ট্রাম্প হেরে যাওয়ায় বিপদে মোদি!
মোদি ও ট্রাম্প - ছবি : সংগৃহীত
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের নাম চূড়ান্ত হওয়া মাত্র বিশ্বনেতারা তাকে অভিনন্দন জানাতে শুরু করেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও তার ব্যতিক্রম নন।
তবে গত বছর আমেরিকার টেক্সাসে এক অনুষ্ঠানে এই নরেন্দ্র মোদিই প্রকাশ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আবার জেতানোর ডাক দিয়েছিলেন - যেটাকে অনেকেই তখন ভারতের চিরাচরিত পররাষ্ট্রনীতির লঙ্ঘন বলে বর্ণনা করেন।
ট্রাম্পের প্রতি মোদি সরকারের সেই খোলাখুলি সমর্থনের কারণে ভারতকে কি এখন অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে?
পর্যবেক্ষকরা অবশ্য বলছেন, বাইডেন প্রশাসনের অনেক দৃষ্টিভঙ্গি ভারতের জন্য বিব্রতকর হলেও শেষ পর্যন্ত চীন ফ্যাক্টরের কারণেই ভারতের স্বার্থ হয়তো এ যাত্রায় বেঁচে যাবে।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে হিউস্টনের 'হাউডি মোদি' অনুষ্ঠানে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পাশে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী স্লোগান দিয়েছিলেন 'আব কি বার ট্রাম্প সরকার'।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বছরখানেক আগেই ট্রাম্পের হয়ে দেওয়া সেই জয়ধ্বনি ভারতকে এখন বিড়ম্বনায় ফেলছে কি না, গত শুক্রবার সন্ধ্যাতেই সে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তবকে।
জবাবে শ্রীবাস্তব বলেন, "ভারত-মার্কিন সম্পর্ক খুব দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত - প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য, বিনিয়োগ থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে বিস্তৃত এটা একটা সর্বাত্মক গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ।"
"এই সম্পর্ককে আমেরিকার উভয় দলই জোরালোভাবে সমর্থন করে, যা একের পর এক প্রেসিডেন্টের আমলে ক্রমশ আরো নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।"
ভারতের মুখপাত্র যখন এ মন্তব্য করছেন, তখনো জো বাইডেনের চূড়ান্ত বিজয় ঘোষণার চব্বিশ ঘন্টারও বেশি বাকি।
সেই ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও ওয়াশিংটনে নিযুক্ত প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত নিরুপমা রাও মেননও অবশ্য নিশ্চিত, বাইডেনের আমলেও ভারত-মার্কিন সুসম্পর্কের ধারায় বিশেষ ছেদ পড়বে না।
রাওয়ের কথায়, "ভারতের সঙ্গে আমেরিকার স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ বহু ক্ষেত্রেই অভিন্ন, জো বাইডেনও সেটার স্বীকৃতি দিয়েছেন। এই সম্পর্কের যে ইতিবাচক দিকগুলো, সেগুলো তার আমলেও অক্ষুণ্ণ থাকবে আমার বিশ্বাস।"
"এর একটা বড় কারণ চীনের ভূমিকা ... রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত আজকের আমেরিকাতেও কিন্তু সবাই মোটামুটি একমত যে চীনের মোকাবিলায় আমেরিকাকে কিছু একটা করতেই হবে।"
"ফলে দিল্লির সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্ক কেমন দাঁড়াবে, সেখানেও সবটা কিন্তু মার্কিন-চীন সম্পর্কের ওপরেই নির্ভর করছে," বলেন তিনি।
দিল্লিতে 'দ্য প্রিন্টে'র কূটনৈতিক সম্পাদক নয়নিমা বসু আবার মনে করছেন, ভারতের প্রতি আমেরিকায় 'বাইপার্টিজান সাপোর্ট' থাকলেও কাশ্মীরের মতো ইস্যুতে ডেমোক্র্যাট প্রশাসন দিল্লির জন্য খানিকটা অস্বস্তি বয়ে আনতে পারে।
তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, "এটা ঠিকই যে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে মোদী সরকারের সঙ্গে তার একটা বিশেষ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তবে ডেমোক্র্যাট বারাক ওবামার সঙ্গেও তার যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।"
"আর এই যে আমেরিকার উভয় দলের সমর্থন ভারত আগাগোড়াই পেয়ে আসছে, বাইডেনের আমলেও সেটার নড়চড় হওয়ার বিশেষ কারণ নেই।"
তিনি বলেন, "তবে এই সম্পর্কে একটা অস্বস্তির উপাদান থেকেই যাচ্ছে। সেটা শুধু ট্রাম্পের হয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদীর স্লোগানের জন্যই নয়, মনে রাখতে হবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও গত বছর আমেরিকায় গিয়ে সিনিয়র কংগ্রেসওম্যান প্রমীলা জয়পালের সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করেছিলেন - যিনি কাশ্মির প্রশ্নে ভারতের খুব কঠোর সমালোচক।"
"বাইডেন প্রশাসনে সেই প্রমীলা জয়পালকেই হয়তো এখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা যাবে। তা ছাড়া ভাবী ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিসও বহুবার বলেছেন কাশ্মির ইস্যুটা ভারত ঠিকমতো সামলাতে পারেনি ... ফলে সেখানে বিব্রত হওয়ার একটা অবকাশ থাকছেই।"
তবে শেষ পর্যন্ত চীনের বিরুদ্ধে দুদেশের যৌথ অবস্থানই 'আব কি বার ট্রাম্প সরকারে'র মতো স্লোগানকে পেছনে ফেলে দেবে বলে তার বিশ্বাস।
নয়নিমা বসুর কথায়, "ভারত-মার্কিন স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক বছরদশেক আগেও যা ছিল তার চেয়ে এখন অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ - আর সেটার পেছনে প্রধান কারণ চীন ফ্যাক্টর।"
"সেটা ইন্দো-প্যাসিফিকই বলুন, 'কোয়াড' বা চতুর্পক্ষীয় নিরাপত্তা সংলাপই বলুন কিংবা মালাবার এক্সারসাইজের মতো যৌথ নৌ-মহড়া - সব ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে। মালাবারের দ্বিতীয় পর্ব তো এ মাসের শেষেই হবে।"
"বাইডেন প্রশাসনকেও কিন্তু চীনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতেই হবে, যদিও রেটোরিক হয়তো ট্রাম্প জমানার মতো কর্কশ হবে না।"
"আর সেই বাস্তবতাই বাকি সব ভুলে আমেরিকা ও ভারতের সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাবে। রাজনীতিতে যে এসব স্লোগান-ফ্লোগান চলেই, এটা তো তাদেরও ভালোই জানা আছে", বলছিলেন বসু।
সাবেক এক ভারতীয় কূটনীতিবিদের কথায়, "টাইম মেশিনে হিউস্টনে ফিরে যেতে পারলে নরেন্দ্র মোদি নির্ঘাত ও রকম স্লোগান আর দিতেন না - কিন্তু এ যাত্রায় চীন-মার্কিন সম্পর্কের চরম অবনতিই হয়তো ওয়াশিংটনে তার মুখরক্ষা করে দেবে!"
সূত্র : বিবিসি