আব্বাস সিদ্দিকিদের সমীকরণ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে
আব্বাস সিদ্দিকিদের সমীকরণ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে - ছবি সংগৃহীত
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে অল ইন্ডিয়া মসলিস-ই-ইত্তেহাদ-উল-মুসলিমিনের (আইমিম) চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সামনে। মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য অনেক বড় দুঃস্বপ্ন হলো দক্ষিণ বাংলার আলেম, ত্রিশোর্ধ আব্বাস সিদ্দিকি। সোশাল মিডিয়ায় সিদ্দিকির তৎপরতা যথেষ্ট জোরালো, এবং তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে, ২০২১ সালের নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, দক্ষিণ বাংলায় একটি জনসভায় তিনি বলছেন, “৪৪টি আসনে আমরা প্রার্থী দেবো এবং অন্যদের সাথে সমন্বয় করবো”। আর জনসভার পর জনসভায় হাজার হাজার মুসলিম যুবকের সামনে সিদ্দিকি মুসলিমদের সামাজিক ক্ষমতায়ন এবং দারিদ্রের সমস্যার কথা বলছেন, যে ইস্যুগুলো মূলধারার রাজনীতিবিদরা সাধারণত আলোচনায় আনেন না।
সিদ্দিকি তার বক্তৃতায় বলেন, “ও আমার আল্লাহ! আমি নবীর (নবী মোহাম্মদ) পরিবারের বংশধর এবং আমি আপনাদেরকে এই প্রশ্ন তোলার জন্য অনুরোধ করছি - ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যে সব পরিবার জীবিকা হারিয়েছে, তাদের কথা কে বলবে? রাজনীতিবিদরা জনসভা করার সময় করোনার কথা ভাবছেন না, কিন্তু লোকাল ট্রেনগুলো তারা বন্ধ করে দিয়েছেন, যেটা হকার, রিক্সা-চালক, ফেরিওলাদের জীবিকা ধ্বংস করে দিয়েছে, যারা এই লোকাল ট্রেনের উপর ভিত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করে”।
আব্বাস সিদ্দিকি বক্তৃতা করেন ওয়াজ মাহফিলের ঢঙে।কোনো ইস্যু উত্থাপন করে প্রায়ই শ্রোতাদের কাছে জিজ্ঞাসা করেন- ঠিক কিনা? আর এটিই হাজার হাজার মুসলিম ছেলেকে আকৃষ্ট করে। ‘যদি দিদি (মমতা ব্যানার্জি) বিজেপিকে থামাতে চান, তবে তিনি কেন ৪৪টি আসনে আমাকে সমর্থন করেন না? ঠিক কিনা?’
তিনি ইতোমধ্যেই গ্রাম বাংলায় প্রচারণা শুরু করেছেন, আশা করছেন, ডিসেম্বরে তার দলের নাম ঘোষণা করবেন। তিনি জনসভাগুলোতে বলছেন, যদি তারা আপনাকে ভেঅট না দেয়, তবে তাদের ঘেরাও করুন।
পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমরা তৃণমূলের পক্ষ নিয়ে বাম ফ্রন্টকে যখন ত্যাগ করল, তখন প্রমাণিত হলো যে মুসলিমরা কমিউনিস্ট পার্টির মতো প্রবল ক্ষমতাসীন দলকেও (১৯৭৭-২০১১)গড়তে বা ভাঙতে পারে।ফলে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর মমতা মুসলিমদের খুশি করতে এগিয়ে এলেন, ইমাম ও মোয়াজ্জিনদের ভাতা প্রদান করার কথা ঘোষণা করলেন।
কমিউনিস্ট মতাদর্শের পাশাপাশি বাঙালিরা গভীর হিন্দু জাতীয়তাবাদী ধারাও নির্মাণ করেছে। রাজনৈতিক মনোত্ত্ববিদ আশীষ নন্দী এই সাংবাদিককে আগে এক সাক্ষাতকারে জানিয়েছিলেন।
নন্দী বলেন, বঙ্গভঙ্গের সময় (১৯০৫ সালে বাংলার প্রথম বিভক্তির সময়) এবং এমনকি এর আগেও হিন্দু জাতীয়তাবাদী ধারা ছিল। বাংলায় হিন্দু জাতি-রাষ্ট্রের প্রতি ভালোবাসার উপাদান ছিল। বিজেপি সম্ভবত এই ধারায় কাজ করার চেষ্টা করছে।
ফলে মুসলিমদের তোষণ করার কৃত্রিম কিছু পদক্ষেপের পাশাপাশি ধর্মীয় নেতাদের বৃত্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত দেশ ভাগ সৃষ্টিকারী সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ইতিহাস থাকা পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু ভোট সুসংহত করে।
হিন্দু ভোটের (পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৭০ ভাগ)সুসংহত হওয়ায় ২০১৯ সাল বিজেপি জাতীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে ৪২টির মধ্যে ১৮টিতে জয়ী হয়। আর তা মমতাকে বেশ নাড়িয়ে দেয়। তিনি ডানপন্থী হয়ে পড়েন।তৃণমূলপন্থী সামাজিক মাধ্যমের মাইমগুলো মমতাকে হিন্দু ত্রাতা হিসেবে তুলে ধরতে থাকে। মমতা হিন্দু পুরোহিতদেরও বৃত্তি দিতে থাকেন এবং এর পরিমাণ হয় ইমামদের তিনগুণ। তার দলের সহকর্মীরা (এমনকি মুসলিমরাও) তার পদক্ষেপকে স্বাগত জানান।
সিনিয়র মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী বলেন, আমরা পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট বুঝি। হিন্দুত্ববাদী শক্তির উত্থানের কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সাথে মিত্রতা করছেন। কারণ তাদের কাছেই আছে বেশি ভোট। তবে নির্বাচন শেষ হয়ে যাওয়া মাত্র তিনি তার স্বাভাবিক মধ্যপন্থার অবস্থানে ফিরে আসবেন। তিনি মনে করেন, আইমিম বা আব্বাস সিদ্দিকির কোনো সুযোগ নেই।
সিদ্দিকুল্লাহ বলেন, মুসলিমরা সচেতন যে বাম ফ্রন্টের আমলের চেয়ে তৃণমূলের সময়ে তাদের জীবনমানের উন্নতি ঘটেছে। ফলে আইমিম বা অন্যদের মনোযোগ নষ্টকারী ঘটনা সত্ত্বেও তারা দিদিকে ভোট দেবেন।
তবে তৃণমূল সিদ্দিকিকে নিয়ে চিন্তিত।কারণ বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস সিদ্দিকিকে প্রলুব্ধ করে কাছে টানার চেষ্টা করছে। অবশ্য, তৃণমূলের শক্তিশালী নেতা ও দক্ষিণ ২৪ পরগানা জেলার এমএলএ শওকত মোল্লার মতো লোকেরা সিদ্দিকিকে বিজেপির এজেন্ট হিসেবে অভিহিত করেছেন।
দরগার রাজনীতি
কলকাতা থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে বাঙালি মুসলিমদের সবচেয়ে শ্রদ্ধাভাজন সুফি খানকা, ফুরফুরা শরিফ। এই দরগার কয়েক ডজন পিরের মধ্যে মুরিদদের ওপর যার সবচেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে, তিন হলেন পিরজাদা তোহা সিদ্দিকির। তিনি তার পুরনো পারিবারিক বাড়িতে শুক্রবার তার সাপ্তাহিক দরবার বসান। তিনি বলেছেন, তিনি সবার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন, তবে কারো সাথেই তার বিশেষ সম্পর্ক নেই।
তিনি বলেন, আমি কোনো রাজনৈতিক দল করি না। তবে মুকুল রায় (বিজেপির পশ্চিমবঙ্গের সহ-সভাপতি) থেকে মুখমন্ত্রী পর্যন্ত সবাই আমার কাছে আসে। অবশ্য বাঙলার মুসলিমদের প্রিয় দরগার পিরেরা কোনো না কোনো রাজনৈতিক দর্শনের প্রতি অনুরক্ত থাকেন এবং রাজনৈতিক দলগুলো তাদের টার্গেট করে।
পিরজাদা ইব্রাহিম সিদ্দিকি ও কাশেম সিদ্দিকি কমিউনিস্টপন্থী হিসেবে পরিচিত। তাদের ওপর ২০১৪ সালে তৃণমূল সমর্থকেরা হামলা চালিয়েছিল। তোহার ভাতিজা আব্বাস সিদ্দিকিও কয়েক সপ্তাহ আগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, নির্বাচনে তৃণমূলের ভোট কাটার জন্য তাতে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেয়ার পর।
প্রায় এক যুগ আগে তোহা সিদ্দিক তৃণমূলের সাথে জোট গড়েছিলেন কমিউনিস্টদের হারানোর জন্য। তিনি এখন নিরপেক্ষ থাকার দাবি করছেন। তবে একইসাথে তিনি তার অনুসারীদের অসাম্প্রদায়িক দলগুলোকে ভোট দিতে বলছেন।
এই সাংবাদিককে তিনি বলেন, মমতা ব্যানার্জি মুসলিমদের জন্য বেশি কিছু করেননি। তবে তিনি জয়ী হবেন। কারণ অন্য দলগুলো সাম্প্রদায়িক। তিনি এর মাধ্যমে তার ভাতিজা আব্বাসের (তৃণমূলে উদ্বেগ সৃষ্টিকারী) রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতি ইঙ্গিত করেন।
মুসলিম রাজনীতি বদলে যাচ্ছে
অবশ্য বিশ্লেষকেরা বলছেন, তোহা সিদ্দিকের সম্ভবত তার মুরিদদের ওপর আগের মতো প্রভাব নেই।কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সে রাজনীতি বিজ্ঞানী মাইদুল ইসলাম বলেন, ফুরফুরার অভিভাবক সিদ্দিকি পরিবারের মধ্যে জটিল রাজনীতি থাকায় তাদের অনুসারিদের মধ্যে প্রভাব পড়ছে।
ভারতীয় মুসলিমদের নিয়ে তিনি অনেক কাজ করেছেন। তিনি বলেন, ফুরফুরা শরিফের প্রধান চ্যালেঞ্জ আসছে দুই দিক থেকে।
তিনি বলেন, প্রথমত তবলিগি জামায়াত ফুরফুরার প্রভাব অনেকাংশেই খর্ব করছে। ফুরফুরার সুফি ধারা দেওবন্ তবিলিগি জামাতের সাথে মেলে না। ফল তারা তোহা সিদ্দিকির প্রভাব হ্রাস করে দিতে পারে।
তিনি বলেন, চাচা (তোহা) ও ভাতিজার (আব্বাস) মধ্যেও মতবিরোধ আছে। তা হলো সম্পত্তি নিয়ে : ফুরফুরা পরিবারের বিশাল সম্পত্তি কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে? আব্বাস যদি মমতাবিরোধী শিবিরে যোগ দেন, তবে তোহা অন্য সুরে কথা বলবেন।
তিনি বলেন, বাম ফ্রন্ট মুসলিম প্রশ্নটি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে।তাদেরকে মুসলিমদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে সাম্প্রদায়িক নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। মধ্যমন্থী জাতীয়তাবাদী দলগুলোর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। এটা সম্ভবত রাজনীতিতে সক্রিয় ধর্মীয় নেতাদের শক্তিশালী করেছে।
অবশ্য মমতা ব্যানার্জি মুসলিমদের সাথে সম্পর্কিত হতে ধর্মীয় নেতাদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছেন।
মাইদুল ইসলাম বলেন, তৃণমূলের আমলে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমরা যে শিক্ষা, চাকরিসহ অনেক ক্ষেত্রে উন্নতি করেছে, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।ফলে তৃণমূল প্রার্থীদের সমস্যায় ফেলার জন্য প্রার্থী দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তা করা হলে বিজেপির বিজয় অনিবার্য করে তুলবে। আর তা মুসলিমদের জন্য অনুকূল হবে না। সর্বোপরি এটা একটা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য।
অবশ্য মধ্য-জাতীয়তাবাদী ও সেক্যুলার দলগুলো সংখ্যালঘুদের আকাঙ্ক্ষা মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছে। তিনি বলেন, বামপন্থীরা পর্যন্ত তা পারেনি। ওবিসিদের (পশ্চাদপদ শ্রেণি) জন্য সংরক্ষণ থাকায় দক্ষ শ্রম বাজারে মুসলিমদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়নি। আসাদউদ্দিন ওয়াইসি তা করছেন। বাম ফ্রন্ট বা অবিজেপি দলগুলো তা করতে পারেনি।
এই প্রেক্ষাপটে ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য বিধান সভার নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনের প্রধান এজেন্ডা হবে বিজেপিকে আটকানো। বিজেপি ও তার মিত্ররা এখন পর্যন্ত দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য দখল করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ দুটি রাজ্য হলো কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গ।অথচ তারা এমনকি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মিরও দখল করেছে। বিজেপি নেতৃত্ব জানে যে এই দুই রাজ্যে, বিশেষ কর পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের টার্গেট করা ছাড়া ক্ষমতা দখল করা অবাস্তব। এ কারণে বিজেপি মুসলিমদের গ্রহণ করার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। বিজেপির জাতীয় সংখ্যালঘু সেলের প্রধান হাজি জামাল সিদ্দিকি বলেন, পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদেরকে বিজেপি মুসলিমদের বিরোধী এই মিথ থেকে বের হয়ে তৃণমূলকে তাড়াতে এগিয়ে আসতে হবে।
মুসলিমরা শেষ পর্যন্ত কী করে তাই পশ্চিমবঙ্গ ও এর বাইরের সবার দেখার আগ্রহের বিষয়।
সূত্র : এসএএম