গিলগিট-বালটিস্তানের বিস্মৃত ইতিহাস

হামিদ মীর | Nov 13, 2020 07:59 pm
গিলগিট-বালটিস্তানের বিস্মৃত ইতিহাস

গিলগিট-বালটিস্তানের বিস্মৃত ইতিহাস - ছবি : সংগৃহীত

 

এটা ছিল এক বিশাল বড় বিস্ফোরণ। তবে এ বিস্ফোরণের তীব্রতা শুধু আজাদ কাশ্মির ও অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরে অনুভব করা গেছে। ইসলামাবাদে এই বিস্ফোরণ নিয়ে কিছু হইচই হয়েছে, কিন্তু ক্ষমতার প্রাসাদ ওই হইচইয়ের প্রতি কেউ কোনো মনোযোগ দেয়নি। এ বিস্ফোরণ ঘটেছে পয়লা নভেম্বর গিলগিটে। ঘটনা হচ্ছে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান গিলগিট বালটিস্তানকে পাকিস্তানের নতুন প্রদেশ বানানোর ঘোষণা দিয়েছেন। ওই ঘোষণায় গিলগিট বালটিস্তানের জনগণের বড় একটি অংশ খুশি, কিন্তু কাশ্মিরের দুই প্রান্তে মাতম শুরু হয়ে গেছে।

পয়লা নভেম্বর ছিল রোববার। ইসলামাবাদের একটি হোটেলে জম্মু-কাশ্মির লিবারেশন ফ্রন্ট গিলগিট বালটিস্তানের সমস্যা নিয়ে একটি সর্বদলীয় কনফারেন্সের আয়োজন করেছিল। ওই কনফারেন্সে তেহরিকে ইনসাফসহ পাকিস্তান ও আজাদ কাশ্মিরের শীর্ষস্থানীয় সব রাজনৈতিক দলসহ অল পার্টিস হুররিয়াত কনফারেন্সের একটি প্রতিনিধিদলও অংশগ্রহণ করেছিল। ওই কনফারেন্সে অংশগ্রহণকারীদের আজাদ কাশ্মিরের প্রধানমন্ত্রী রাজা ফারুক হায়দার বলেন, ইমরান খান গিলগিট বালটিস্তানকে পাকিস্তানের নতুন প্রদেশ বানানোর ঘোষণা দিয়েছেন। সর্বপ্রথম হুররিয়াত কনফারেন্সের আবদুল্লাহ গিলানি, ইউসুফ নাসিম, মাহমুদ সাগির, আবদুল মতিন ও হাসানুল বান্না এই ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এরপর ইমরান খানের ঘোষণার বিরুদ্ধে যৌথ প্রস্তাব গৃহীত হলে তাকে সমর্থনকারীদের মধ্যে মুসলিম লিগ (এন) ও পিপলস পার্টি আজাদ কাশ্মিরও শামিল ছিল। একটু ভাবুন, মুসলিম লিগ (এন) তাদের শাসনামলে সারতাজ আজিজের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেছিল, যাতে গিলগিট বালটিস্তানের সাংবিধানিক মর্যাদা চিহ্নিত করা যায়।

ওই কমিটি সুপারিশ করেছিল, পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মোতাবেক গিলগিট বালটিস্তানকে সাময়িকভাবে প্রদেশের মর্যাদা দেয়া হোক। এ ছাড়াও ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ও সিনেটে এই নতুন প্রদেশকে তিনটি আসন দেয়া হোক। সারতাজ আজিজ কমিটির সুপারিশ প্রকাশ পেলে হুররিয়াত কনফারেন্সের শীর্ষস্থানীয় নেতা সাইয়েদ আলী গিলানি, মীর ওয়ায়েজ উমর ফারুক ও ইয়াসিন মালিক পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে পত্র লিখেছিলেন, গিলগিট বালটিস্তানকে প্রদেশ বানানোর দ্বারা জাতিসঙ্ঘে জম্মু-কাশ্মির রাজ্যের মামলাটি দুর্বল হয়ে যাবে। কেননা পাকিস্তান প্রথম দিন থেকে জাতিসঙ্ঘে বলে আসছে, গিলগিট বালটিস্তান মূলত জম্মু-কাশ্মির রাজ্যের অংশ। হুররিয়াত কনফারেন্সের এই বিরোধিতায় নওয়াজ শরিফ থেমে যান। ২০১৮ সালের নির্বাচন এলে পিপলস পার্টি তাদের ইশতেহারে এ ওয়াদা যুক্ত করে, গিলগিট বালটিস্তানকে প্রদেশের মর্যাদা দেয়া হবে। এক দিকে মুসলিম লিগ (এন) ও পিপলস পার্টি গিলগিট বালটিস্তানের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে পৃথক প্রদেশের সমর্থন করছে, অপর দিকে জেকেএলএফের কনফারেন্সে ওই দু’টি দল পৃথক প্রদেশের বিরোধিতা করছে।

সত্য সর্বদাই তেতো হয়। সত্য হচ্ছে, ১৯৪৭ সালে গিলগিট বালটিস্তানে যুক্ত এলাকা জম্মু-কাশ্মির রাজ্যের অংশ ছিল। আর এ জন্যই ১৬ জানুয়ারি, ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাফরুল্লøাহ খান জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের ২২৮তম অধিবেশনে বলেন, গিলগিট বালটিস্তান মূলত জম্মু-কাশ্মির রাজ্যের অংশ। এটাও এক সত্য যে, পয়লা নভেম্বর, ১৯৪৭ সালে গিলগিট বালটিস্তানে স্কাউটসের অন্যতম অফিসার মেজর ব্রাউন ডোগরা সরকারের নিয়োগকৃত গভর্নর ঘানসারা সিংয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং এরপর জম্মু-কাশ্মির শিখ ইনফ্যানট্রির ক্যাপ্টেন মির্জা হাসান খান ওই বিদ্রোহে শরিক হয়ে ঘানসারা সিংকে গ্রেফতার করেন। ক্যাপ্টেন মির্জা হাসান খান ১৯৪৮ সালে কাশ্মিরের স্বাধীনতার যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং পাকিস্তান আর্মিতে কর্নেল পদে উন্নতি লাভ করেন। তিনি আজো গিলগিট বালটিস্তানে একজন হিরোর মর্যাদায় সমাসীন হয়ে আছেন। তাকে গিলগিটের চিনার বাগে দাফন করা হয়েছে। এই হিরোকে ১৯৫১ সালে ফয়েজ আহমদ ফয়েজ ও আরেক সঙ্গীসহ রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার করা হয়। এ অভিযোগ আরোপ করা হয় যে, এই সেনা কর্মকর্তা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের কাশ্মির নীতিতে আস্থাশীল ছিলেন না। আর মেজর জেনারেল আকবর খানের সাথে যোগসাজশে কাশ্মিরের স্বাধীনতার পরিকল্পনা তৈরি করছিলেন। তিনি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য লিয়াকত আলী খানকে সরাতে চাচ্ছিলেন।’

আরজ করতে চাই, গিলগিট বালটিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের হিরো, কাশ্মিরিদেরও হিরো। তবে আফসোস, পাকিস্তান গঠনের পর আজাদ কাশ্মির ও গিলগিট বালটিস্তানের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করা হয়েছে। ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করা হয়েছে। এক দিকে জাতিসঙ্ঘে গিলগিট বালটিস্তানকে জম্মু-কাশ্মির রাজ্যের অংশ অভিহিত করা হয়েছে, অপর দিকে ১৯৪৯ সালে লিয়াকত আলী খান আজাদ কাশ্মিরের প্রেসিডেন্ট সরদার ইবরাহিম খানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তার সাথে ‘করাচি চুক্তি’ করেন, যার অধীনে গিলগিট বালটিস্তানের শাসনভার পাকিস্তান সরকার নিয়ে নেয়। এই চুক্তিতে মুসলিম কনফারেন্সের প্রধান চৌধুরী গোলাম আব্বাসও স্বাক্ষর করেন। এই সত্যকেও অস্বীকার করা সম্ভব নয় যে, গিলগিট বালটিস্তানকে আজাদ কাশ্মির থেকে ছিনিয়ে নেয়ার পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় দফতরগুলো তাকে উত্তরাঞ্চলীয় জাত বলে অভিহিত করে স্থানীয় জনগণের সাথে গোলামের মতো আচরণ শুরু করে দিয়েছে। প্রথম দিকে স্থানীয় জনগণ তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে আজাদ কাশ্মিরের নেতাদের কাছে যেত এবং মুসলিম কনফারেন্স গিলগিট বালটিস্তানের জনগণের জন্য সোচ্চারও হয়েছিল। কিন্তু মুসলিম কনফারেন্সের স্থানীয় নেতা পীরজাদা মুহাম্মদ আলমকে গ্রেফতার করা হয়।

এরপর ১৯৭০ সালের নির্বাচন এলো। জেকেএলএফের নেতারা গিলগিট বালটিস্তান সপ্তাহ পালন করেন এবং দাবি করেন, আজাদ কাশ্মিরের মতো গিলগিট বালটিস্তানেও নির্বাচন দেয়া হোক। জেকেএলএফের চেয়ারম্যান মরহুম আমানুল্লাহ খান তার আত্মজীবনী ‘জুহদে মুসালসাল’ (দ্বিতীয় খণ্ড) গ্রন্থে লিখেছেন, ২৭ নভেম্বর, ১৯৭০ সালে আমরা গিলগিটে এক সভায় বক্তৃতার জন্য পৌঁছলে আমাকেসহ মকবুল বাট শহিদ, মেহের আবদুল মান্নান, পীরজাদা গোলাম মুস্তফা এবং জি এম মীরকে গ্রেফতার করা হয়; তা ছাড়া বিদ্রোহের মামলা দেয়া হয়। আফসোস, গিলগিট বালটিস্তানের নতুন বংশধারাকে এটা বলা হয়নি যে, কাশ্মিরের শহিদ মকবুল বাট তাদের অধিকারের জন্য সোচ্চার অবস্থায় ১৯৭০ সালে গিলগিটে গ্রেফতার হয়েছিলেন। গিলগিট বালটিস্তানের জনগণও পাকিস্তানকে ভালোবাসে এবং জম্মু-কাশ্মিরের জনগণও পাকিস্তানকে ভালোবাসে। কিন্তু এ কেমন নিষ্ঠুর রসিকতা, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী উভয়কে একে অন্যের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

আফসোস হচ্ছে, এই কর্মকাণ্ডে শুধু ইমরান খান নন, বরং মুসলিম লিগ (এন) ও পিপলস পার্টির নেতারাও সমানভাবে জড়িত। কাশ্মিরিরা নিজেরা গিলগিট বালটিস্তানকে সাংবিধানিক অধিকার দেয়ার জন্য সর্বপ্রথম আওয়াজ তুলেছিল। কিন্তু হায়, যদি এ কাজ এভাবে হতো যে, কাশ্মিরি নেতারা আজ পৃথক প্রদেশকে প্রত্যাখ্যান না করত। এটা তো ভাবা হয়নি যে, পাকিস্তানের সংবিধানের ২৫৭ ধারায় যে জম্মু-কাশ্মির রাজ্যের কথা উল্লেখ রয়েছে, সেই রাজ্যের ভবিষ্যৎ কী হবে? এটাও ভাবা হয়নি যে, আজাদ কাশ্মিরের সুপ্রিম কোর্ট গিলগিট বালটিস্তানকে তাদের রাজ্যের অংশ আখ্যায়িত এবং আজাদ কাশ্মির অ্যাসেম্বলি প্রস্তাবাবলির মাধ্যমে তাকে নিজেদের এলাকা হিসেবে অভিহিত করেছেন। এগুলো কেন হলো এবং এ বিষয়ে কিভাবে মীমাংসা হবে? কিছুদিন আগে পাকিস্তানের সরকার ও বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও সেনা নেতাদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, গিলগিট বালটিস্তানকে প্রদেশ বানানোর সিদ্ধান্ত ১৫ নভেম্বরের নির্বাচনের পরে হবে এবং সব শক্তিধর ব্যক্তিকে আস্থায় নেয়া হবে। কিন্তু ইমরান খান নির্বাচনে জেতার জন্য পয়লা নভেম্বর সে কথা ঘোষণা করে দিয়েছেন, যার কৃতিত্ব নিতে চেয়েছিল মুসলিম লিগ (এন) এবং পিপলস পার্টিও।

যদি প্রদেশ বানিয়ে দেয়ার দ্বারা অধিকার পাওয়া যায়, তাহলে আজ বেলুচিস্তানের জনগণ আন্দোলন করত না। রাজনৈতিক স্বার্থপূজা ও অপরিণামদর্শিতায় তেহরিকে ইনসাফ, মুসলিম লিগ (এন) ও পিপলস পার্টির মধ্যে কোনো পার্থক্য অবশিষ্ট নেই। তাদের মতো বন্ধু থাকলে কাশ্মিরিদের আর কোনো শত্র“ প্রয়োজন নেই। দৈনিক জং ০৫ নভেম্বর, ২০২০ থেকে ভাষান্তর-

ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com

লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট, প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us