্রকৃতির অন্তরজুড়ে তাই এক পরম কৌতূহল ও জিজ্ঞাসা জেগেছিল : কোথায় কবে কোনখানে কিভাবে নিখিলের সেই ধ্যানের ছবি বাইরে আত্মপ্রকাশ করবে।’
আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জন্ম ৫৭০ সালে। মা আমিনা তখন তার পিতৃব্যের গৃহে ছিলেন। যখন হজরতের পিতা আবদুল্লাহর বয়স মাত্র কুড়ি বছর তখন তাঁর সাথে বনি জোহরা গোত্রে আমিনার বিয়ে হয়। বিয়ের কিছুদিন পর বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আবদুল্লাহ সিরিয়া গমন করেন। প্রত্যাবর্তনের পথে মদিনায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। মদিনা শরিফে তার মৃত্যু হয়। এ সময় মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: মা আমিনার গর্ভে। মা হজরতের জন্মের শুভ সংবাদ তার দাদা মুত্তালিবের কাছে পাঠান। মুত্তালিব গৃহে এসে নবজাত শিশুকে বক্ষে ধারণ করে কাবাগ"হে আসেন এবং মহান প্রভুর কাছে নবজাতকের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। মহানবী মুহাম্মদ সা: জন্ম ৮ জুন, ৫৭০ সালে ১২ রবিউল আউয়াল, সোমবার। একই সাথে তাঁর নাম রাখা হয় মুহম্মদ এবং আহমদ। মুহম্মদ শব্দের অর্থ হলো ‘চরম প্রশংসিত’ এবং আহমদ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘চরম প্রশংসাকারী’। পবিত্র কুরআন পাকে উভয় নামের উল্লেখ রয়েছে। সূরা আল ফাতহের ২৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : ‘মুহাম্মদ হচ্ছেন আল্লাহর বাণীবাহক রাসূল এবং যারা তাঁর সাথে আছে তারা কাফির বা অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে শক্তিমান। বিশ্বাসীরা নিজেদের মধ্যে করুণাদ্রব এবং সহানুভূতিশীল।’ সূরা আল সাফের ৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন : ‘এবং স্মরণ করো, মরিয়ম তনয় ঈসাকে যিনি বলেছিলেন, হে বনি ইসরাইলগণ, আমি আল্লাহর রাসূল, আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে আমার পূর্বে যে সত্য প্রবর্তিত হয়েছিল তাকে সমর্থন করার জন্য এবং আমি শুভ সংবাদ দিতে এসেছি, আমার পরবর্তীতে যিনি আল্লাহর রাসূল হিসেবে আসবেন তার সম্পর্কে। তার নাম হবে ‘আহমদ’।
রাসূলে করিম সা: ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ করেন। হেরা গুহায় ধ্যানরত অবস্থায় হজরত জিব্রাইল আ:-এর আগমন। তিনি মুহাম্মদ সা:কে বললেন, ‘ইকরা’। মানে, পাঠ করুন। মুহাম্মদ সা: বললেন : ‘আমি পড়তে জানি না।’ ফেরেশতা পুনরায় তাঁকে বললেন : ‘পাঠ করো’। মুহাম্মদ সা: আবারো বললেন : ‘আমি পড়তে পারি না।’ জিব্রাইল আ: তখন মুহাম্মদ সা:কে আলিঙ্গন করলেন। এইভাবে তিনবার করার পর মুহাম্মদ সা: মুখ থেকে উচ্চারিত হলো : ‘ইকরা বিসমি রাব্বিকাল লাজি খালাক।
‘পাঠ করো তোমার সেই প্রভুর নামে- যিনি সমস্ত সৃষ্টি করিয়াছেন যিনি এক বিন্দু রক্ত থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, পাঠ করো- তোমার সেই মহিমাময় প্রভুর নামে, যিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন, যিনি মানুষকে অনুগ্রহ করে অজ্ঞাতপূর্ব জ্ঞান দান করেছেন।’ ‘মহান আল্লাহ তায়ালার বাণী যে ভাষায় এবং উচ্চারণে মহানবী মুহাম্মদ সা:-এর কাছে এসেছিল আজও তা একই ভাষায় একটি ভঙ্গিতে এবং সুষমায় বিদ্যমান রয়েছে। এর ফলে এর তাৎপর্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ইসলামের অলৌকিকতা এখানেই যে, কুরআন শরিফের বাণী সর্বকালের সব সময়ের জন্য আধুনিক, প্রাত্যহিক এবং প্রাসঙ্গিক। এই প্রাসঙ্গিকতাকে ব্যাখ্যা করে গিয়েছিলেন মহানবী তাঁর আচরণের দ্বারা, জীবন যাপন, কর্ম ব্যবস্থাপনা এবং সুচিন্তিত ও পরিশীলিত নির্দেশ দ্বারা। তাই তাঁর জীবন নিয়ে পৃথিবীতে আলোচনা হয়েছে, এখনো আলোচনা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। তাঁর জীবন কথা নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে, নানারূপ তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা হযেছে, ঐতিহাসিক সত্য নির্ধারণের চেষ্টা হয়েছে, বিশ্লেষণ হয়েছে এবং অভিভূত মানুষের বিনয়ের প্রকাশ ঘটেছে। এ ধারা কখনো শেষ হবে না। চলতে থাকবে যতদিন বিশ্ব থাকবে।
ব্যবসা-বাণিজ্য : মহানবী মুহাম্মদ সা: বিশাল জীবনের একটি ক্ষুদ্র বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করব ইনশা আল্লাহ; ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়। নবুয়তের আগে ও পরে রাসূল করিম সা:-এর ব্যবসায়িক কার্যক্রম কিরূপ ছিল, কিভাবে তিনি ব্যবসা বাণিজ্য করেছেন, কী কী নিয়মকে ব্যবসার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়েছেন, আল্লাহ পাক তার পবিত্র মহাগ্রন্থে ব্যবসা সম্পর্কে কী বলেছেন, আর রাসূলে করিম সা: ব্যবসা নিয়ে কী কী গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন তা নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা আজকের মূল বিষয়।
আবদুল মুত্তালিবের ধন সম্পদের পরিমাণ জীবনের শেষের দিকে কমতে থাকে। মুত্তালিব মৃত্যুকালে যে সম্পদ রেখে গিয়েছিলেন তা তেমন বেশি ছিল না। ছেলেদের মধ্যে সম্পদের বণ্টনের পর উল্লেখযোগ্য সম্পদ আবু তালিবের ভাগে ছিল না। বালক মুহাম্মদ সা:-এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পড়ে চাচা আবু তালিবের ওপর। তিনি পিতৃব্যের মেষ পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মক্কার নিকটবর্তী পাহাড়ের পাদদেশে মুহাম্মদ সা: ছাগল ও মেষ চড়াতেন। কখনো কখনো চাচা আবু তালেব তাকে নিয়ে দূর পথে যেতেন। যখন হজরতের বয়স মাত্র ৯ বছর তখন চাচা আবু তালেব তাকে নিয়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়া গমন করেন। এটাই রাসূল সা:-এর জীবনে প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। সিরিয়া ভ্রমণ রাসূল সা:-এর জীবনে অনেক বড় ঘটনা। বিচিত্র অভিজ্ঞতা জ্ঞান এবং সৃষ্টি সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য তার হৃদয়ে স্থান করে নেয়।
আবু তালেবের কাফেলা এক প্রসিদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্র বসরা নামক স্থানে তাঁবু খাটায়। ওই তাঁবুর কাছে ছিল খ্রিষ্টানদের একটি মঠ। ওই মঠে ‘বহিরা’ নামক একজন জ্ঞানী পাদ্রি ছিলেন। সেই পাদ্রি ইহুদি ধর্মগ্রন্থ ‘তাওরাত’ এবং খ্রিষ্টান ধর্মগ্রন্থ ‘ইঞ্জিল’ থেকে শেষ নবীর লক্ষণ ও পরিচয় সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞান রাখতেন। মঠের কিছু দূরে আবু তালেবের কাফেলা অবস্থান করছিল। পাদ্রি ‘বহিরা’ আধ্যাত্মিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ থাকার কারণে বুঝতে পারলেন আবু তালেবের বড় সফরসঙ্গী হিসেবে বালক মুহাম্মদ সা: সর্বশেষ নবী। তাই পাদ্রি আবু তালেবকে কসম দিয়ে বললেন, ‘এই বালককে যত সত্বর সম্ভব সাবধানে দেশে পৌঁছে দিতে যত্নবান হোন।’ আবু তালেব দ্রুত সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরলেন। বালক মুহাম্মদ সা:কে মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন। এটাই মুহাম্মদ সা:-এর প্রথম ব্যবসায়িক সফর, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান লাভ।
যৌবনে উপনীত হয়ে তিনি ব্যবসাকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। একজন ব্যবসায়ীর প্রধান গুণ হচ্ছে প্রতিশ্রুতি পূরণ করা এবং প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা। নবুয়ত প্রাপ্তির আগে একজন সৎ ব্যবসায়ী হিসেবে মহানবী সা: তাঁর সমকালের সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত ছিলেন। ব্যবসা ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে, আরব দেশেও ছিল। ব্যবসা ক্ষেত্রে তাঁর সাথে যাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল তারাও তার নানাবিধ সদগুণের প্রশংসা করেছেন। ব্যবসার ক্ষেত্রে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে হজরত মুহাম্মদ সা: যখন সবার কাছে শ্রদ্ধাভাজন এবং প্রিয় হয়েছিলেন তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর। আরব দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং জ্ঞান গরিমায় অনেক সময় রমণীরা পুরুষের সমান ছিলেন। এ রকম একজন রমণী ছিলেন বিবি খাদিজা। সে সময় চতুর্দিকে সততা ও বিশ্বস্ততার জন্য মুহাম্মদ সা:-এর খুব সুনাম ছিল। তিনি ছিলেন ‘আল আমিন’। বিবি খাদিজা সিরিয়ায় পণ্যসামগ্রী নিয়ে যাওয়ার জন্য মুহাম্মদ সা:কে নিযুক্ত করলেন। এভাবে রাসূলে করিম সা: নবুয়তপ্রাপ্তির আগে ব্যবসা সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
নবুয়ত লাভের পর মুহাম্মদ সা: পুরোদমে ইসলাম প্রচারে নিজকে নিয়োজিত করলেন। ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য তখন কতটুকু করেছেন তার বিবরণ আমাদের জানা নেই। তবে ইসলাম প্রচারের সর্বশক্তি নিয়োগের পর আল্লাহ পাকের নির্দেশে মদিনা রাষ্ট্র কায়েমের মাধ্যমে ইসলামের প্রথম ছোট্ট মডেল উপহার হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে রাখলেন। পবিত্র কুরআন পাকে ধীরে ধীরে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে জীবনের সব বিষয় আল্লাহ পাক রাসূলে করিম সা:-এর মাধ্যমে মানবজাতির জন্য শিক্ষণীয় করে প্রতিষ্ঠিত করলেন। পবিত্র কুরআনে ব্যবসা সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা ক্রয়-বিক্রয় ব্যবসা-বাণিজ্য হালাল করেছেন, কিন্তু সুদ ও সুদভিত্তিক যাবতীয় কারবার হারাম ঘোষণা করেছেন।’ (সূরা বাকারা)
অর্থ উপার্জনের মধ্যে সবচেয়ে সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য। অন্য সব উপায় অপেক্ষা ব্যবসা-বাণিজ্য শ্রেষ্ঠ। তাই পবিত্র কুরআন পাকে আল্লাহ পাক ব্যবসাকে অনেক অনেক উৎসাহ দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে : ‘নামাজ সমাপ্ত হওয়ার পর তোমরা পৃথিবীতে ইতস্তত ছড়াইয়া পড়ো; আল্লাহর অনুগ্রহ ধন সম্পদ অনুসন্ধান, আহরণ ও উপার্জন করো।’ আল্লাহ পাক নামাজ কায়েম করতে বলেছেন এবং নামাজ শেষে নিজের উপার্জনের জন্য কাজে ব্যস্ত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সম্পদ নিয়ে অনুসন্ধান, গবেষণা করতে বলেছেন। সম্পদ আহরণ করতে বলেছেন। সম্পদ উপার্জন করার তাগিদ দিয়েছেন। নামাজ পড়ে ঘরে বসে থাকতে বলেননি।
তাই সব নবী-রাসূল আল্লাহ তালার নির্দেশ অনুযায়ী উপার্জনের জন্য ব্যবসাকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আমাদের নবী নবুয়তের আগে থেকে ব্যবসায় জীবিকা উপার্জনের প্রধান বাহন হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহ পাকের নির্দেশ নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করে মানবজাতির জন্য আদর্শ রেখে গেছেন। আমাদের প্রিয় নবী করিম সা: মুসলমানদেন ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বিশেষ উৎসাহ দিয়েছেন এবং ইসলামী সত্যবাদী, বিশ্বস্ত ও ন্যায়পন্থী ব্যবসায়ীদের বিশেষ মর্যাদার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন : ‘সত্যবাদী, ন্যায়পন্থী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী আম্বিয়া, সিদ্দিক ও শহীদ প্রভৃতি মহান ব্যক্তির সমান মর্যাদায় অভিষিক্ত হইবেন।’ ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্যকে ‘অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ কাজ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থ উপার্জনের জন্য ব্যবসা অতি উত্তম ইবাদত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। একজন সত্যবাদী, ন্যায়পন্থী বিশ্বস্ত ও সৎ ব্যবসায়ীকে শহীদের, আম্বিয়া কিরাম এবং সিদ্দিকিদের কাতারে শামিল করেছে। এর চেয়ে বেশি মর্যাদার আর কী হতে পারে? কিন্তু আমাদের সমাজে, মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ব্যবসায়ীদের কী নমুনা আমরা দেখতে পাচ্ছি? আমাদের নবী, অন্যান্য নবী, আম্বিয়াকিরাম ব্যবসার কী দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, তা কি আমরা একবারো ভেবে দেখছি।
ব্যবসার সব চেয়ে উত্তম বিষয় হচ্ছে প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করা। সততার সাথে ব্যবসা করা। সময়, কাজ, ঠিকমতো করা। তাই আধুনিক ব্যবসায় আর্থিক সরাসরি লেনদেন ছাড়াও চুক্তিপত্রের মাধ্যমে তথা এলসির মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে। নবীজীর সময় বা নবুয়তের আগে এলসি না থাকলেও তাদের মুখের কথাও জবানই ছিল এলসি থেকে উত্তম। একজন ব্যবসায়ীর প্রধান গুণ হচ্ছে প্রতিশ্রুতি পূরণ করা এবং প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা। নবুয়তপ্রাপ্তির আগে একজন সৎ ব্যবসায়ী হিসেবে মহানবী সা: তাঁর সময়কালের এক সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত ছিলেন। তিনি অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে তাঁর কর্তব্য সম্পাদন করতেন। মানুষ তাঁর ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করতে পারত। হাদিস আবু দাউদে বর্ণিত আছে, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই আল হামসা রাসূল সা:-এর নবুয়ত প্রাপ্তির আগে তাঁর ব্যবসা সংক্রান্ত কিছু কাজ করছিলেন। দানের কিছু অংশ দেয়া হয়েছিল এবং কিছু অংশ বাকি ছিল। ইবনে উবাই রাসূল সা:কে বললেন, ‘আপনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন বাকি টাকা পরে নিয়ে আসছি। ঘটনাচক্রে ইবনে উবাই এ প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে যান। তিন দিনের দিন হঠাৎ সব ঘটনা তার মনে পড়ল এবং তিনি বাকি টাকা নিয়ে প্রতিশ্রুত স্থানে উপস্থিত হয়ে রাসূলে সা: পাককে সেখানে দেখতে পেলেন।
ইবনে উবাই রাসূলের সা: মধ্যে কোনো বিরক্তির ভাব দেখলেন না। তিনি শুধু বললেন, ‘তুমি আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছ, আজ তিন দিন যাবত আমি এখানে তোমার অপেক্ষায় বসে আছি। দেখুন, কেমন নমুনা মহানবী সা: আমাদের জন্য ব্যবসার ক্ষেত্রে স্থাপন করে অনুকরণের জন্য রেখে গেছেন। আমরা কি তা করছি! আমরা কি মহানবীর ব্যবসার শিক্ষা থেকে জীবনে শিক্ষা গ্রহণ করছি? কেউ কেউ, কিছু কিছু করছি। কিন্তু সব ব্যবসায়ী তা করছি না। এটি অন্যায়। এই অভ্যাস আমাদের আগে করতে হবে। কুরআন ও হাদিসের আলোকে ব্যবসায়ী হিসেবে নাজাত পেতে হলে উল্লিখিত চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। তবেই মুক্তি মিলবে।
সুদ ও ব্যবসা : স্যার জেমস স্টুয়ার্টের মতে, অর্থনীতি এমন এক শাস্ত্র যা এক ব্যক্তি সমাজের একজন হওয়ার দিক দিয়ে কিরূপ দূরদৃষ্টি ও মিতব্যয়িতার সাথে নিজ ঘরের যাবতীয় প্রয়োজন পূর্ণ করতে পারে তা আমাদেরকে বলে দেয়। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মার্শাল বলেন, অর্থনীতি মানুষের জীবনের সাধারণ কার্যাবলির পর্যালোচনা মাত্র। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কেয়ার্নক্রমের মতে, সমাজের সাধারণ মানুষের সর্ববিধ প্রয়োজন অনুসারে পণ্যের উৎপাদন, উৎপন্ন পণ্যের সুবিচারপূর্ণ বণ্টন এবং উৎপাদনের উপায় ও এর সঠিক বণ্টনের ন্যায়নীতি সম্পন্ন প্রণালী নির্ধারণ করাই হচ্ছে অর্থনীতির কাজ। ইসলামী অর্থনীতির সংজ্ঞা এ সব থেকে ভিন্ন। মাওলানা হিফজুর রহমান র. বলেন, শরিয়তের পরিভাষায় যে বিদ্যা বা জ্ঞানের মাধ্যমে এমন সব উপায় সম্বন্ধে জ্ঞাত হওয়া যায় যার দ্বারা ধন সম্পদ আহরণ ও ব্যয়ের উপযুক্ত ও সঠিক পন্থা এবং বিনষ্ট হওয়ার প্রকৃত কারণ নির্দেশ করা হয়, তাকে ইসলামী অর্থনীতি বলা হয়। সূরা বাকারায় আল্লাহ বলছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা ক্রয়-বিক্রয় ব্যবসা-বাণিজ্য হালাল করেছেন কিন্তু সুদ ও সুদভিত্তিক যাবতীয় কারবার হারাম ঘোষণা করেছেন।
আল্লাহ পাক অন্যত্র বলেন, ‘মুসলমানগণ, তোমরা অন্যায়ভাবে অসদুপায়ে পরস্পরের ধন সম্পদ ভক্ষণ করিও না। তোমাদের পারস্পরিক সম্মতিক্রমে ব্যবসা-বাণিজ্যের মারফতই অর্থের আদান-প্রদান করো।’
মহানবী সা: সুদ সম্পর্কে যে পবিত্র হাদিস বর্ণনা করেছেন, তা হচ্ছে- ‘হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: সুদদাতা, সুদগ্রহীতা, সুদের চুক্তিপত্রের লেখক ও সাক্ষী সবার ওপর অভিসম্পাত করেছেন এবং বলেছেন, এরা সকলে সমান অধিকারী।’ (সহিহ বুখারি) ইসলাম সুদকে নিষিদ্ধ করেছে ঠিক, কিন্তু এর বিকল্প ব্যবস্থার বিধানও দিয়েছে। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে সুদমুক্ত হালাল উপার্জনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালা সব ধরনের অবৈধ উপায়ে উপার্জনের পথ পরিহারের নির্দেশ দিয়েছেন।
হজরত আবু সাঈদ খুদরি রা: থেকে বর্ণিত, একবার হজরত বেলাল রা: নবী করিম সা:-এর কাছে ‘বর্নি’ (এক ধরনের) খুর্মা নিয়ে এলেন। নবী করিম সা: জিজ্ঞেস করলেন, এ ধরনের খুর্মা তুমি কোথায় থেকে পেলে? তিনি বললেন, আমার কাছে দুই সা (প্রায় আট কেজি) মন্দ খেজুর ছিল, আমি তা এই এক সা (প্রায় চার কেজি) খেজুরের বিনিময়ে বিক্রি করেছি। এটা শুনে রাসূলে করিম সা: (একাধিকবার) বললেন, আহ! এতে সুদি লেনদেন হয়েছে। আহ! এত সুদি লেনদেন হয়েছে। এমন লেনদেন আর করো না। অধিক মন্দ খেজুর টাকার বিনিময়ে বিক্রি করবে, তারপর সে টাকায় উত্তম খেজুর ক্রয় করবে। (বুখারি, মুসলিম) এখানে মহানবী সা: সুদি লেনদেনকে চিহ্নিত করে হালাল লেনদেনে রূপান্তরের পদ্ধতি সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন।
ইসলামের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে কুরআন পাকের পরে রাসূল সা: কর্তৃক নানা হাদিস বিশদ বর্ণনা করা হয়েছে। নবুয়তের আগে ও পরে মহানবী নিজ জীবনের কর্মকাণ্ড দিয়ে দেখিয়েছেন কিভাবে লেনদেন করতে হবে, কিভাবে পণ্য বিনিময় করতে হবে, কিভাবে বান্দার হক যথাযথভাবে আদায় করতে হবে। মদিনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মহানবী সা: ব্যবসা-বাণিজ্যের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ সারা বিশ্বের মানুষের জন্য স্থাপন করে গেছেন। তা আজো আমাদের সবার জন্য শিক্ষণীয়ও অনুকরণীয়। ধন সম্পদ সঞ্চিত করে রাখা এবং অধিক জনকল্যাণের কাজে এটা নিয়োগ না করা ইসলামী অর্থনীতির দৃষ্টিতে মারাত্মক অপরাধ। ইসলামী সমাজের অর্থ সম্পদ কোনোক্রমেই এক হস্তে বা একটি গোষ্ঠীর মুষ্টিতে পুঞ্জীভূত হতে ও অব্যবস্থায় পড়ে থাকতে পারে না। এমন কি, কোনো ইয়াতিম শিশুরও কোনো নগদ অর্থ থাকলে তাও যেকোনো লাভজনক কাজে বিনিয়োগ করতে হবে। এই ক্ষেত্রে নবী করিম সা: ইরশাদ করেছেন- ‘সাবধান, তোমাদের কেউ ইয়াতিমের সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণকারী নিযুক্ত হলে এবং তাদের নগদ অর্থ থাকলে তা অবশ্যই ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করবে। তাহা অকাজে ফেলে রাখবে না। বাৎসরিক জাকাত অকাজে ফেলে রাখবে না। অন্যথায় বাৎসরিক জাকাত ও সাদকাহ মূলধন নিঃশেষ করে ফেলবে।’
পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে চূড়ান্তভাবে ঘোষণা করা হয়েছে : ‘ইসলামী সমাজের ধন সম্পদ যেন কেবল ধনীদের মধ্যেই কুক্ষিগত ও পুঞ্জীভূত হয়ে থাকতে না পারে।’
লেখক : গবেষক, শিক্ষানুরাগী, সম্পাদক ও শিল্প উদ্যোক্তা
E-mail-aqhaider@youthgroupbd.com