সীমান্ত নিয়ে লড়াই : চীন-ভারত নতুন দ্বন্দ্ব?
সীমান্ত নিয়ে লড়াই : চীন-ভারত নতুন দ্বন্দ্ব? - ছবি : সংগৃহীত
চীন ও ভারতের সৈন্যদের মধ্যে ছয় মাস ধরে পাহাড়ি সীমান্তে অচলাবস্থার মধ্যে এবার দুই প্রতিবেশীর মধ্যে নতুন ধরনের মতানৈক্য আত্মপ্রকাশ করেছে। আর তা হলো অচলাবস্থা নিরসনে দাবিকৃত প্রস্তাব নিয়ে।
সরকারের সিনিয়র সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে ভারতীয় মিডিয়া বুধবার জানায় যে দুই দেশ তাদের মধ্যকার ৩,৮৮৮ কিলোমিটার অচিহ্তি সীমান্ত এলাকায় বিরাজমান অচলাবস্থা নিরসন এবং লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি) থেকে সৈন্য, ট্যাঙ্ক ও আর্টিলারি প্রত্যাহারে একমত হয়েছে। সীমান্ত সঙ্কট নিরসনে দুই দেশের সামরিক বাহিনীর সিনিয়র কমান্ডারদের মধ্যে অষ্টম রাউন্ডের বৈঠকের কয়েক দিনের মধ্যে এ খবর প্রকাশিত হয়।
অবশ্য বৃহস্পতিবার চীনের রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত জাতীয়তাবাদী ট্যাবলয়েড গ্লোবাল টাইমসে চীনা সরকারের সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে ওইসব প্রতিবেদনকে ভুয়া হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে দাবি করে যে এগুলো সঠিক নয় এবং এসব প্রতিবেদন দুই পক্ষের প্রতিষ্ঠিত লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক নয়।
গ্লোবাল টাইমস আরো জানায়, এলএসি নিয়ে ভারতের আইডিয়াগুলো অবাস্তব। এসব প্রতিবেদন বর্তমান সঙ্কট নিয়ে নয়া দিল্লি ও বেইজিংয়ের মধ্যকার গভীর বিভাজনই প্রতিফলিত করছে। সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ইনস্টিটিউটের গবেষণা বিভাগের পরিচালক কিয়াও ফেঙের উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রিকাটিতে বলা হয়, ভারতীয় মিডিয়ায় ওই খবর প্রকাশের কারণ হলো চীনকে চাপে রাখা এবং সেইসাথে শনিবারের হিন্দু উৎসব দিওয়ালির আগ দিয়ে ভারতীয়দের ওপর থেকে চাপ কমানো।
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের দৈনিক প্রেস ব্রিফিংয়ে কোনো সরকারি ভাষ্য প্রদান করেনি। বৃহস্পতিবার ভারতে নিযুক্ত রাশিয়ার ডেপুটি চিফ অব মিশন রোমান বাবুশকিন বলেন, চীন ও ভারতের মধ্যকার উত্তেজনায় মস্কো স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন। তিনি গঠনমূলক সংলাপে নিয়োজিত হওয়ার জন্য দুই দেশকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন যে অন্যান্য খেলোয়াড় এই উত্তেজনার অপব্যবহার করতে পারে।
সামরিক বাহিনী ও সরকারি সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে ভারতীয় খবরে বলা হয়, পূর্ব লাদাখের প্যাঙগঙ সো লেকের উত্তর ও দক্ষিণ তীরের অগ্রবর্তী অবস্থানগুলো থেকে সৈন্য, আর্টিলারি ও আগ্নেয়াস্ত্র সাময়িকভাবে প্রত্যাহারের মাধ্যমে অচলাবস্থার নিরসনে চীনা প্রস্তাব বিবেচনা করছে ভারতীয় সেনাবাহিনী।
লেকটিকে ঘিরে থাকা অঞ্চল দুই দেশের মধ্রকার সবচেয়ে সক্রিয় ফ্রিকশন পয়েন্টে পরিণত হয়েছে। সৈন্যরা প্রতিনিয়তই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে, এমনকি সতর্কতামূলক গুলিও করছে। খবরে প্রকাশ, এখানে ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য আর্টিলারি পরস্পর থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরে রয়েছে। আর সৈন্যরা একেবারে চোখাচোখি অবস্থানে রয়েছে।
মে মাসের প্রথম দিকে প্যাঙসং লেক এলাকায় দুই দেশের সৈন্যদের মধ্যে সঙ্ঘর্ষের পর বিরোধ শুরু হয়। দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ প্রায়ই দেখা গেলেও এবারের বিরোধ অনেক বেশি দিন স্থায়ী হচ্ছে। দুই পক্ষের মধ্যে কূটনৈতিক ও সামরিক পর্যায়ে ২০ দফা আলোচনা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো সমাধান দেখা যাচ্ছে না।
যোগাযোগ করা হলে ভারতী সেনাবাহিনী ও নয়া দিল্লির চীনা দূতাবাস উভয়েই এ ব্যাপারে কোনো ধরনের মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায়। অবশ্য ভারতীয় খবরে বলা হয়, দুই পক্ষ লেকের উত্তর তীরে ফিঙ্গারগুলোতে টহলহীন জোন সৃষ্টির ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। এই এলাকায় ছড়িয়ে থাকা আঙুল সদৃশ টিলাগুলো নিয়েই দুই দেশের মধ্যে মূল বিরোধ। ভারত দাবি করছে যে ফিঙ্গার ১ থেকে ৮ তার এলাকার মধ্যে পড়েছে। আর চীন বলছে, ৪ থেকে ৮ নম্বর পর্যন্ত ফিঙ্গারের মধ্যবর্তী এলাকা তাদের।
বর্তমান অচলাবস্থায় ফিঙ্গার ৮-এ সাধারণভাবে অবস্থান গ্রহণ করা চীনা বাহিনী ফিঙ্গার ৪ থেকে শুরু হওয়া এলাকা দখল করে নিয়ে ভারতীয় সৈন্যদেরকে ফিঙ্গার ৩-এ ঠেলে দেয়। বর্তমান প্রস্তাব অনুযায়ী, উভয় পক্ষ ফিঙ্গার ৪ থেকে ফিঙ্গার ৮ পর্যন্ত এলাকা খালি করে দেবে এবং কোনো পক্ষই বিরোধপূর্ণ এলাকায় টহল দেবে না।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর নর্দার্ন কমান্ডের সাবেক কমান্ডার ও ২০১২-২০১৬ পর্যন্ত এই এলাকায় দায়িত্ব পালনকারী লে. জেনারেল ডি এস হুদা বলেন, এ ধরনের প্রস্তাব উভয়পক্ষের জন্যই কল্যাণকর হতে পারে।
তবে কেউ কেউ মনে করেন, এই প্রস্তাবটি মেনে নেয়া হলে ভারতের টহল এলাকা কমে যাবে। ভারতীয় কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে বারবার বলছেন যে নয়া দিল্লি অচলাবস্থা সৃষ্টির আগেকার অবস্থানে উভয়পক্ষকে ফিরে যাওয়ার ওপর জোর দিচ্ছে।
ভারতীয় নৌবাহিনীর সাবেক কমোডর এবং বর্তমান নয়া দিল্লিভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সোসাইটি ফর পলিসি স্টাডিজের পরিচালক সি উদয় ভাস্কর বলেছেন, উভয়পক্ষ আলোচনা করছে, মধ্যবর্তী অবস্থান গ্রহণ করতে চাচ্ছে, এটা ভালো বিষয়। তবে চীনারা দুই পা এগিয়ে এক পা পিছিয়ে যাবে, এমনটা হওয়া ঠিক নয়।
ভারতীয় মিডিয়ার খবরে আরো বলা হয়, দুই পক্ষ প্যাংগঙ লেকের দক্ষিণ দিক থেকে বাহিনী প্রত্যাহার করার প্রস্তাবও বিবেচনা করছে। ভারতীয় বাহিনী ২৯ আগস্ট এখানকার স্ট্র্যাটেজিক হাইটসগুলো দখল করে।
এসব প্রস্তাব সত্য হলে এর মানে হবে, উভয় পক্ষই তাদের অগ্রবর্তী অবস্থানগুলো থেকে সরে আসবে, ভারতীয় বাহিনীকে এসব হাইটস ত্যাগ করতে হবে। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সূত্রগুলো জানাচ্ছে, সতর্কভাবে আলোচনা না চালালে এসব হাইটস দখল করার মাধ্যমে ভারতীয় সৈন্যরা যে কৌশলগত সুবিধা অর্জন করেছে, তা খোয়াবে।
তবে হুদা বলেন, এ ধরনের আপস খারাপ হবে না। কারণ এসব হাইটস থেকে সরে আসার বিনিময়ে ভারতীয় বাহিনী ফিঙ্গার ৮-এর পেছনে চলে যাবে।
তবে উভয়পক্ষের জন্যই সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। লাদাখ অঞ্চলে এর মধ্যেই শীতল হাওয়া বইতে শুরু করেছে। এখানকার তাপমাত্রা প্রায়ই মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে পুরোপুরি কার্যকর লজিস্টিক চেইন বহাল রাখার জন্য উভয় দেশের জন্যই সমস্যা হচ্ছে।
হুদা বলেন, সময় যত যাবে, পরিস্থিতি ততই খারাপ হবে।
তিনি বলেন, ডিসেম্বর বা এরপর সৈন্য প্রত্যাহার করা খুবই কঠিন হবে। কারণ বরফে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে, অগ্রবর্তী অবস্থানগুলোর সাথে কানেকটিভিটি ছিন্ন হয়ে যাবে।
সূত্র : এসসিএমপি